আসছে ঈদ-উল ফিতর, প্রস্তুত হচ্ছেন দেশবাসী। ঈদের রসনা বিলাসে আবশ্যিক খাদ্যপণ্য হচ্ছে সেমাই।
বিশেষ করে ঈদ এলেই ভেজাল সেমাই তৈরি ও বিকিকিনির জমজমাট ব্যবসা শুরু হয়ে যায়, এবারও ঈদকে কেন্দ্র করে চলছে এ অনৈতিক কার্যক্রম। এ নিয়ে শঙ্কায় ঢাকা নগরবাসীও।
বাংলানিউজ ভেজাল সেমাই তৈরির উৎসমূল থেকে শুরু করে কারখানা, বাজার ও ভোক্তাদের মাঝে এ নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছে। আমাদের তিন স্টাফ করেসন্ডেন্টের সে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে তিন পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। প্রতিবেদনের তৃতীয় ও শেষ পর্ব পড়ুন-
ঢাকা: রাজধানীতে অস্বাস্থ্যকর ও বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে লাচ্চা ও লালচে রঙের স্টিক সেমাই। আর অনুমোদনহীন কারখানাগুলোতে সেমাইয়ের সঙ্গে মেশানো হয় কাপড়ে বাবহৃত বিষাক্ত রঙ। রঙের এ ব্যবহার মানুষের পাকস্থলিতে গিয়ে ভবিষ্যতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে।
বাংলানিউজের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে রাজধানীর লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, যাত্রাবাড়ী ও বেড়িবাঁধ এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য সেমাই তৈরির কারখানা।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) অনুমোদন ছাড়াই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, কৃত্রিম রঙ ও বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব সেমাই। নামি-দামি ব্র্যান্ডের প্যাকেটে এগুলো বাজারজাত করা হচ্ছে।
কাপড়ে ব্যবহৃত কৃত্রিম রঙ সেমাইয়ে ব্যবহার করায় ভবিষ্যতে পাকস্থলির ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে রাজধানীসহ দেশবাসী।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুদীপ রঞ্জন দেব বাংলানিউজকে বলেন, সেমাইয়ে ব্যবহৃত কৃত্রিম কাপড়ের রঙ ক্যারসিনোজেনিক। মানবদেহে প্রবেশ করে এগুলো পাকস্থলিতে আক্রমণ করে, যা ক্যারসিনোজেন বা পাকস্থলি ক্যান্সারের সহায়ক।
এছাড়াও রঙ মাখানো এ সেমাই মানবদেহে প্রবেশ করলে টক্সিন ইনবিউজ হেপাটাইটিস বা লিভারের জটিল রোগ হতে পারে। তবে বিষাক্ত এ সেমাই খেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একিউট গেস্ট্রো এন্টেরাইটিস বা শরীরে লবনের ঘাটতি হয়ে পানিশ্যূন্যতা দেখা দিতে পারে বলেও জানান সুদীপ রঞ্জন দেব।
সরেজমিনে কামরাঙ্গীরচরে অনুসন্ধানে দেখা যায়, নর্দমার পাশে মাটিতে কাঁচামাল প্রক্রিয়া করে কোনো হিটার ছাড়াই লাচ্চা সেমাই বাইরে খোলা আকাশের নিচে শুকানো হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক (আরপি) ডা. রাজ দত্ত বাংলানিউজকে বলেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই তৈরির কারণে এতে রোগ-জীবাণু প্রবেশ করে। আর এ সেমাই খেলে তাৎক্ষণিকভাবে পেটে ব্যথা ও বমি হতে পারে।
নিরাপদ খাদ্য আইন’২০১৩ অনুযায়ী, এ ধরনের বেকারিপণ্য তৈরির জন্য কর্মচারীদের বিশেষ পোষাক এবং হাতে গ্লোভস পরে কাজ করতে হবে। তবে বাংলানিউজের সরেজমিন অনুসন্ধানে কামরাঙ্গীরচরের প্রায় সব কারখানার শ্রমিকদের বস্ত্রহীনভাবে কাজ করতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক সুদীপ রঞ্জন দেব বলেন, এভাবে খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে খাদ্যের মান হ্রাস পায়, হাত ও শরীরের জীবাণু সেমাইয়ে লেগে থাকে যা মানবদেহে প্রবেশে তাৎক্ষনিকভাবে অস্বস্তিবোধের পাশাপাশি পেটের পীড়া ও ডায়রিয়া হতে পারে।
এদিকে সম্প্রতি বিএসটিআই ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের যৌথ অভিযানে সেমাইয়ে উৎপাদিত উপকরণের অনুপাত নিয়েও গরমিল দেখা গেছে। যা দীর্ঘমেয়াদে মানবদেহের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সাধারণত সেমাই তৈরিতে মূল উপকরণ ময়দার সঙ্গে ৭০ শতাংশ সয়াবিন তেল এবং ৩০ শতাংশ বনস্পতি বা ডালডা দিতে হবে। তবে বনস্পতির দাম কম থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেলের পরিবর্তে সেমাই তৈরিতে শতভাগ ডালডা ব্যবহার করছেন। শুধু তেলেই থেমে থাকেননি ব্যবসায়ীরা। সেমাইকে দীর্ঘদিন মচমচে রাখতে মোটরযানে ব্যবহৃত পোড়া মোবিল ব্যবহার করার তথ্যও জানিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের পরিচালনাকারীরা।
এ বিষয়ে ডা. রাজ দত্ত বলেন, যদিও আমরা নিয়মিত সেমাই খাই না, তবে অতিরিক্ত ডালডা গ্রহণের ফলে রক্তে কোলেস্টেরল জমে হার্টের সমস্যাসহ একাধিক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
খাবারে বিষাক্ত রঙ ব্যবহার নিয়ে জাপান, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি ও নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ড একাধিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গবেষণায় রঙযুক্ত খাবার ‘লিংকস টু ক্যান্সার’ বা ‘ক্যান্সারের সঙ্গে সংযোগ’ ঘটায় বলে এসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে শুধু ক্রেতারাই নন, যারা খাবারে বিষাক্ত এসব কেমিক্যাল মেশান, তাদেরও নানা রোগ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ঢামেকের সহযোগী অধ্যাপক সুদীপ রঞ্জন। তিনি বলেন, যারা সেমাইয়ে রঙ মেশান, তাদের হাতেও ডার্মাটাইটিস বা চর্মরোগের বিস্তার ঘটবে।
** বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ
** নামি ব্র্যান্ডের প্যাকেটে ‘বেনামি’ সেমাই!
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫০ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৪