ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

এতো দেখি কামলার হাট

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৪
এতো দেখি কামলার হাট ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ সদর উপজেলার দাপুনিয়া বাজার। হিম হিম ঠাণ্ডা হাওয়া।

কুয়াশার চাদরে মোড়ানো চারপাশ।

ভোর সোয়া ৬টার দৃশ্য হঠাৎ চমকে যাওয়ার মতো। এক সঙ্গে অনেক লোক। সবার সঙ্গে বাঁশের লাঠি। গায়ে চাদর বা সোয়েটার। দাঁড়িয়ে আছেন ময়মনসিংহ-ফুলবাড়িয়া সড়কে।

ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় তাদের বলা হয় চুক্তি কামলা’। অগ্রহায়ণের শুরু থেকেই গ্রামে গ্রামে পুরোমাত্রায় শুরু হয়েছে আমন ধান কাটা আর মাড়াইয়ের উৎসব। এ সময় এরাই মাঠে-ঘাটে দিনমজুরের কাজ করেন। চুক্তিভিত্তিক গৃহস্থের ধান কাটেন। ফলে এ সময় প্রতিদিনই এই সড়কে তাদের দেখা মেলে।

নিজের শ্রম বিনিয়োগ করে আমনের মৌ মৌ গন্ধে কৃষকের আঙিনা ভরিয়ে তোলা এসব কামলা দৈনিক মজুরির পাশাপাশি পেটপুরে গৃহস্থের ঘরে খান দুই বেলা ভাত। দেশের মধ্যে বিদেশ ঘোরা কামলারা দূর-দূরান্তে গিয়ে কাজ করেন। তাদের কারো গন্তব্য দাপুনিয়ার বিভিন্ন গ্রাম। কেউ যাবেন কাতলাসেন কিংবা ফুলবাড়ীয়ায়।

আমন মৌসুমে প্রতি বছরই অসংখ্য কামলা বিভিন্ন জেলা বা উপজেলা থেকে ময়মনসিংহে আসেন। ধান কাটা মৌসুমে সিলেটের সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, তারাকান্দা ও ফুলপুর উপজেলা থেকে কামলারা অনেক সময় ৩০ থেকে ৪০ দিন ঘরের বাইরে থাকেন।

সদর উপজেলার দাপুনিয়া এলাকার সুতিয়া ব্রিজ। শীতের এ সময়ে সুতিয়া নদীর পানি শুকিয়ে ঠেকেছে তলদেশে। এ ব্রিজের পাশেই দাঁড়িয়ে আলাপ হয় মোহনগঞ্জ থেকে আসা আব্দুল হালিমের (৩৫) সঙ্গে। বড় গৃহস্থের বাড়িতে ধান কাটার আশায় ফজরের নামাজের পর থেকেই তিনি অপেক্ষা আছেন এই কামলা বাজারে।

হালিম জানান, বাড়তি আয়ের আশায় তারা পাঁচজন ১০ দিন ধরে নিয়ম করে দাপুনিয়া বাজারে আসছেন। প্রতিদিন ভোর হলেই এখানে চলে আসেন। দল বেঁধে গৃহস্থের জমির ধান কাটেন। সারাদিন কাজ করে একেকজন ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা পান।

আলাপের ফাঁকেই এসে হাজির এক গৃহস্থ। হাঁক দিলেন হালিম। দরদাম মিটিয়ে তার সঙ্গে হেঁটে পথ চলতে শুরু করলেন পাশের কাতলাসেন বাজার এলাকার উদ্দেশে।

হালিম চলে যাওয়ার পর নিজে থেকেই কথা বলতে এগিয়ে আসেন সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার হাবিবুর রহমান (৪৫)। কী অবস্থা জানতে চাইতেই একদমে নিজের জীবন সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরলেন। জানালেন, ‘ফসল মাইর গেছে। হানি ধান খাইয়া আলছে। অহন বেকার। ঘুইরা ঘুইরা কাম করি। বাচ্চাতো পালতে অইবো। ’

হাবিবুরের দুই সন্তান। একজনের নাম আশা মণি (৭) ও অন্যজন আশা কলি (৪)। জীর্ণ চাদরে গা মোড়ানো মুখচ্ছবিতে অভাবের রেখা স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘দুঃখের কথা কী কইমু। মাস দু’য়েক আমরা এই জেলা, ওই জেলা ঘুইরা বেড়াই। দেশের মধ্যে বিদেশ ঘুরি। দিন শেষে খোরাকি পাই। এর সঙ্গে যার ধান কাটি সে দেয় দু’ই বেলা ভাত। ’

পান চিবুতে চিবুতে তার সঙ্গী আবুল হাশিম (৫০) ডাক দিলেন হাবিবুরকে। গন্তব্য দাপুনিয়ার ঘাগড়া গ্রাম। কাঁধে ‘ভারবাঁশ’ নিয়ে ছুটে চললেন তারা।

মনির হোসেন। এসেছেন প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের উপজেলা তারাকান্দা থেকে। ১৫ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে প্রায় ২০ দিন ধরে আছেন দাপুনিয়া বাজার এলাকার একটি স’মিলে।

তিনি বলেন,  ‘ভাই ৬০ টাকা কেজি চাল। সংসারে লোক বেশি। গেরামে কাম থাকলেও মজুরি কম। কিন্তু এইহানে মাসব্যাপী কামলা দিলে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পামু। এই টাকা জমাইয়া বাড়ি ফিরমু। ’

মনিরের সঙ্গে থাকা রিপন জানান, দল বেঁধে ধান কাটার পর আঁটি বেঁধে মালিকের বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। তাদের কাজ ধান মাড়াই পর্যন্ত। ধানের মালিক বাড়িতে থাকতে না দিলেও পেটপুরে দুই বেলা খেতে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।