ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গল্প

কাদের মোল্লার ফাঁসি ও এরদোগানের ভ্রাতৃপ্রেম!

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩
কাদের মোল্লার ফাঁসি ও এরদোগানের ভ্রাতৃপ্রেম! ছবি: সংগৃহীত

এবছরের ১৫ বা ১৬ ফেব্রুয়ারি হবে। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তখন উত্তাল।

স্থায়ী ক্যাম্প করে দেশের জন্য তারুণ্যের চেতনাকে যতটা সম্ভব তুলে ধরার চেষ্টা করছে বাংলানিউজ। এক বিকেলে হঠাৎই বিদেশি এক সাংবাদিক এলেন বাংলানিউজের ক্যাম্পে। হাতে একটি স্টিকের মাথায় লাগানো আধুনিক ক্যামেরা। বয়সে তরুণ। ব্যস্ত থাকায় বেশ খানিকটা অপেক্ষা করলেন। জানলাম তুরস্ক সরকারি টেলিভিশনের ঢাকা করেসপন্ডেন্ট তিনি। কৌতূহল দেখালাম। আনন্দিতও হলাম এই ভেবে যে বিদেশি সাংবাদিকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ৪২ বছর পরেও নতুন প্রজন্মের এই বিস্ময়কর জাগরণকে তুলে ধরতে চায়।

সাংবাদিকটি বললেন, আমি শুনেছি তুমি বেশিরভাগ সময়ই এখানে থাকছো... তুমি কি আমার ক্যামেরার সামনে একটু কথা বলবে। হুট করেই রাজি হওয়া যায় না। অফিসিয়াল কিছু নির্দেশনাও রয়েছে। জানতে চাইলাম, কি নিয়ে কথা বলতে চাও তুমি? তরুণ সাংবাদিক বললো, তার কাছে তথ্য আছে এখানে যারা আন্দোলন করছে তারা কিছু খারাপ কাজে লিপ্ত। রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লাম। ১০ দিনেরও বেশি সময় ধরে প্রতিটি মুহূর্ত চোখ খোলা রেখে গণজাগরণমঞ্চের রিপোর্ট করছে বাংলানিউজ। এমন কথা তো শুনিনি। অপমান করাটুকু বাকি রেখে দ্রুত এই সাংবাদিককে মানে মানে বিদায় দিলাম এই বলে, তুমি যা বলছো তা মিথ্যা। এমন কোনো ঘটনাই এখানে ঘটেনি। এটি যারা ছড়াচ্ছে তারা গণজাগরণমঞ্চের ক্ষতি চায়। পরে এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি এই সাংবাদিককে এড়িয়ে চলার এবং একেবারেই পাত্তা না দেওয়ার নির্দেশ দেন। নাছোরবান্দা তরুণটি এরপরেও দুই-তিনবার দেখা করতে আসে কিন্তু পাত্তা পায় নি।
 
সেদিনের সেই ঘটনার যোগসাজশ পাওয়া যাচ্ছে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেফ তাইয়েপ এরদোগানের আচরণে। এরদোগান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা-তদবির করছেন নানাভাবে। সম্প্রতি কাদের মোল্লার ফাঁসি ঠেকাতে শেষ চেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি শেষ মুহূর্তেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে টেলিফোন করেছিলেন। ছিলেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সক্রিয় ও বিভিন্নমুখি যড়যন্ত্রে লিপ্ত।

কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অনুরোধ উপেক্ষা করেছেন। বরং দৃঢ়চিত্তে অপেক্ষা করছিলেন জেলখানা থেকে ফাঁসি কার্যকর করার খবরটি পাওয়ার জন্য।

কিন্তু এরদোগান কি থেমেছেন? না। কারণ কাদের মোল্লার ফাঁসির পর গত শুক্রবার দেশটির ইজমির প্রদেশে একটি সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে এরদোগান বলেছেন, কাদের মোল্লার ফাঁসি, তার ভাষায়, একটি বড় ভুল, যার জন্য ইতিহাস বাংলাদেশকে ক্ষমা করবে না। এরদোগানের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে তার ডেপুটিদের মধ্যেও। উপ-প্রধানমন্ত্রী বেকির বোজদাগ বলেছেন, বাংলাদেশে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও আইন ভুলুণ্ঠিত হয়েছে।

এর আগে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরপরই তুরস্ক সরকার এক বিবৃতিতে নিন্দা জানিয়ে বলে, ‘আন্তর্জাতিক সব মহলের উদ্বেগ ও পরামর্শ উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সরকার এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। আমরা কঠোরভাষায় এই মৃত্যুদণ্ডের নিন্দা জানাচ্ছি। আল্লাহ কাদের মোল্লাকে ক্ষমা করবেন। ’

ইজমিরের সমাবেশে এরদোগান বাংলাদেশে যারা এই ফাঁসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে তাদের প্রতি রাজনৈতিক এই লড়াই থামিয়ে না দেওয়ার আহ্বান জানান।

এমন সব উস্কানিমূলক বক্তব্য একের পর এক দিয়ে যাচ্ছেন তুর্কি সরকার ও এর প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা একটি দেশের জন্মলাভের চেতনার, দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান নিয়ে গুটি কয়েক যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচাতেই তৎপর তুরস্ক।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের বিরুদ্ধে এমন অবস্থান নেওয়ার জবাবও তুরস্ককে দিতে হবে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে তুরস্ককে একটি হাতিয়ার হিসেবে জামায়াত বেছে নেয় আরও আগেই। ২০১২‘র ডিসেম্বরে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল জামায়াত নেতাদের যুদ্ধপরাধের বিচার তথা ফাঁসি থেকে রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি পাঠান।

এছাড়াও তুরস্কের একটি বেসরকারি প্রতিনিধিদলও সেসময় বাংলাদেশে সফর করে যুদ্ধপরাধীদের বিচার ট্রাইবুন্যালের কার্যক্রম নিয়ে অযাচিত আগ্রহ দেখায়। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি না নিয়েই ওই প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশে আসে এবং এ ধরনের কাজে লিপ্ত হয়। বিষয়টি নিয়ে তখনই ওঠে সমালোচনার তীব্র ঝড়।

একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য সে প্রশ্নও অনেক আগেই উঠেছে। তখন সরকারের পক্ষ থেকে তুরস্কের রাষ্ট্রদুতকে ডেকে এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলে দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে যেন এরকম ঘটনা আর না ঘটে।

বাংলাদেশে বিচারের মাধ্যমে একজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিরুদ্ধে মানবতার নামে অবস্থান নেয় তুরস্ক। কিন্তু দেশটির নিজের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে মানবতাবিবর্জিত একটি দেশ এই তুরস্ক। গত শতাব্দীতে বিশ্বে যতগুলো গণহত্যার ঘটনা ঘটে তার প্রথমটিই ঘটে তুরস্কে। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে এই দেশে ১৫ লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করা হয়। যার বিচার এখনো হয়নি। তারও আগে ১৮৯৫ সালে তুর্কিরা হত্যা করে তিন লাখ আর্মেনীয়কে। ১৯০৯ সালে এক দিনে নিহত হয় ৩০ হাজার আর্মেনীয়।

ইতিহাসবেত্তারা আর্মেনীয়দের হত্যার সঙ্গে বাংলাদেশে ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গণহত্যার ধরনগত মিল খুঁজে পান। আর্মেনীয়দের মধ্য থেকে ২৫০ জন বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়েছিলো। ১৯৩৭-৩৮ এই দুই বছরে তুরস্ক সরকার ৫০ থেকে ৭০ হাজার কুর্দিকে হত্যা করেছে। ১৯৯৯ সালে তুরস্ক আন্তর্জাতিক মত উপেক্ষা করে ফাঁসি কার্যকর করে কুর্দি বিদ্রোহী নেতা আবদুল্লাহ ওকালানের। আর কুর্দিদের দমনে তুরস্কের হামলা এখনো নৈমিত্তিক বিষয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা ৩০ লাখ বাঙালিকে খুন করে। আর তাতে সহায়তা করে কাদের মোল্লার মতো রাজাকার-আলবদররা। এমন ইতিহাসকে অস্বীকার করা তুরস্কের মতো দেশেরই সাজে।

এরদোগানের জামায়াত-প্রেমের কারণও অনেকের জানা। তুরস্কে তার দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি আসলে বাংলাদেশের জামায়াতের আদলে গঠিত একটি দল।

কাদের মোল্লার ফাঁসির পর রিসেফ তাইয়েপ এরদোগানের ঘৃণ্য প্রতিক্রিয়া সে কারণেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেওয়া। ১৯৭১ সালের পর থেকে দেশের মানুষ যাদের বিচার চেয়ে আসছে তাদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবিরোধী কাজ করছে তুরস্ক।

প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কি এ বিষয়ে সজাগ? কাদের মোল্লার ফাঁসির পর এ পর্যন্ত অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগের কথা শোনা যায়নি।

এদিকে রিসেফ তাইয়েপ এরদোগান অবশ্য নিজ দেশেই বিপদে রয়েছেন। দুর্নীতির তদন্তের অংশ হিসেবে তুরস্কের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এরদোগান মন্ত্রিসভার তিন প্রভাবশালী সদস্য স্বরাষ্ট্র, অর্থ ও পরিবেশমন্ত্রীর তিন ছেলেসহ ৫২ জনকে গ্রেফতার করেছে।

সেটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এরদোগান ও তার সরকারের ভ’মিকার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

পাকিস্তানের সংসদে কাদের মোল্লার ফাঁসিতে শোক প্রস্তাব উত্থাপনের পর সরকারের শক্ত ভ’মিকা দেশবাসী দেখেছে। দেশটির হাই কমিশনারকে তলব করে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে।
বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তীব্র ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। তুরস্কের বিরুদ্ধেও সরকারের এমন একটি কঠোর অবস্থান থাকবে বলে সবার প্রত্যাশা।

দেশটির সকল সুবিধা বন্ধ করে দিতে হবে সরকারকে। বাংলাদেশ থেকে ইস্তাম্বুলে যাওয়ার জন্য সরাসরি কোনো ফ্লাইট না চললেও এই দেশটির টার্কিশ এয়ারলাইন্স যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালিয়ে ব্যবসা হাতিয়ে নিচ্ছে। টার্কিশ হোপ নামে স্কুল খুলে, হোটেল-রেস্টুরেন্ট খুলে ব্যবসা করছে। এগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি দেশটি থেকে আমদানিও বন্ধ করে দিতে পারে সরকার।

আর দেশটির একাধিক সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশে কাজ করছে। তারা কে কোন পারপাসে কাজ করে যাচ্ছে সেদিকটিও যেনো সরকার এড়িয়ে না যায় সে প্রত্যাশা অবশ্যই থাকবে।

বাংলাদেশ সময় ১৩৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩
এমএমকে/সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ