ঢাকা, রবিবার, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২, ২০ জুলাই ২০২৫, ২৪ মহররম ১৪৪৭

অন্যান্য

সংকটে নিশ্চল শিল্প-বাণিজ্য

নিউজ ডেস্ক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৪৪, জুলাই ২০, ২০২৫
সংকটে নিশ্চল শিল্প-বাণিজ্য

দেশের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকট যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। ফলে উদ্বেগ আর শঙ্কা থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারছেন না শিল্পোদ্যোক্তারা।

দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট এবং দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার জন্য অনেকে নতুন বিনিয়োগে পিছপা হচ্ছেন।

ফলে ব্যবসায় আমদানিনির্ভরতা এবং ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার ব্যবসা সম্প্রসারণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব সংকটের মধ্যেই আগামী ১ আগস্ট থেকে মার্কিন বাজারে পণ্য রপ্তানিতে ৩৫ শতাংশ (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) শুল্ক আরোপ নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এতে ইউরোপ ও আমেরিকান বাজারে মন্দা ও চাহিদা কমার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পরিবহনে ঘাটতির কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

ফলে সংকটের বৃত্ত ভাঙতে পারছে না দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্টের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত না হওয়ায় দেশের বিনিয়োগে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। এ সময় কলকারখানা বন্ধ হয়েছে; বেকার হয়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক। ’

তিনি আরো বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীল সরকার না হলে ব্যবসা ও বিনিয়োগে স্থিতিশীলতা আসবে না।

আর দেশে স্থানীয় বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না। এ ছাড়া দেশের আইন-শৃঙ্খলার চরম পর্যায়ে অবনতি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও মব জাস্টিস বন্ধ না হলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে না।  
তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক সরকারের অপেক্ষা এবং নির্বাচন না হওয়ায় তৈরি পোশাক খাতে নতুন বিনিয়োগ আসেনি গত এক বছরে। তবে এই সময় কিছু কিছু কারখানা বন্ধ হলেও অনেক বন্ধ কারখানা চালু হয়েছে।

গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট এবং উচ্চ হারে ব্যাংকঋণের সুদের কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।  
ইউরোপ ও আমেরিকান বাজারে মন্দা ও চাহিদা হ্রাস বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ট্রেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস এমনিতেই তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজার মন্দা থাকে। এ সময় মার্কিন ৩৫ শতাংশ শুল্ক দেশটির বাজারের ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ফলে কোনো কোনো ক্রেতা কার্যাদেশ স্থগিত বা বিলম্বিত করছেন। ক্রেতাদের এমন আচরণে স্থানীয় রপ্তানিকারকরা শঙ্কায় পড়েছেন। ’ তিনি বলেন, এতে বিনিয়োগে মন্দা যাচ্ছে, নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না।

মূলধনী যন্ত্রের আমদানি কমেছে ১৯.৬ শতাংশ

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখানে দেখা যায়, সদ্যোবিদায়ি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশে মূলধনী যন্ত্রের আমদানি কমেছে ১৯.৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না, যার প্রতিফলন হিসেবে দেশে মূলধনী যন্ত্রের আমদানি কমেছে। এর প্রভাবে সামগ্রিকভাবে চাহিদা কমেছে ডলারের। ফলে ডলারের দাম কমে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে মে—এই ১১ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ২৬২ কোটি ২৪ লাখ ডলারের। এর আগের অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৩২৫ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের। এ হিসাবে অর্থমূল্য বিবেচনায় এক বছরের ব্যবধানে মূলধনী যন্ত্রের আমদানি কমেছে ১৯.৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, মে মাসে এই খাতে ঋণ ছাড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.১৭ শতাংশ, আগের মাস এপ্রিলে যা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। এ হিসাব বলছে, টানা সাত মাস ধরে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের দেওয়া ঋণ বাড়ার হার ৮ শতাংশের নিচে রয়েছে। সর্বশেষ অক্টোবরে এই খাতে ৮ শতাংশের বেশি (৮.৩০ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

সাম্প্রতিককালে দেশের বেসরকারি খাতের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। ব্যাংকঋণই ব্যবসায়ীদের প্রধান ভরসা। কিন্তু সেখানে সুদহার বেশি। বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারের অবস্থাও ভালো নয়। ব্যাংকের উচ্চ সুদহারও বেসরকারি ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা। বর্তমানে ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ সুদে। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশের ওপর থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণেই ঋণের সুদহার বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সুদের হার বাড়ার কারণে আমানতকারীরা কিছুটা লাভবান হলেও ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। একদিকে উচ্চ সুদ দিতে চেয়েও আমানত পাচ্ছে না ব্যাংক, অন্যদিকে ঋণ সংকটে পড়ছে বেসরকারি খাত।

গত ১৫ জুলাই তারল্য সরবরাহ ও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে নীতি সুদহার কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতি সুদহার বা রেপো রেট ৮.৫০ শতাংশ থেকে ০.৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে ৮ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার কমবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক এবার সম্প্রসারণমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হাঁটছে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীরা।

সম্ভাব্য সমাধান ও সংকট থেকে উত্তরণের কথা জানতে চাইলে বিটিএমএর সাবেক পরিচালক ও নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি রাশিদুল হাসান রিন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাত সংস্কার, স্বচ্ছতা বাড়ানো, সুদের হার বাড়ানো এবং ক্ষুদ্র উদ্যেক্তাদের জন্য ঋণ সহজলভ্য করতে হবে। ’

এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল ও স্পেশাল ইকোনমিক জোনে সুযোগ বাড়ানোসহ রপ্তানি বহুমুখীকরণে তৈরি পোশাক ছাড়াও তথ্য-প্রযুক্তি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, ওষুধ ইত্যাদি খাত বিকাশে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।