ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ডালডায় ১০ গুণের বেশি চর্বি, ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

পাঠান সোহাগ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০
ডালডায় ১০ গুণের বেশি চর্বি, ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

ঢাকা: বাংলাদেশে তৈরি ডালডা ও বনস্পতি ঘিয়ের মধ্যে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১০ গুণের বেশি ট্রান্সফ্যাট বা চর্বি পাওয়া গেছে। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এই চর্বি হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডায়বেটিস রোগের জন্য দায়ী।

জানা গেছে, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পিএইচও (পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল) ব্র্যান্ডগুলোর (ডালডা বা বনস্পতি ঘি) নমুনার ৯২ শতাংশেই এই অধিক মাত্রার চর্বি (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশকৃত ২ শতাংশ মাত্রার চেয়ে এটা অনেক বেশি।

প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ডব্লিউএইচওর সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি।  

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডগুলোর নমুনা বিশ্লেষণ করে এই ফল পেয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এনএইচএফএইচআরআই) গবেষকরা। এই গবেষণায় সহায়তা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন ও গবেষণা উপদষ্টো আবু আহাম্মদ শামীম।

গবেষকরা জানান, পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও) বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামে অধিক পরিচিত। বাসা-বাড়িতে ব্যবহার না হলেও পিএইচও বেকারি ও অন্যান্য বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা খাবারে ব্যবহৃত হয়। গবেষণার আওতায় ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বেকারি এবং রেস্তোরাঁয় খাবার তৈরিতে সচরাচর ব্যবহার হয় এমন চারটি শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডের তালিকা তৈরি করা হয়।  

এই তালিকার ভিত্তিতে পাইকারি বাজার (হোলসেলার) এবং পিএইচও উৎপাদনকারী কারখানা থেকে ব্র্যান্ডগুলোর মোট ২৪টি নমুনা সংগ্রহ করে পর্তুগালের ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট ফুড কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির সহায়তায় সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড বা টিএফএ মাত্রা নির্ণয় করা হয়। পিএইচও নমুনা বিশ্লেষণ করে প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।

এছাড়া একই ব্র্যান্ডের পিএইচও নমুনার মধ্যে ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতির ব্যাপক তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। যেমন, একটি পিএইচও ব্র্যান্ডের ৭টি নমুনায় শুণ্য দশমিক ৬৯ গ্রাম থেকে শুরু করে ১৪ দশমিক ৫ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।  

বাংলাদেশে পিএইচও বা ডালডা সাধারণত ভাজা-পোড়া স্ন্যাকস ও বেকারিপণ্য তৈরি এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের খাবারে ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাট উপাদানের উপস্থিতি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য-উপাত্ত না থাকার কারণেই এই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়।

তাদের দাবি, চরম ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য, সবধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা প্রতি ১০০ গ্রাম ফ্যাটে ২ গ্রাম নির্ধারণ করাতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের উচিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ অনুসরণ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।  

গবেষকদলের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, “এই গবেষণা প্রমাণ করে, বাংলাদেশে অনেক পণ্যেই বিপজ্জনক মাত্রায় ট্রান্সফ্যাট রয়েছে, যা অধিক হারে হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের উচিত হবে সব ধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাবারে ট্রান্স ফ্যাটি এসিডের সর্বোচ্চ পরিমাণ মোট ফ্যাট বা তেলের ২ শতাংশ পর্যন্ত সীমিত করে নীতিমালা প্রণয়ন করা। ”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, “বাংলাদেশে বিরাজমান হৃদরোগজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে পিএইচওর ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা ২ শতাংশে নামিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। এই পদক্ষেপের মাধ্যমেই বাজারজাত প্রসেস খাবারে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ” 

জানা যায়, ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল (পাম, সয়াবিন ইত্যাদি) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেশন করা হলে তেল তরল অবস্থা থেকে মাখনের মতো অর্ধ-কঠিন মারজারিন বা কঠিন ডালডা বা বনস্পতি উৎপন্ন হয়, এই প্রক্রিয়ায় ট্রান্সফ্যাটও উৎপন্ন হয়।  

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ এবং স্বল্প স্মৃতিহানিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

ডব্লিউএইচওর হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ সার্বিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ট্রান্সফ্যাটের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করে ডব্লিউএইচও ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ থেকে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলকে অগ্রাধিকার হিসেবে নির্ধারণ করেছে।

গবেষণা কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানকারী গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) বাংলাদেশ প্রধান মুহাম্মদ রূহুল কুদ্দুস বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসরণ করে ভারত, থাইল্যান্ড, ব্রাজিলসহ অনেক দেশ খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা করেছে। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই গবেষণার ফলাফল ট্রান্সফ্যাট বিষয়ক নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। ” 

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০
পিএস/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।