ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

কালিঞ্জীপুঞ্জির সুউচ্চ গুচ্ছগ্রাম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৮
কালিঞ্জীপুঞ্জির সুউচ্চ গুচ্ছগ্রাম কালিঞ্জী পানপুঞ্জির প্রবেশমুখ। ছবি- বাংলানিউজ

মৌলভীবাজার: পুঞ্জির প্রবেশমুখের দীর্ঘ সিঁড়িতে উঠতে উঠতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার অরণ্যনির্যাসের লাইনগুলো মনে পড়ে গেলো। ‘তারপর যে-তে যে-তে যে-তে…/দেখি বনের মধ্যে/আলো-জ্বালা প্রকাণ্ড এক শহর/সেখানে খাঁ-খাঁ করছে বাড়ি/আর সিঁড়িগুলো সব/যেন স্বর্গে উঠে গেছে।

কালিঞ্জী পানপুঞ্জির ঘরে ঘরে খাসিয়া পানের মেলা।  ছবি- বাংলানিউজ  দীর্ঘ সিঁড়ি পেরুতে পেরুতে ক্লান্তির সঙ্গে দুলে উঠছে রোমাঞ্চিত অনুভূতি।

নিচে চলে যাচ্ছে একটু আগে পার হয়ে আসা চারপাশ। উপরের এই পৃথিবীকে তরতাজা অরণ্যবেষ্টিত পটভূমি হিসেবে খুঁজে পাওয়া গেল।

পুঞ্জি মানেই উচ্চতায় ঘেরা আবাসন। পাহাড়ঘেরা উঁচু আঁকা-বাঁকা পথের দু’পাশ। যেখানে অনেক বছর ধরে বসবাস করে চলেছে পাহাড়ি মানুষেরা। এমন কোনো পুঞ্জি নেই যেটা পাহাড় বা টিলায় অবস্থিত নয়।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খাসিয়া সম্প্রদায়ের গ্রামকে ‘পুঞ্জি’ বলা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ২৪টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এরমধ্যে খাসিয়া একটি। পুঞ্জির তরুণ অধিবাসী কারেকা।  ছবি- বাংলানিউজ  কালিঞ্জীপুঞ্জির এই গুচ্ছগ্রামটি স্বাভাবিক উচ্চতার থেকে বেশি। এই পুঞ্জির প্রবেশমুখেই রয়েছে দীর্ঘ সিঁড়ি।

সম্প্রতি কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে অবস্থিত এই পুঞ্জি ভ্রমণ করে দেখা গেল, বিকেল বেলার অবসরে পুঞ্জির প্রতিটি বাড়িতেই খাসিয়াপানের মেলা বসে। সারাদিন পুঞ্জিঘুরে পান সংগ্রহের পর বিকেলে পান বিক্রয় করা হয়। আড়তদাররা দূর-দূরান্ত থেকে এখানে পান কিনে নিতে আসেন। একটা একটা করে পানগুলো বেছে বেছে ‘কান্তা’ তৈরি করে রাখা হয়।  

নারী অধিবাসী সাহানা বাংলানিউজকে জানান, ‘দু’টি পানে এক ছলি। ১২ ছলিতে ১ কান্তা। ২০ কান্তায় ১ কুড়ি। একজন কামলা (শ্রমিক) প্রতিদিন গড়ে দুই কুড়ি বা ২ হাজার ৮৮০টি পান তুলতে পারেন। ১ কুড়ি পানের দাম পড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। ’ এখানে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে বলেও জানান সাহানা।

সুউচ্চ কোণ থেকে নিচের ঘরগুলোকে ক্ষুদ্র মনে হয়। নিজেদের উঠোনজুড়ে শিশুদের ক্রীড়ামুখর পরিবেশকে আরো ছোট বলে মনে হয়। পুঞ্জির পেছন দিকে পানির একমাত্র জলাধার হিসেবে রয়েছে একটি মুনোমগ্ধকর ছড়া। প্রতিমুহুর্ত এই ছড়া থেকে পড়ছে পানি। সারাদিন পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে দেখা হয়ে যায় কারেকা এর সঙ্গে। চোখে-মুখে তার তারুণ্যদীপ্ত হাসি। এই এলাকা সম্পর্কে কথা হয় এটা-ওটা। শুদ্ধ বাংলা না বলতে পারলেও ভাঙা ভাঙা শব্দগুলো বুঝিয়ে দেয় তার অনুভূতির মর্যাদাটুকু।

কারেকা তাদের পুঞ্জি সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের এই গ্রামে প্রায় ৮০টি পরিবার রয়েছে। সদস্য সংখ্যা প্রায় চারশত। আমরা পুরোপুরি পানচাষের উপর নির্ভরশীল। বছরে প্রায় ৫০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকার মতো আয় হয়ে থাকে। ’

পুঞ্জির শনবাঁশের ঘরগুলো।  ছবি- বাংলানিউজ

কারেকা বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা বসবাস করেন। কিন্তু আমাদের ভূমির অধিকার আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের আলাদা ভাষা এবং সংস্কৃতি রয়েছে। আমাদের ভূমি অধিকার প্রদানে এবং ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ’

তার কণ্ঠথেকে ক্ষোভের সঙ্গে বের হয়ে এলো, ‘উপজাতি’ তারপর ‘আদিবাসী’ এখন ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ এই শব্দগুলো দিয়ে আমাদের মাঝে বৈষম্য এবং বিভেদ তৈরি করে রাখা হয়েছে। ’

খাসিয়াদের এই গুচ্ছগ্রাম পরিভ্রমণের শুরুটা হয়েছিল উচ্চ সিঁড়ি ডিঙিয়ে। বিদায়টা হচ্ছে শেষ গোধূলির অস্তরাগে। নিভে আসা আলোর মাঝে। কালিঞ্জীপুঞ্জির এই সুউচ্চ গুচ্ছগ্রাম তখন সাঁঝের মায়ায় হিম শীতলতাপূর্ণ।

বাংলাদেশ সময়: ১১২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৮
বিবিবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।