ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া প্রাণীরা

আতিফ আতাউর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৫
বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া প্রাণীরা

ডিসকভারি চ্যানেলে ঢু মারলে কত শত প্রাণীরই তো দেখা মেলে। বাঘ, ভালুক, সিংহ, হায়েনা, শিম্পাঞ্জী থেকে শুরু করে ঘরিয়াল, কুমির, এমনকি হরহামেশা দেখা মেলে বনগরুরও।

ভিনদেশে বসত করা এসব প্রাণী দেখে আমার আপনার মনে হতেই পারে এগুলোর অনেকেই আমাদের দেশে নেই কেন? গণ্ডার, বনগরু, ঘরিয়াল আজ আমাদের দেশে নেই। কিন্তু যদি বলি এক সময় ছিল, তাহলে হয়ত চমকেই উঠতে হবে অনেককে।

চলুন জেনে নেই এমন কিছু প্রাণীর কথা, যেগুলো একসময় বাংলাদেশের বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। কালের বিবর্তনে আজ তারা বাংলাদেশ ভূ-খণ্ড থেকে বিলুপ্ত। অবাক করা তথ্য হচ্ছে পৃথিবীতে বর্তমানে টিকে থাকা প্রাণীকূল পৃথিবীর মোট প্রাণীদের মাত্র ৫%। বাকি ৯৫% প্রাণীই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

কোনো প্রাণী বা প্রজাতির বিলুপ্ত বলতে সমগ্র পৃথিবী থেকে একটি জিনপুলের নিশ্চিহ্ন হওয়াকে বোঝায়। আর এমন একটি প্রজাতি-বিলুপ্তির সঙ্গে বাংলাদেশও জড়িত! প্রাণীটির নাম গোলাপি শির হাঁস, Rhodonessa caryophyllacea (latham)|



বাংলাদেশ থেকে আরো বিশটি প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য কিছু দেশে ওদের বংশধরেরা এখনো বেঁচে আছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে এমন আরো একশ’টি প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার প্রহর গুনছে। বাংলাদেশে বিলুপ্ত হওয়া বন্যপ্রাণী সর্ম্পকে প্রথম আলোকপাত করেন Husain (19974)|

চলুন জেনে নেই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়া কয়েকটি প্রাণী সম্মন্ধে। প্রথম পর্বে নেকড়ে ও ডোরাকাটা হায়েনাসহ ৫ বিলুপ্ত প্রাণী সম্পর্কে জানব।


নেকড়ে (THE WOLF)
নেকড়ের বৈজ্ঞানিক নাম Canis lupus| এদের উচ্চতা আড়াই ফুটের কাছাকাছি। লম্বায় তিন থেকে সাড়ে তিনফুট হয়। ওজন ১৮ থেকে ২৭ কেজি। নেকড়ে দেখতে প্রায় কুকুরের মতো। এদের চোখ হলুদাভ। নেকড়ে জংলী হলেও খোলা প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়। শিকারের জন্য সময়ের বাছ বিচার করে না। যখন তখন মানুষের সামনে থেকেই তুলে নিয়ে যায় ছাগল, ভেড়া। নেকড়ের প্রধান শিকার গবাদিপশু। তবে মানুষের বাচ্চা ধরে নিয়ে যাওয়ার বদনামও আছে নেকড়ের নামে। ওদের শিকারের জ্বালা এতটাই চরমে উঠেছিল যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার নেকড়ে মারার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল।



প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলেও একটা সময় পর্যন্ত নেকড়েদের অবাধ বিচরণ ছিল।

বর্তমানে নেকড়ে আছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, কাশ্মীর, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তিব্বত উত্তর আরব ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে।


ডোরাকাটা হায়েনা (THE STRIPED HYENA)
স্থানীয় নাম নকড়া-বাঘ বা হায়েনা। বৈজ্ঞানিক নাম Hyaena hyaena| পুরুষ হায়েনা লম্বায় ৫ ফুট, উচ্চতায় ৩ ফুট এবং ওজনে ৮৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্ত্রী হায়েনার ওজন পুরুষের তুলনায় সামান্য কম। হায়েনা দেখতে অনেকটা কুকুরের মতো। বন-জঙ্গলের চেয়ে হায়েনাকে খোলা প্রান্তরেই বেশি দেখা যায়। ছোট পাহাড়, ঝোপঝাড়, আখক্ষেতের ভেতর পালিয়ে থাকে হায়েনা। কিংবা শজারুর গর্তকেও নিজের মতো করে বাসা বানিয়ে নেয়। এরা একা কিংবা দলবেঁধে শিকার করে। বাঘের ফেলে দেওয়া শিকারের হাড়গুলো শক্ত চোয়ালের ও দাঁতের সাহায্যে সহজেই ভেঙ্গে গিলে খায়। ছাগল, ভেড়া, ছোট কুকুর ছানাসহ ঘর থেকে মানবশিশু নিয়ে পালিয়ে যাওয়ারও অসংখ্য রেকর্ড রয়েছে হায়েনার। রাতে হায়েনা যখন চিৎকার করে ডাকে তখন তাদের সে ডাককে পাগলের হাসির মতো শোনায়। একেই বলে হায়েনার হাসি। জেনে নিন, বাচ্চা অবস্থা থেকে পুষলে হায়েনা পোষও মানে।



প্রাণীবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের দিনাজপুর, রংপুর, সমগ্র রাজশাহী বিভাগ এবং খুলনা বিভাগের কিছু কিছু অংশে হায়েনার বিচরণ ছিল।

বর্তমানে হায়েনা আছে ভারত, নেপাল, উত্তর আফ্রিকা, আরব, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, রাশিয়া ও তুর্কিমেস্তানে।


মালয়ী সুর-ভালুক (THE MALAYAN SUN BEAR)
সুর ভালুকের বৈজ্ঞানিক নাম Helorctos malayanus| এরা লম্বায় ৩ থেকে সাড়ে ৪ ফুট এবং ওজনে ২৭ থেকে ৬৫ কেজি পর্যন্ত হয়। মাটি থেকে দেহের উচ্চতা ২ ফুট। ভালুকদের মধ্যে সুর ভালুক সবচেয়ে ছোট। গায়ের পশম কুচকুচে কালো। কান ছোট আর নাক গোলাকার। এদের জিহ্বা অনেক লম্বা। সাধারণত গহীন পাহাড়ি বনে বাস করে। প্রাণীবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সুর ভালুক ৯ থেকে ১২ হাজার ফুট উঁচুতে বরফের কাছেও পাওয়া যায়। শীতকালে নিচে নেমে আসে। এরা একই সঙ্গে মাংশাসী ও তৃণভোজী। খাবার হিসেবে ফলমুল, ঘাস লতাপাতা, মধু ছাড়াও ছাগল, ভেড়া, পাখি এমনকি উঁইপোকাও ধরে খায়।



সুর ভালুক বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে ও গারো পাহাড়ে বিচরণ করত। সিলেটেও এদের বসবাস ছিল বলে মনে করেন প্রাণীবিজ্ঞানীরা। সুর ভালুকের বিলুপ্তির অন্যতম একটি কারণ হলো ভ্রান্তবিশ্বাস। ধারণা করা হতো যে এর পিত্তথলি, করোটি দিয়ে তৈরি ওষুধ খেলে সুস্বাস্থ্য ও যৌবন লাভ করা যায়। আর এ ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাই কাল হয়ে দাঁড়ায় সুর ভালুকের জন্য। এছাড়া বন ধ্বংস ও ফসল রক্ষার জন্যও এদের নির্বিচারে মেরে ফেলা হতো।


গণ্ডার (THE RHINOCEROS)
সারা পৃথিবীতে ৫ প্রজাতির গণ্ডারের মধ্যে বাংলাদেশেই তিন প্রজাতির গণ্ডার পাওয়া যেত। বাংলাদেশে বসবাস করা প্রজাতিগুলো হচ্ছে বড় একশৃঙ্গী গণ্ডার (Rhinoceros unicornis), ছোট একশৃঙ্গী গণ্ডার (Rhinoceros sondaicus) ও এশিয়ান দ্বিশৃঙ্গী গণ্ডার (Dicerorhinus sumatrensis)|

গণ্ডারের উচ্চতা সাধারণত ৬ ফুট বা তার একটু বেশি। তবে এদের গড় উচ্চতা ৫ ফুট। দেহের ওজন ১৮শ’ থেকে ২২শ’ কেজি।



গণ্ডারের শরীর বেশ হৃষ্টপুষ্ট, চামড়া মোটা, কর্কশ ও লোমবিহীন। কাঁধের সামনে, পেছনে ও উরুর সামনে চামড়া ভাঁজ হয়ে নেমে বর্মের মতো দেখায়। নাকের ওপর একটি বা দুটি শিং থাকে। পাহাড়ি এলাকা, জলাভূমি ও গিরিখাতে এদের বসবাস করতে দেখা যায়। গণ্ডার সাধারণত একা চলে। মল ত্যাগ করে একই জায়গায়। মল জমে জায়গাটি উঁচু হয়ে গেলে নিজের শিং দিয়ে ঢুস মেরে তা গুড়িয়ে আবার সমান করে দেয় গণ্ডায়।

হাতির জাতশত্রু গণ্ডার। কোনো হাতিকে একা পেলে কিংবা হাতির দলে কোনো পুরুষ হাতি না থাকলে তা অন্য হাতিদের জন্য বিপদজনক হয়ে দাঁড়ায়। মারামারিতে যে দুজনের একজন কেউই জেতে, তা নয়। অনেক সময় দুজনেই মরে পড়ে থাকে। মরা হাতির পাঁজরে গণ্ডারের শিং ঢুকে আছে এমনও দেখা গেছে। এরা প্রতি তিন বছর পরপর একটি বা দুটি বাচ্চা প্রসব করে।

বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, সিলেট, গারো পাহাড়, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সুন্দরবনে এসব গণ্ডারদের দেখা মিলত। গণ্ডারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ঘিরে নানা কুসংস্কারমূলক চিকিৎসার উদ্ভব, আর সে প্রয়োজনে দিনকে দিন গণ্ডার শিকারের মাত্রা বেড়ে যাওয়াই প্রাণীটির বিলুপ্তির কারণ—মনে করছেন প্রাণীবিজ্ঞানীরা।


বনগরু (THE INDIAN BISON/ GAUR)
এদের বৈজ্ঞানিক নাম Bos frontalis| গড় উচ্চতা সাড়ে ৫ ফুটের বেশি। বয়স্ক একটি ষাঁড়ের ওজন নয়শ’ কেজি হয়ে থাকে। এরা বিশাল মাথা, সুঠাম দেহের অধিকারী। চোখের রং বাদামী। তবে মাঝেমাঝে নীলচে দেখায়। পাহাড়ি বনে বাস করে এরা। ঋতু ভেদে নিচু জমিতেও চলে আসে। দেখতে এদের ভয়ঙ্কর মনে হলেও আসলে কিন্তু মোটেও তা নয়। এদের বাচ্চাদের ধরে পোষ মানানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্ত তিন বছরের বেশি বাঁচানো যায় না।



পুরনো নথিপত্র অনুযায়ী, চট্টগ্রামে প্রচুর বনগরু ছিল। সিলেট, টেকনাফ, ময়মনসিংহ, কুমিলা ও ফেনীর ছাগলনাইয়াতেও একসময় বনগরুর দেখা মিলত। তবে লোকালয়ে চলে এলে এদের বেশিরভাগই ফিরে যেতে ব্যর্থ হতো। কেননা অধিকাংশ সময় মানুষ তাদের ধরে জবাই করে খেয়ে ফেলত।

বর্তমানে ভারত, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, চীন, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বনগরু দেখতে পাওয়া যায়।

পর্ব ২ পড়তে ক্লিক করুন

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৫
এএফএ/টিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।