ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

২১ সন্তানের জননী!

শাহজাহান মোল্লা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৪
২১ সন্তানের জননী! ছবি: জাহিদুল ইসলাম / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বনি কাপুচিনো। জন্ম কানাডায়।

পেশায় গৃহিণী। স্বামী ফ্রেড কাপুচিনো ছিলেন কানাডার এক সময়ের মন্ত্রী। বাংলাদেশের সঙ্গে বনি কাপুচিনো দম্পতির পরিচয় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে। তাদের রয়েছে ২১ সন্তান! এদেশের মানুষ যা পরেনি তাই করে দেখিয়েছেন কানাডিয়ান এই দম্পতি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। অনেক মা-বোন হারিয়েছেন তাদের সভ্রম। পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নির্যাতিত হয়েছেন অনেক নারী। নির্যাতিদের অনেকেই সন্তান জন্ম দেন স্বাধীন দেশের মাটিতে। দেশে থাকলে পিতৃ পরিচয়হীন এসব শিশুর ঠাঁই হতো হয়তো কোনো বস্তি বা ফুটপাতে। কিন্তু তারাই এখন কানাডার নাগরিক। কাপুচিনো দম্পতির প্রাণের ধন, প্রিয় সন্তান।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত যুদ্ধশিশু নিয়ে একটি প্রতিবেদন পড়ে ফ্রেড কাপুচিনোর মন জাগ্রত হয় মানবপ্রেম। বিশ্বের সব অসহায় শিশুর ‘মা’ মাদার তেরেসা এলেন সহায় হয়ে। তার সহায়তায় ১৯৭২ সালে ৭ জুলাই বাংলাদেশ আসেন বনি কাপুচিনো।
 
এদেশে এসে নিয়ে যান ১৫ জন যুদ্ধশিশু। এদের মধ্যে ছিলেন রানী, অরুণ, সাবিত্রী, ওমর, রূপিয়া রিতা, বাথল, জরিনা, আমিনা, প্রদীপ, শিখা, রাজিব, মলি, অনিল, রোজিনা ও সমর। ১৯৭২ সালের ৯ জুলাই যখন এদের নিয়ে যাওয়া তখন কারো বয়স ৩ মাস, কারো ১১।
 
একাত্তরের যুদ্ধশিশু নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বিনিময় ও বাংলাদেশকে সেই সময়ের প্রামাণ্য দলিল বুঝিয়ে দিতে এলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।
 
বনি কাপুচিনোর বর্তমান বয়স (৮০)। স্বামী মারা গেছেন আগেই। সন্তানকে নিয়ে তিনি আসেন প্রিয় বাংলাদেশে। বাংলানিউজকে কাপুচিনো জানান তার সেই স্মৃতিকথা।
 
কাপুচিনোর ভাষ্যমতে, ১৯৭২ সালে এদেশে থেকে ১৫ জন শিশু নিয়ে যান কানাডায়। তাদের মধ্যে শিখাকে রেখে দেন নিজের কাছে। তার নিজের গর্ভজাত সন্তান রয়েছে দু’টি। তাদের সঙ্গে কখনো আলাদা করে দেখেন নি এসব শিশুদের। ১৪ জনকে ১৪টি কানাডিয়ান পরিবারের কাছে দত্তক দেন। সেই অনাথ শিশুরা এখন কানাডার নাগরিক। এসব অনাথ শিশুদের জন্ম বাংলার মাটিতে হলেও পরিচয় কানাডিয়ান হিসেবেই। যাদের মূল কারিগর বনি কাপুচিনো। যিনি ‘বনি মা’ হিসেবেই খ্যাত।
 
বনি মা যে শিখাকে নিজের সন্তান হিসেবে রেখে দিয়েছিলন, সেই শিখার ঘরেও আছে দুই মেয়ে। শিখাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে একটি সরকারি চাকরিও দিয়েছেন বনি মা। মেয়ে শিখাকে বিয়ে দিয়েছেন আমেরিকান এক ব্যবসায়ী সঙ্গে।
 
শুধু শিখাই নয়, এভাবে ১৯টি দেশে থেকে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে নিজের পরিবারেই লালন-পালন করেছেন এই কানাডিয়ান। নিজের গর্ভের দুই সন্তানসহ তার মোট সন্তান এখন ২১জন। তাদের প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত বলেও জানান তিনি।
 
বনি কাপুচিনো যুদ্ধশিশু হিসেবে নেন আফ্রিকা, ভিয়েতনাম, তিব্বত, ভারতসহ মোট ১৯ দেশের শিশু। তার কাছে জাতি-ধর্ম নয়, এরা মানুষ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে।
 
এখানেই শেষ নয় কাপুচিনোর কাজ। অনাথ শিশুদের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ৯টি শিশুসদন বা আশ্রম। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন শিশুস্বর্গ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ২০০২ সালে গড়া এ প্রতিষ্ঠানে ১২০ জন অনাথ শিশু রয়েছে। যাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখভাল করবেন কাপুচিনো। এরকম আরও ৮টি আশ্রম রয়েছে বনি কাপুচিনোর। যেখানে হাজার হাজার শিশু বড় হচ্ছে। ভারতে রয়েছে কাপুচিনোর ৫টি আশ্রম। এছাড়া রয়েছে তিব্বত ও নেপালে।

কাপুচিনোর বর্তমান বয়স ৮০ হলেও বোঝার উপায় নেই যে তিনি বার্ধক্যে চলে এসেছেন। প্রতিবছর ৩/৪ বার বাংলাদেশে আসেন তার আশ্রমের বাচ্চাদের দেখতে। কতটা মানবদরদী না হলে এ কাজ করা যায় তার প্রমাণ একমাত্র বনি কাপুচিনোই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমাকে যে সুযোগ করে দিয়েছে তা ভোলার নয়। তাই আমি বাংলাদেশকে খুব ভালোবাসি।
 
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।