ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

‘ই-সিগারেটে’ ক্ষতির মাত্রা ধূমপানের থেকেও বেশি

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০২ ঘণ্টা, মে ৪, ২০২৩
‘ই-সিগারেটে’ ক্ষতির মাত্রা ধূমপানের থেকেও বেশি

ঢাকা: সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ই-সিগারেটের আবির্ভাব। ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস-এইচটিপি) বর্তমান তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।

লিথিয়াম ব্যাটারির মাধ্যমে কার্টিজে থাকা নিকোটিন, স্বাদ ও গন্ধ-মিশ্রিত ই-লিকুইড ও প্রপিলিন গ্লাইকল নামক রাসায়নিক পুড়িয়ে মস্তিষ্কে ধূমপানের মতো অনুভূতির সৃষ্টি করে ই-সিগারেট।  

অনেকে সিগারেটের বিকল্প হিসেবে কিংবা সিগারেট ছাড়তে ই-সিগারেট গ্রহণ করেন। গ্রহণকারীরা বলছেন, ধূমপানে আসক্তি কমাতে ই-সিগারেট তুলনামূলক ভালো সমাধান হতে পারে। কিন্তু গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা।  

ই-সিগারেটের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে শ্যামলী ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, সিগারেটের আসক্তি কমাতে কেউ কেউ ই-সিগারেট গ্রহণ করে থাকেন। তবে এটার প্রতিও যদি আসক্তি তৈরি হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করলে সাধারণ সিগারেটের মতই বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেবে।

ই-সিগারেটের ক্ষতির বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশ্বের অনেক দেশ এসব পণ্য নিয়ন্ত্রণ এবং বন্ধ করতে ইতোমধ্যে শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসের আবির্ভাবের পর থেকে বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের পদ্ধতি ও ব্যবহার, বিপণন কৌশল, তামাকাসক্তি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

ই-সিগারেট এবং ভ্যাপিংয়ের ধোঁয়ায় নিকোটিন এবং অন্যান্য বিষাক্ত কেমিক্যাল থাকে, যা ব্যবহারকারী এবং এর পরোক্ষ শিকার উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো ব্যবহারকারীর ফুসফুসের সংক্রমণ ও অসুস্থতা বাড়ায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়।

অতিসম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত রিপোর্ট অন গ্লোবাল টোব্যাকো এপিডেমিক ২০২১’ থেকে জানা যায়, ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেমস (ইএনডিএস) অর্থাৎ ই-সিগারেটসহ সব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টকে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো আসক্তিসহ নানাবিধ স্বাস্থ্যক্ষতি তৈরি করে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা এসব পণ্যে আসক্ত তাদের মধ্যে সিগারেট শুরু করার সম্ভাবনা দ্বিগুণেরও বেশি। ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি প্রোডাক্ট তামাকপণ্য ব্যবহারের ‘গেটওয়ে’ হিসেবেও কাজ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট ২০১৬ এ ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সব পণ্যকে ‘অনিরাপদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

কৌশলী প্রচার-প্রচারণা, উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ই-সিগারেটের জনপ্রিয়তা দিন দিন ব্যাপকভাবে বাড়ছে।

তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বলেন, ই-সিগারেটের ব্যবহার আগে শুধুমাত্র রাজধানী বা শহরগুলোতে দেখা যেত। সেটা এখন উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়েও পৌঁছেছে। আমরা চাই দ্রুত আইন করে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হোক।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাজারে ১৬ হাজার ধরনের স্বাদ ও গন্ধযুক্ত (ফ্লেভার) ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে এসব পণ্যের ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুল পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। হাই-স্কুল পড়ুয়া তরুণদের ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন সুগন্ধযুক্ত ই-সিগারেট ব্যবহার করে, কারণ এসব স্বাদ বা গন্ধ তাদের পছন্দ।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ফুসফুসজনিত রোগে ভর্তি হওয়া মোট দুই হাজার ৮০৭ জন রোগীর মধ্যে ৬৮ জনের মৃত্যুর সঙ্গে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিংয়ের যোগসূত্র থাকার কথা নিশ্চিত করেছে।  

বাংলাদেশেও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসের ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এসব পণ্যের ব্যবহার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়লেও এগুলো নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধে বাংলাদেশে কোনো আইন বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

ই-সিগারেটের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের লাইন ডাইরেক্টর অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, ই-সিগারেট পুরোটাই ক্ষতিকর। সাধারণ সিগারেট থেকেও এর ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি, এটা বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত। এতে টক্সিসিটির পরিমাণ আরও বেশি থাকে, তাই ক্ষতিও বেশি হয়।

তিনি আরও বলেন, এটা অবশ্যই আমাদের দেশে নিষিদ্ধ করা উচিত। এটা যেন আমাদের দেশে কেউ বিক্রয়, বিপণন ও ব্যবহার করতে না পারে, সেই বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলে মতামত দেওয়া হয়েছে।

এই বিষয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার বাংলানিউজকে বলেন, ই-সিগারেটের বিষয়ে বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে কিছু উল্লেখ করা নেই। তবে খসড়া সংশোধনীতে ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং), হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ এ ধরনের সব পণ্য নিষিদ্ধের প্রস্তাব করেছি। ই-সিগারেট যেহেতু বাংলাদেশে তৈরি হয়না, বিদেশ থেকে আসে, এই জন্যে আমরা প্রস্তাবে রেখেছি, এটা নিষিদ্ধ করা হোক। খসড়া সংশোধনী বর্তমানে ক্যাবিনেট ডিভিশনে পাঠানো হয়েছে।

আমাদের পাশের দেশ ভারত ইতোমধ্যে ২০১৯ সালে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এছাড়া শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বর্তমানে পৃথিবীর ৩২টি দেশ এসব পণ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় মঙ্গলবার (০২ মে) অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মার্ক বাটলার দেশটিতে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বলে জানান। দেশটিতে ই-সিগারেট এতটাই সহজলভ্য যে এটিকে ‘মহামারি’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

ই-সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট (এইচটিপি) নিষিদ্ধ করা হলে তরুণ এবং কিশোর বয়সীদের ধূমপানে আসক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে, যা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে সহায়তা করবে বলেই আশাবাদ ব্যক্ত করছেন জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০২৩
আরকেআর/এসআইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।