পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা সমাজের একটি ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্যের নাম ‘গরয়া’। মূলত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব ‘বৈসুক’ কেন্দ্র করেই এই ‘গরয়া’ নাচের আয়োজন করা হয়।
ঐতিহ্যবাহী ও ধর্মীয় এই লোকনৃত্যটি এখন সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের কাছেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাই এ নাচ উপভোগ করতে বৈসুকের সময় বাংলাদেশের পাহাড়ি গ্রামগুলোতে ঘুরতে আসেন অনেক পর্যটক।
ত্রিপুরা গবেষকরা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এই গরয়া নাচ। বৈসুকের অন্তত এক সপ্তাহ আগে কমপক্ষে ১৬ জন ত্রিপুরা নারী-পুরুষের দল বেরিয়ে পড়েন পাহাড়ি গ্রামগুলোতে। ঘরের উঠানে উঠানে গিয়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের গরয়া নাচ পরিবেশন করেন তারা।
শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী একজনের কাঁধে থাকে শুল। পতাকার মতো করে শুলে বাঁধা থাকে একটি খাদি। শুলটি যে ঘরের আঙ্গিনায় বসানো হবে, সেখানেই চলবে বিচিত্র-উপভোগ্য গরয়া নাচ। এভাবে নাচের আসর চলতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম।
প্রবীণ ত্রিপুরারা মনে করেন, গরয়া নাচের দল ঘরের আঙ্গিনায় প্রবেশ করলে তা ঘরের মালিকের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে। এসময় তারা উদার চিত্তে গরয়া দেবতার পুজা দেন এবং শিল্পীদেরকে সাধ্যমত চাউল, গৃহপালিত পশু, টাকা এবং পাহাড়ি মদ উপহার হিসেবে দেন।
বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক প্রভাংশু ত্রিপুরা বলেন, গরয়া হলো প্রেমের দেবতা। দুঃখ-দুর্দশা দূর করে কল্যাণ ও মঙ্গল বয়ে আনেন তিনি। প্রকারান্তরে তিনি মহাদেব। এদিকে ত্রিপুরার রাজা ধন্য মানিক ছিলেন মহাদেবের ভিষণ ভক্ত। ১৫১৩ সালে তিনি কুকিরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করে তার কাছ থেকে গরয়া দেবতা এনে ত্রিপুরা রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেদিন থেকে তার রাজ্যে এই গরয়া দেবতার পূজা ও নৃত্য উৎসব শুরু হয়।
চাংখা কানাই, খলাপালনাই, তকসাবালনাই, মাইকিসিল নাই, তাকরু তাই নাই, তুলা কানাই, খুল খুক নাই, রিসু নাই, নাগুইবিরনাই, মাতাই খুলুমনাইসহ অন্তত ২২টি মুদ্রা এ নাচে পরিবেশিত হয়। মেয়েরা রিনাই রিচাই ও গলায় মুদ্রার মালা পরিধান করেন। ছেলেরা পরেন ধুতি, মাথায় বাঁধেন গামছা।
গোটা গ্রামে গরয়া নৃত্য পরিবেশন শেষ হলে, মানসের প্রাপ্ত জিনিসপত্রগুলো সামনে নিয়ে গরয়া দেবতার পুজা করেন শিল্পীরা।
একবছর গরায়ায় অংশ নিলে টানা তিন বছর ধরে এটা করতে হয। অন্যথায় তার অমঙ্গল বা মৃত্যুর আশংকা থাকে বলে বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে।
গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, গ্রামবাসীর কল্যাণ ও মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যেই হাজার বছর ধরে ত্রিপুরা সমাজে এই বিশেষ নৃত্যের মাধ্যমে গরয়া দেবতার পূজা হয়ে আসেছে।
খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গার গুমতি, বাইল্যাছড়ি, তবলছড়ি, খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুর, হাদুকছড়া, বাঙ্গালকাঠি, দীঘিনালার পোমাংপাড়াসহ জেলার ত্রিপুরা অধ্যূষিত এলাকাগুলোতে গরয়া নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
এদিকে ষষ্ঠ বারের মত খাগড়াছড়ির খাগড়াপুর এলাকায় গরয়া নৃত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। বুধবার (১১ এপ্রিল) বিকালে প্রতিযোগিতাটির উদ্বোধন করেন খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য জুয়েল ত্রিপুরা পার্থ। ‘য়ামুক’ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন এ প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৮
এডি/এনএইচটি