ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

স্কুলের পথে কাদের দাদার দোকান

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৬
স্কুলের পথে কাদের দাদার দোকান ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাহুবল, হবিগঞ্জ থেকে ফিরে: গ্রামের প্রবেশ পথেই সুন্দ্রাটিকি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সুন্দ্রাটিকি গ্রাম এখন শোকে স্তব্ধ।

স্কুলের সামনেই চার চারটি শিক্ষার্থীর কবর। গ্রামের পঞ্চায়েত ক্ষমতার দ্বন্দ্বে খুন হয়েছে ৭ থেকে ১০ বছর বয়সী চার শিশু। এদের তিন জনই আবার এ স্কুলের শিক্ষার্থী।

খালের পাড় ধরে আঁকাবাঁকা চলেছে সুন্দ্রাটিকি গ্রাম। খালের পানি এখন কম। সেখানে মাছ ধরতে শরীরে কাদা মাখিয়ে একাকার শিশুরা। মেঠোপথে এখনও ডাংগুলি খেলে সকাল দুপুর পার করে ডানপিটে শিশুরা।

সকাল ৯টায় স্কুল খুলে। এর আগেই দোকান সাজিয়ে বসেন আব্দুল কাদের। গায়ের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। সেখানে রগের রেখাগুলোও স্পষ্ট।

দোকানটিতে চায়ের ব্যবস্থা নেই। তাই সকাল থেকে ভিড় নেই গ্রামের বড় বা বৃদ্ধদের।

সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ঘিরেই আব্দুল কাদেরের ব্যবসা। সব মিলিয়ে এ দোকানে ৪০০ টাকার পুঁজি আছে কিনা সন্দেহ। ৭০ বছরের বৃদ্ধকে বাঁচিয়ে রেখেছে এ দোকান।

বৃদ্ধ অব্দুল কাদেরের ঘরের সঙ্গে লাগা মাটির ভিটার ওপর দোকান। টিন দিয়ে তৈরি দোকানটি দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ ফুট আর প্রস্থে আট ফুট হবে। বিক্রির জন্যে যে ঢালা খোলা রয়েছে, তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ৬ ফুট বাই ৪ ফুট হবে। প্লাস্টিকের জারে সাজানো রয়েছে বুট, লজেন্স, ললিপপ ও কয়েকটি টোস্ট বিস্কুট। আবার দু’টি জার দেখা গেলো খালি।

দোকানে ঝুলিয়ে রেখেছেন ছোট বিস্কুটের মতো খেতে ‘মেজলি’। বড় প্যাকেটগুলোর মধ্যে ছোট-ছোট প্যাকেট রয়েছে। সেগুলো প্রত্যেকটি ৫ টাকা করে। মধুবন নামে চানাচুর-চিড়া ভাঁজা নিয়ে আরেকটি প্যাকেট। এগুলোর দাম ২ টাকা করে। ছোট বিস্কুটের প্যাকেটগুলো ৫ টাকা। আর ভাঁজা চানাচুরের প্যাকেটও ৫ টাকা করে।

বাইরে থেকে দোকানের ডানদিকের তাকে স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের জন্যে বেশ কিছু লেখার খাতাও রয়েছে। এসবের দামও ৫ টাকা করে। রয়েছে দুই ধরনের কেক। লেমন বিস্কুটের একটি প্যাকেট খালি। কিছু ৫ টাকা দামের কলমও ঝুলছে। এই হলো দোকানের মালামালের ফিরিস্তি।

মোটকথা স্কুলগামী শিশুরাই কাদেরের দোকানের প্রধান ক্রেতা। এ বিষয়ে কাদের বলেন, ‘পোলাপাইনে ডাকে, কাদের দাদার দোকান। ’

দোকানের ভেতরের চৌকিতে বসেন আব্দুল কাদের। সাদা স্যান্ডু গেঞ্জি আর পরনে লুঙ্গিটাকে ভাঁজ করে বসেন তিনি। চৌকিতেই ক্যাশ বাক্স। সেখানে সস্তা পাইলট সিগারেটের প্যাকেট আর বিড়ি।

একটি পুরনো ফ্যাকাশে পাঞ্জেখানা ‘অজিফা’ আর ‘নামাজ শিক্ষার’ বই। এগুলো নিজেই পড়েন, সময় পেলে। শুভ্র দাড়ি, ছোট করে ছাটা চুলগুলোও সাদা।

তিনি বলেন, ‘ দোকানের মাল আমিই মিরপুর বাজার থেকে কিনে আনি। সপ্তাহে একবার যাই। এই সপ্তাহে যাওয়া হয় নাই। তাইতো অনেক মাল কম। স্কুলে যাওয়ার পথে পোলাইপাইনেই ইতা কিনে। আবার লেজার পিরিয়ডে (টিফিনে) আসে। আর অনেক সময় মাইনসে (মানুষ) বিড়ি খোঁজে। তাই বাড়িও রাখি। ’

দোকানের সামনে একটি বেঞ্চি পাতা। সেখানে বিশ্রাম নেন দূরের পথে যাওয়া পথিকেরা। সুন্দ্রাটিকি স্কুল ছুটি হয় বিকেল ৫টায়। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত শিশু থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি ক্লাস চলে।

তাই বিকেল পর্যন্তই দোকান খোলা রাখেন তিনি। দুপুরের খাবার খান সকাল ১১টার দিকেই। এ সময়  বেচাকেনা কম থাকে বলে জানান তিনি।

কাদের বলেন, ‘এই দোকান চালাই, হিসাব-নিকাশ করি। নামাজ পড়তে পাশের মসজিদে যাই, বাজারে যাই। কাজ করলে, হাঁটা-চলা করলে শরীর ঠিক থাকে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৬
এমএন/টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।