ঢাকা, বুধবার, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ০৩ জুলাই ২০২৪, ২৫ জিলহজ ১৪৪৫

ফিচার

সুদিন হারানো এক চানাচুরপাড়ার গল্প

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৩ ঘণ্টা, জুন ৯, ২০১৬
সুদিন হারানো এক চানাচুরপাড়ার গল্প ছবি- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নাটোর: একসময় গ্রামের অনেকেরই পেশা ছিল এটা। সেসময় সুসময়ও ছিল তাদের।

তারপর আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সময় যতোটা গড়িয়েছে, ততোই সুদিন বিবর্ণ হয়ে গেছে নাটোরের নলডাঙ্গার সোনাপাতিল গ্রামের একাংশের বাসিন্দাদের।

বাধ্য হয়ে গ্রামের অনেকেই ছেড়েছেন বাপ-দাদার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের পেশা চানাচুর তৈরি। তারা নতুন করে যুক্ত হয়েছেন নানান পেশায়।

তবে যারা অনন্যোপায়, এমন ১৬টি পরিবারের হাতেই এখনো টিকে আছে নলডাঙ্গার সোনাপাতিল চানাচুরপাড়ার ঐহিত্য ও সুনাম। এই ১৬ পরিবারের সদস্যরাই হাতে তৈরি চানাচুর তৈরি করে টিকিয়ে রেখেছেন চানাচুরপাড়াকে, সেইসঙ্গে নিজেদেরও।

কিন্তু ক্রমে তারাও হার মানতে শুরু করেছেন সময়ের কাছে, দৈনন্দিন চাহিদার কাছে। সুদিন হারানো সোনাপাতিলের চানাচুরপাড়ার বাসিন্দাদের তাই ‍অনেকটা সংগ্রাম করেই এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে।

নাটোর জেলা শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটারের মতো উত্তরে গেলে নলডাঙ্গা বাজার। পাশেই বারনই নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজ পার হয়ে কিছুটা এগুতেই নদীতীরঘেঁষা গ্রাম সোনাপাতিল। ওই গ্রামেরই একটি পাড়া পরিচিত চানাচুরপাড়া হিসেবে।

এই পাড়ায় বর্তমানে ২০টি পরিবারের বসবাস। দু/একটি বাড়িতে দালান রয়েছে। বাকি বাড়িগুলো খড় ও টিনের চালার। এ পাড়ারই ১৬টি পরিবারের হাতে টিকে আছে হাতে তৈরি চানাচুরের পেশা।

সম্প্রতি সরেজমিনে ওই পাড়া ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন কাকডাকা ভোরেই এ পাড়ায় শুরু হয়ে যায় কর্মচাঞ্চল্য। কেউ চুলায় আগুন দেয়, কেউবা চানাচুর তৈরির জন্য ছোলা ভাজে। অন্যরা চানাচুরের অন্যান্য উপকরণ তৈরির কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

চানাচুরপাড়ার মানুষের বসতবাড়ি ছাড়া কোনো জমিজমা নেই। বাপ-দাদার ভিটেটুকুই তাদের সম্বল। ফলে বাধ্য হয়ে চানাচুর তৈরির মাধ্যমেই চলছে এসব পরিবারের জীবিকা।

এখানকার বাসিন্দারা জানান, তাদের অনেকেরই ঘরে চানাচুর ভাজার ছোট ছোট মেশিন রয়েছে। পরিবারের নারীরা শিশুদের নিয়ে চানাচুর ভাজাসহ তৈরির কাজ করে। আর তা বাজারে বিক্রি করেন পুরুষ সদস্যরা। অনেক সময় হকাররা বাড়িতে এসেও কিনে নিয়ে যায় চানাচুর।

এভাবে পরিবারপ্রতি দিনে সর্বোচ্চ ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয়। তবে দিন-দিন ছোলা, বুট, তেল ও জ্বালানির দাম বাড়তে থাকায় সমস্যা বেড়েছে এখানকার বাসিন্দাদের। উপকরণের দাম বাড়লেও সমানতালে বাড়ানো যায়নি চানাচুরের দাম।

তার ওপর বর্তমানে দেশে বিভিন্ন স্থানীয় ও বৃহৎ ‍পরিসরে অনেক কোম্পানি মজাদার চানাচুর তৈরি করছে। চটকদার প্যাকেটে এসব চানাচুর সারাদেশে, এমনকি প্রত্যন্ত এলাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে। এতে করে এ ‍পাড়ার হাতে তৈরি চানাচুরের কদর দিনকে-দিন কমে যাচ্ছে।

তবে স্থানীয়ভাবে এখনো কিছুটা কদর রয়েছে সোনাপাতিলের চানাচুরের। বিশেষ করে রবিন ও দেবনাথ তৈরি চানাচুরের যেন জুড়ি নেই। ফলে সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার স্থানীয় হাটবারে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা আসেন এই চানাচুর কিনতে।

‘এক বছর আগেও চানাচুর বিক্রি করে বেশ সাচ্ছন্দে জীবন কাটতো তাদের। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ সংসারে যাবতীয় খরচও চলতো এ থেকে। কিন্তু এখন আর সেই সুদিন নেই। ’

কথা বলার একপর্যায়ে এমনটাই জানালেন চানাচুরপাড়ার বাসিন্দা যুগল চন্দ্র দেবনাথ ও তার স্ত্রী বুলবুলি দেবনাথ।

তারা অভিযোগ করেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, পুলিশি অভিযান ও চাঁদাবাজির কারণে তাদের আয়ের একটা অংশ চলে যায়। ফলে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে ‍অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। যাদের কোনো উপায় নেই  তারাই এ পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন।

এই দম্পতি জানান, চানাচুর তৈরি ও বিক্রি তাদের বাপ-দাদার পেশা। চানাচুর বিক্রি করেই তাদের পূর্ব পুরুষদের জীবন কেটেছে, তাদেরও কাটছে। এখানকার কারোই বসতভিটা ছাড়া মাঠে কোনো জমি নেই। তাদের একপ্রকার ভূমিহীন বলা যায়।

শুধু চানাচুর তৈরি করে সংসার চালানো কঠিন বলে এর পাশাপাশি মুড়ি ও চিড়া বিক্রি করেন তারা। কেউ কেউ বাড়িতে গরু পালন করেন বলে তারা জানান।

যুগল চন্দ্র দেবনাথ জানান, তারার স্বামী-স্ত্রী ও দুই ছেলে মিলে সারাদিনে ৫০ কেজির মতো চানাচুর তৈরি করেন। দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও সংসারের তেমন উন্নতি করতে পারছেন না।

কথা হয় একই গ্রামের খগেন্দ্র নাথ দেবনাথের সঙ্গে। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। এখন স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে চানাচুর, বাদাম, মিষ্টি কেক ও দাঁতভাঙা (আঞ্চলিক এক প্রকার মিষ্টি) তৈরি করেন।

তিনি বলেন, এসব তৈরি করে আগের মতো আর লাভ নেই। তবে পেটের তাগিদে এ পেশা ধরে রেখেছেন। তার কথায় মত দিলেন একই পাড়ার চৈতন্য দেবনাথ, রবীন্দ্রনাথসহ কয়েকজন।

ওই গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা প্রবীণ স্বেচ্ছাসেবক পল্লী চিকিৎসক শেখ মজিবর রহমান জানান, চানাচুরপাড়ার বাসিন্দারা পড়ালেখায় তেমন আগ্রহী নয়। লেখাপড়ার চেয়ে সন্তানদের পারিবারিক পেশায় দক্ষ করে গড়ে তুলতেই তারা আগ্রহী। এজন্য শিশুরা একটু বড় হতেই কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়।

তিনি জানান, পাড়ার অদূরে হাইস্কুল ও কলেজ রয়েছে। অথচ চানাচুরপাড়ার অধিকাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় না।

এ বিষয়ে চানাচুরপাড়ার রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে জানান, জীবন ধারণ করাই তাদের কাছে সংগ্রামের। সেখানে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাবেন কিভাবে। পেটের জন্য ডাল-ভাত যোগাতেই তাদের হিমশিম খেতে হয় প্রতিনিয়িত।

চানাচুর তৈরির জন্য সরকারিভাবে অনুমোদন রয়েছে কি না এ বিষয়ে তিনি বলেন, বাপ-দাদারা বহুদিন ধরে এই কাজ করে আসছেন। কোনোদিন শুনিনি কাগজপত্র করা লাগে বা অনুমোদন নিতে হয়।

তিনি আরো জানান, মাঝেমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন আসে, তাদের কিছু অর্থ দিলে চলেও যায়। তবে কয়েকবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের বেশ বড় অংকের জরিমানা করা হয়েছে। সেই থেকে তাদের ব্যবসায় দুর্দিন যাচ্ছে।

এসব বিষয়ে নলডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুবীর দত্ত বাংলানিউজকে জানান, সোনাপাতিল গ্রামে চানাচুর কারখানা আছে শুনেছেন। কিন্তু সেসব কারখানা দেখার সুযোগ হয়নি।

তিনি বলেন, পুলিশের কোনো লোক সেখান থেকে টাকা নেয়, এটা তার জানা নেই। তবে পুলিশ পরিচয়ে চাঁদাবাজি প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শারমিন আক্তার জাহান বাংলানিউজকে জানান, সোনাপাতিল গ্রামের চানাচুরপাড়া সর্ম্পকে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি যোগদানের পর সেখানে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালায়নি।

তিনি বলেন, চানাচুর তৈরির জন্য বিএসটিআই অথবা সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কোনো অনুমতি না নেওয়া থাকলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালাতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩২ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০১৬
এসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।