ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

নকশি পাঞ্জাবি : মানিকগঞ্জে নীরব বিপ্লব

আশরাফুল আলম লিটন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১০
নকশি পাঞ্জাবি : মানিকগঞ্জে নীরব বিপ্লব

ঈদকে সামনে রেখে মানিকগঞ্জ জেলার প্রায় ৩০ হাজার নারীর ব্যস্ততার শেষ নেই পাঞ্জাবি-ফতুয়ার ভরাট (হাতে সেলাই) কাজ নিয়ে। এই গ্রামীণ নারীরাই তাদের নিপুণ হাতে পাঞ্জাবি আর ফতুয়ায় নকশা তুলে তা করে তুলছেন আরও বর্ণিল।

রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের নামকরা ফ্যাশন হাউসগুলোর লোভনীয় পাঞ্জাবি ও ফতুয়ার নেপথ্যের কারিগর এই নারীরাই।


এক দশকেরও বেশি কাল আগে মানিকগঞ্জে শুরু হয়েছিল পাঞ্জাবির গায়ে সুই-সুতা দিয়ে নকশা তোলার কাজ। সে সময় ব্র্যাক মানিকগঞ্জে তাদের আয়শা আবেদ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ট্রেনিং দিয়ে দুস্থ নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে এই সেলাই কাজের মাধ্যমে। ব্র্যাকের নিজস্ব সেলস সেন্টার আড়ংয়ের মাধ্যমে প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি হয় এই পাঞ্জাবির। তখন অধিকাংশ মানুষই সম্মানের দেখত না কাজটিকে। সময়ের সাথে সাথে অনেক শিতি তরুণ-তরুণী এ কাজে জড়িয়ে পড়ায় এখন সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে।  


শুরুর দিকে যেসব নারী সারাদিনের ঘরের কাজ শেষে প্রচুর অবসর পেত, তারা বাড়তি আয়ের আশায় হাতে তুলে নেয় সুই-সুতো। কেউ ব্যক্তিগতভাবে, কেউ সম্মিলিতভাবে, আবার কোথাও এনজিও কিংবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু করে পাঞ্জাবির ভরাট কাজসহ ব্লক, বাটিক ও অন্যান্য কাপড়ের কাজ। এভাবেই গত এক দশকে এই নকশার কাজে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে পুরো মানিকগঞ্জ জেলায়। এখন প্রায় ৩০ হাজার নারী সারা বছরই জড়িত থাকেন এ কাজে।


‘জননী ক্রাফটস অ্যান্ড ফ্যাশন’-এর স্বত্বাধিকারী গড়পাড়ার রফিকুল ইসলাম পরান জানান, তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঘরে বসে সারা বছর কাজ করেন ৮ হাজার মহিলা। শিতি যুবক মাসুদ, মিল্টন ও সুমন তিন বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছেন ‘নকশী’ নামের হ্যান্ডি ক্রাফটস প্রতিষ্ঠান। মানিকগঞ্জ শহরে এখন তাদের  বিলাসবহুল দুটি শো রুম। ২ হাজার নারী নিয়মিত পাঞ্জাবি ভরাটের কাজ করে তাদের প্রতিষ্ঠানে। নকশীর পাঞ্জাবির সুনাম এখন সারা দেশে। এ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে এসেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল। আয়শা আবেদ সেন্টারের শ্যামল দাস বলেন, তাদের এখানে কারখানায় ৫০০ ও গ্রামে গ্রামে ৫ হাজার নারী কাজ করেন।


মানিকগঞ্জের পাঞ্জাবি যেসব বিখ্যাত ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানে শোভা পায়,  তার মধ্যে আছে ক্রে-ক্রাফট, অঞ্জন’স, বাংলার মেলা, রঙ, আবর্তনা, আড়ং, অন্যমেলা, ওজি, বাংলার রং, তুলি, শেকড়, ড্রিম ফ্যাশন ওয়্যার, ডাইজেন, নোঙর, ঋতুবৈচিত্র্য, নান্দনিক, দেশ কারুপণ্য, খাদিঘর, মনোরমসহ বেশ কিছু ফ্যাশন হাউস।  


 ঈদের এই সময়ে দেখা গেল, নারীরা কখনও একত্র হয়ে কোনো একটি ঘরে বা শেডে, আবার কেউ কেউ খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে বারান্দায়, উঠানের গাছের নিচে ভরাট কাজে ব্যস্ত। এই দৃশ্য সারা বছরের হলেও, এখন তাদের ব্যস্ততা অনেক বেশি। এই কর্মীদের অধিকাংশ গৃহিণী। সংসারের নিত্যকাজের পর এই কাজ করে তারা বাড়তি আয় করেন। তবে তাদের দাবি, পরিশ্রমের তুলনায় তারা মজুরি কম পান। একটি পাঞ্জাবিতে ভরাট কাজে জনপ্রতি পাওয়া যায় ৭০ থেকে ১০০ টাকা। অথচ একটি পাঞ্জাবির কাজ শেষ করতে তাদের ৪-৫ দিন লেগে যায়। প্রতিদিন গড়ে তারা ৬-৭ ঘণ্টা কাজ করেন।  

মানিকগঞ্জ থেকে পাঞ্জাবি সরবরাহকারীদের দাবি, ভরাট ও হাতের কাজের নকশা করা পাঞ্জাবির শতকরা ৭০ ভাগই মানিকগঞ্জ থেকে সরবরাহ করা হয়। তারা জানান, রেশমগুটি থেকে এন্ডি কটন নামে এক প্রকার সুতা থেকে মানিকগঞ্জে পাঞ্জাবির কাপড় তৈরি হয়, যা দেশের কোথাও তৈরি হয় না। ঈদ উপলে মানিকগঞ্জ থেকে এবার হাতের সেলাই ও  নকশা করা প্রায় ২ লাখ পাঞ্জাবি ও ফতুয়া সরবরাহ করা হয়েছে।   সরকারি সহযোগিতা, শো রুমগুলোর আরো আন্তরিকতা, সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তির ব্যবস্থা থাকলে এ শিল্পকে আরো উন্নত করা ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব বলে মনে করেন এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২৪৫, আগস্ট ২৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।