নীলফামারী ঘুরে: নীলসাগর! পানি সমুদ্রের মতো নীল নয়, নেই সাগরের উত্তাল ঢেউ; নিম্নচাপের প্রভাবে গর্জে ওঠে না এটি, ভয় নেই জলোচ্ছ্বাসেরও। এরপরও এর নাম সাগর, নীলসাগর।
বলছি, উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধ জেলা নীলফামারীর বেশ পরিচিত পর্যটন স্পট নীলসাগর দিঘীর কথা। নীলফামারী-দেবীগঞ্জ সড়কের পাশে অবস্থিত বিশাল দিঘীটির কোমল বাতাস আর শান্ত জল যেনো নিমিষেই ক্লান্তি দূর করে দেয় কোনো পথিকের। ভুলিয়ে দেয় মধ্যবিত্ত জীবনের নানা টানাপোড়েনও!
নিত্যদিনই ঐতিহ্যবাহী দিঘীটি দেখতে ছুটে আসেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। কোনো পথিকও পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক পলক দেখে এর শানবাঁধানো ঘাটে হাত ভিজিয়ে যান। অনেকে ছুটে আসেন পরিবার-পরিজন নিয়েও।
আরও পড়ুন- দু’মাসি ভাদ্রে বৃষ্টির খেলা । । স্বপ্নে পাওয়া সত্যপীরের গান । । বিলাসী মহেন্দ্রের সাক্ষী হাওয়াখানা
নানান প্রজাতির গাছে ঘেরা পুকুরটির অবস্থান তিস্তা-যমুনেশ্বরী বিধৌত নীলফামারী জেলা শহর থেকে ১৪ কিলোকিটার দূরে। শহরের উত্তর-পশ্চিমের গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাংগা মৌজায় এর অবস্থান। শুরুতে বিন্না বা বিরনা দিঘী হিসেবে প্রচলিত থাকলেও আশির দশকে নীলসাগর নাম পায় দিঘীটি।
স্থানীয় লৌককথা মতে, প্রাচীন ভারতের রাজা বিরাটের আমলে গোড়গ্রামে অসংখ্য গরু পোষা হতো। এসব গরুকে পানি খাওয়ানোর সুবিধার্থে অষ্টম শতাব্দীতে দিঘীটি খনন করা হয়।
তখন থেকে এটি বিরাট দিঘী হিসেবে পরিচিতি পায়। কখনও বিরনা বা বিন্না দিঘী নামেও ডাকা হয়েছে বলে জানান দিঘীর পাড়ের মন্দিনের পুরোহিত অমরেশ বর্মণ।
আরও পড়ুন- গাঁয়ের বধূর মনের কথা মেয়েলী গীত । । ‘নিজ সংস্কৃতি নিয়ে হীনমণ্যতা বিলুপ্তির কারণ’ । । দাড়িয়াবান্ধা নেই, বিলুপ্ত বৌচি
তার ভাষ্য, আগে এটা বিন্না দিঘী নাম ছিলো। শুনেছি রাজা বিরাটের মেয়ে বিন্নাবতীর নামে বিন্না দিঘী ডাকা হতো। এক পর্যায়ে এটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
‘পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে নীলফামারীর তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ও অবসরপ্রাপ্ত সচিব এম এ জব্বার এখানে বেড়াতে আসেন। তিনি স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা করে দিঘীকে পর্যটন কেন্দ্র করার পদক্ষেপ নেন। ’
‘নীলসাগর’ নামকরণ প্রসঙ্গে আশি বছর বয়সী অমরেশ বলেন, এসডিও সাহেব প্রস্তাব করেন-বিন্না দিঘী, এটা হতেই পারে। এটাকে নীলফামারীর ‘নীল’ আর আয়তন বিশাল হওয়ায় ‘নীলসাগর’ রাখা হয়।
বর্তমানে ঢাকা-চিলাহাটি রুটে ‘নীলসাগর’ নামে একটি ট্রেনও চলাচল করে।
স্থানীয় প্রশাসন জানায়, ২১ দশমিক ৪৪৯ হেক্টর এলাকা জুড়ে দিঘীটির গভীরতা স্থানভেদে ৭ থেকে ১২ মিটার। এর চারদিকে পাড়ের পাশে ইটের দেয়াল রয়েছে। রয়েছে নানা প্রজাতির ফুল ও ফলজ গাছের সমাহার।
প্রবেশপথের কারুকার্যময় গেটটি রাজা বিরাটের সময়ই তৈরি বলে প্রচলিত। আরও পড়ুন- বিলুপ্তির পথে ভাওয়াইয়ার ‘দোতরা’ । । লোকজ সংস্কৃতিতে চলে পানের আপ্যায়ন । । বাদল দিনে নেই বৃষ্টির খনা
তবে দেখে মনে হয়েছে, এতে বেশ কয়েকবার মিস্ত্রির হাতের ছোঁয়া লেগেছে!
দিঘীটির পূর্ব পাড়ে একটি মন্দির রয়েছে। যেখানে প্রতি প্রহরেই পূজা-অর্চনা হয়। এছাড়া অমাবস্যা পূর্ণিমার সময় কীর্তন গান স্থানীয় কীর্তনিয়া পাড়ার শিল্পীরা।
প্রতিবছর হয় বাঙালির ঐতিহ্যবাহী লোকজ বারুণী মেলা ও স্নান। বসে লোকজ সংগীত পরিবেশনের আসর। আর দিঘীর পশ্চিম রয়েছে এক সাধুর মাজার।
দিঘীটির দেখভাল করে জেলা প্রশাসন। অতিথিদের জন্য একটি রেস্ট হাউজও রয়েছে এখানে। রেস্ট হাউজে থাকতে হলে এডিসি (রাজস্ব) এর অনুমতি নিতে হবে।
পাঁচ টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে দর্শনার্থীদের। নীলফামারী শহর থেকে অটোরিকশা কিংবা বাসে চড়ে যাওয়া যায় এ ঐতিহ্যবাহী দিঘীতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৬
এমএ/