ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ ও নোগুচি ইয়োনেজিরো : এশিয়ার দুই পথিকৃৎ

প্রবীর বিকাশ সরকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০০ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১০
রবীন্দ্রনাথ ও নোগুচি ইয়োনেজিরো : এশিয়ার দুই পথিকৃৎ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে জাপানি কবি, ঔপন্যাসিক ও সমালোচক নোগুচি ইয়োনেজিরোর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ১৯১৬ সালের জুন মাসে, যখন তিনি প্রথম জাপান ভ্রমণ করেন। কিন্তু নোগুচির ভাষ্যকার অধ্যাপিকা কেইকো ওয়াদা মনে করেন দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে থাকতে পারে লন্ডনে, রবীন্দ্রনাথের জাপান আসার আগে।

সে যাই হোক, রবিঠাকুরের সংবর্ধনা পরিষদের অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন নোগুচি। তখন তিনি জাপানের একমাত্র ইংরেজিভাষী ও আন্তর্জাতিক কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ১৯১৩ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তখন তিনি ৫২ বছর বয়স্ক এবং নোগুচি ৩৮ (জন্ম ১৮৭৫)। ১৯১৬ সালে নোগুচি ৪১। দুজনের মধ্যে ১৪ বছরের ব্যবধান ছিল কিন্তু গড়ে উঠেছিল গভীর বন্ধুত্ব- তাঁদের এই সম্পর্ক নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা হয়েছে এমন রচনা এখনো পাঠ করার সৌভাগ্য হয়নি।

রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসের ১৪ তারিখে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। সে বছরেরই ডিসেম্বর মাসে কবি নোগুচি লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ‘দি স্পিরিট অব জাপানিজ পোয়েট্রি’ বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন। একই সঙ্গে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস, মারসেয়ু শহরেও জাপানি সাহিত্য ও সংস্কৃতির আধ্যাত্মিক বিষয়ে আলোচনা করেন একাধিক সভাসমিতিতে। সুতরাং এর আগের মাসে এশিয়ায় প্রথম নোবেল পুরস্কারে ভূষিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনে থাকবেন। অথবা ১৯১৫ সালে জাপানে আশ্রিত রবীন্দ্র-আশীর্বাদপুষ্ট বিপ্লবী মহানায়ক রাসবিহারী বসুর মাধ্যমেও শুনে থাকবেন, কেননা নোগুচি রাসবিহারীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু নোগুচি কি রবিঠাকুরের পুরস্কার অর্জনের আগে তাঁর কবিতা বা রচনা পাঠ করেছিলেন? দেশ-বিদেশে ততদিনে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেছেন। কিন্তু নোগুচি জাপান তথা এশিয়ার কবি হিসেবে আমেরিকা ও ইউরোপে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছেন ১৮৯৬ সালে বিখ্যাত দি লার্ক কাগজে প্রকাশিত প্রথম কবিতা ‘দি নাইট রিভেরিজ অব অ্যান এক্সাইল’ (The Night Reveries of an Exile)-এর বদৌলতে। ভিন্ন ধারার কবিতা হিসেবে প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছিল কবিতাটি আমেরিকার অভিজ্ঞ কবিমহলে। কবিতাটি তাঁর আমেরিকায় অবস্থানকালীন কষ্টসহিষ্ণু জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতির উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ। তখন তাঁর বয়স ২১ বছর। একই সঙ্গে তার এক কানাডীয় বন্ধু কবি ব্লিস কার্মেন (Bliss Carman, ১৮৬১-১৯২৯)-এর মাধ্যমে চেপবুক (Chapbook) কাগজেও প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কবিতা। একই সালেই প্রকাশ করেন সিন অ্যান্ড আনসিন/ (Seen and Unseen)  নামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এর ভূমিকা লিখে দেন জিলেট বারগেস (Frank Gelett Burgess, ১৮৬৬-১৯৫১)। পরের বছর সানফ্রান্সিসকো থেকে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ দি ভয়েস অব ভ্যালি (The Voice of the Valley) । ১৯০১-২ সালে আমেরিকার এক সুদর্শনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় নোগুচির। শিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিক এই তরুণীর নাম লিওনি গিলমোর  (Léonie Gilmour, ১৮৭৩-১৯৩৩)। তাঁর সহযোগিতায় প্রকাশ করেন প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাস যথাক্রমে দি আমেরিকান ডায়েরি অব এ জাপানিজ গার্ল (The American Diary of a Japanese Girl) এবং দি আমেরিকার লেটারস অব এ জাপানিস পার্লর মেইড (The American Letters of a Japanese Parlor-Maid)। দুটিই  আমেরিকার মহানগর নিউ ইয়র্কে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে লিখিত। ১৯০৩ সালে লন্ডনে এসে নিজব্যয়ে প্রকাশ করেন বহুল প্রশংসিত মাত্র ১৬ পৃষ্ঠার সুতনুকা কাব্যগ্রন্থ ফ্রম দি ইস্টার্ন সি (From the Eastern Sea)। বইটি প্রসিদ্ধ কবি, লেখক, সমালোচক, নাট্যকার ও সাংবাদিক যথাক্রমে ইউলিয়াম মাইকেল রোসেট্টি (William Michael Rossetti, ১৮২৯-১৯১৯),  আর্থার সাইমনস (Arthur William Symons, ১৮৬৫-১৯৪৫), টমাস হার্ডি (Thomas Hardy, ১৮৪০-১৯২৮), আলফ্রেড অস্টিন (Alfred Austin,১৮৩৫-১৯১৩), লরেন্স বিনিয়ন (Robert Laurence Binyon, ১৮৬৯-১৯৪০), উইলিয়াম বাটলাস ইয়েটস (William Butler Yeats, ১৮৬৫-১৯৩৯),  লরেন্স হৌসম্যান (Laurence Housman, ১৮৬৫-১৯৫৯), আর্থার রেনসোম (Arthur Mitchell Ransome, ১৮৮৪-১৯৬৭) প্রমুখের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শুধু তাই নয়, তাঁকে ব্রিটিশ কবি কোলরিজের (Samuel Taylor Coleridge, ১৭৭২-১৮৩৪) সঙ্গে তুলনা করেন কেউ কেউ। এটা তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। লন্ডন তথা ইউরোপে তাঁর এই সফলতা নিউ ইয়র্কের তরুণ সাহিত্যিকমহলে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সম হয়। এই বইটি এর ১১ বছর পরের রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি : সংস অফারিংস-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এটিও তখন ইউরোপে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

১৯০৪ সালের শেষ দিকে জাপানে ফিরে আসেন নোগুচি রুশ-জাপান যুদ্ধের একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে। তাঁর এই আগমন উপলে প্রখ্যাত কবি কোওদা রোওহান একটি দীর্ঘ কবিতা প্রকাশ করেন জাপানি ইয়োমিউরি শিম্বুন পত্রিকায়। এ সময় তিনি জন্মশহর নাগোয়া-জেলার ৎসুশিমাসহ বিভিন্ন জায়গা পরিভ্রমণ করেন। ঠিক এই সালেই ক্যালিফোর্নিয়াতে প্রথম সন্তান ইসামু নোগুচি (১৯০৪-৮৮) জন্মগ্রহণ করে। প্রথম স্ত্রী বা প্রেমিকা লিওনি গিলমোর এই সন্তানের মাতা। ১৯০৫ সালে টোকিও থেকে প্রকাশিত হয় জাপান অব সোর্ড অ্যান্ড লাভ (Japan of Sword and Love)। পরের বছর প্রকাশিত হয় দি সামার কাউড (The Summer Cloud)। ১৯০৭ সালে বের হয় দি টেন কিয়োগেন ইন ইংলিশ (Ten Kiogen in English); ১৯০৮ সালে দি পিলগ্রিমেজ (The Pilgrimage); ১৯১০ সালে কামাকুরা (Kamakura) ও লাফকাডিও হার্ন ইন জাপান (Lafcadio Hearn in Japan)। দি স্পিরিটস অব জাপানিজ পোয়েট্রি (The Spirit of Japanese Poetry) এবং দি স্টোরি অব ইয়োনে নোগুচি (The Story of Yone Noguchi) বের হয় ১৯১৪ সালে।

Noguchi Yonejiro

১৯১৪ সাল পর্যন্ত আমরা দেখি যে নোগুচি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে আমেরিকা-ইউরোপে বহুল পঠিত, বড় কবি ও সাহিত্যিকদের দ্বারা সুপ্রশংসিত। এবং প্রভাবশালী পত্রিকা, সাময়িকীসমূহে তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে। সেই তুলনায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশ্ববাসী যেন হঠাৎ করেই পেয়ে গেল নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে। তিনি হয়ে উঠলেন রাতারাতি আন্তর্জাতিক কবি। পুরস্কারের পর আমেরিকা দিয়ে শুরু হলো তাঁর বিশ্বভ্রমণ। জীবনের ৪০ বছর বহির্বিশ্বেই কাটালেন। অন্যদিকে ১৮ বছর বয়সে ১৮৯৩ সালে নোগুচি কেইয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ না করেই আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে পাড়ি দেন। আমেরিকায় কখনো ভবঘুরে, কখনো পরিশ্রমসাধ্য কাজ করে জীবন অতিবাহিত করেন। এখানেই তাঁর প্রথম সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি এবং ইংরেজি ভাষায়। ছাত্রজীবনেই ইংরেজির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এই ভাষা শিখেছিলেন। শাণ দিয়েছেন আমেরিকা গিয়ে। উচ্চশিাও গ্রহণ করেছেন সেখানে। ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসবিষয়ক বিস্তর গ্রন্থ পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। শ্বেতাঙ্গ জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সানফ্রান্সিসকো, অকল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক, শিকাগো এবং ইউরোপের লন্ডন, প্যারিস প্রভৃতি শহরে থেকে অর্জন করেছেন বিপুল অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতাসমূহ তাঁর রচনাসমূহে বারবার এসেছে। প্রায় এক যুগের কাছাকাছি থেকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর সুনাম ও যশ কুড়িয়েছেন বিদেশী ভাষায়- এমনটি এশিয়ার আর কাউকেই আমরা দেখি না। এই দিক দিয়ে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। জাপানে আধুনিক কাব্য ও কথাসাহিত্যের চর্চারও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরবর্তীকালে যে তিনজন এশিয়ান ইংরেজিতে কবিতা লিখে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নোগুচি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সরোজিনী নাইডু (১৮৭৯-১৯৪৯)। শেষোক্ত দুজনের সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর বন্ধুত্ব। ১৯১৪ সালে নোগুচি সোভিয়েত রাশিয়ায় সাক্ষাৎ লাভ করেন লেখক বার্নার্ড শ (George Bernard Shaw, ১৮৫৬-১৯৫০), এইচ জি ওয়েলস (Herbert George Wells, ১৮৬৬-১৯৪৬), নাইডু এবং ইয়েটসের সঙ্গে। পরে কবি এজরা পাউন্ড (Ezra Weston Loomis Pound, ১৮৮৫-১৯৭২), কবি রিচার্ড এলডিংটন (Richard Aldington, ১৮৯২-১৯৬২), কবি জন গোল্ড ফেচার (John Gould Fletcher, ১৮৮৬-১৯৫০) প্রমুখের সঙ্গেও সখ্য গড়ে ওঠে। এমনটি আর কোনো জাপানি কবির ক্ষেত্রেই ঘটেনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেত গিয়েছিলেন আইন পড়ার বাসনায় ১৪ বছর বয়সে, ১৮৭৮ সালে কিন্তু পড়ালেখা বাদ দিয়েই কলকাতায় ফিরে আসেন। কিন্তু মননে ভরে নিয়ে আসেন ইউরোপীয় সাহিত্যশ্রেষ্ঠ শেক্সপিয়ার (William Shakespeare, ১৫৬৪-১৬১৬), টমাস ব্রাউন (Sir Thomas Browne, ১৬০৫-৮২) তথা বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে জানার অদম্য কৌতূহল ও তৃষ্ণা। দুজনেই পরবর্তীকালে শিক্ষাবিদ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন। আর নোগুচি জাপানের মর্যাদাসম্পন্ন কেইয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ যেমন অল্প বয়সে ভারতের প্রাচীন ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা, দর্শন ইত্যাদি পড়েছিলেন, নোগুচিও কৈশোরেই ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ধর্ম বিশেষ করে হাইকু কবিতা ও জেনধর্ম সম্পর্কে গভীর আগ্রহশীল ছিলেন যা তাঁকে জাপানি প্রকৃতিজাত আধ্যাত্মিক চেতনায় শক্তিশালী করেছে ক্রমাগত। যদিওবা আমেরিকার অকল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি আমেরিকার প্রকৃতিবাদী কিংবদন্তী কবি ও লেখক জোয়াকিন মিলারের (Joaquin Miller, ১৮৪১-১৯১৩) সান্নিধ্যে অন্য মহাদেশের মহাপ্রকৃতিকে উপলব্ধি করার প্রয়াস পেয়েছেন মিলারের নির্মিত পাহাড়ি বনবাসে থেকে। তাঁরই উৎসাহে ও সহযোগিতায় নোগুচি কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধে প্রকৃতিজাত দর্শন বা মরমিবাদ এবং প্রাচ্যচিন্তা গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। যেমনটি দেখি রবীন্দ্রনাথে। দুজনেরই পারিবারিক উত্থান ও বেড়ে ওঠার মধ্যে মিল লণীয়। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ ছিলেন জমিদার বা সামন্তশ্রেণীর প্রতিনিধি, নোগুচিরও পিতৃবংশের পূর্বপুরুষ ছিলেন সামুরাই তথা সামন্তবাদী। জাপানের ইতিহাসখ্যাত মধ্যযুগীয় সামুরাই বীরযোদ্ধা ওদা নোবুনাগার (১৫৪৩-৮২) বাল্যকালের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নোগুচির পূর্বপুরুষ। আধুনিক যুগের প্রাক্কালে এসে সামুরাই পদবি ছেড়ে কৃষিপেশা গ্রহণ করেছিলেন উত্তরসূরিরা। তারপর মেইজি যুগে এসে ব্যবসায়ী। রবীন্দ্রনাথের জীবনেও অনুরূপ ইতিহাস বিদ্যমান। নোগুচির মা ছিলেন অভিজাত বংশের মেয়ে এবং কলারসিক। তাঁরই প্রভাব পড়েছে নোগুচির ওপর। তাই জাপানি স্বতন্ত্রধর্মী কলাশিল্প বিশেষ করে বহুরঙা কাঠখোদাই শিল্প উকিয়োএ সম্পর্কে তিনি প্রথম ইংরেজিতে বৃহৎ পরিসরে তুলে ধরেন বহির্বিশ্বে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ যেমন বাংলার প্রাচীন চারুকলাকে নবরূপ দেবার জন্য রেনেসাঁ সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছিলেন, তেমনি নোগুচিও জাপানের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলাকে দেশ-বিদেশে যেভাবে তুলে ধরেছিলেন তাঁর বই দি স্পিরিটস অব জাপানি আর্টস (The Spirits of Japanese Arts), হোরিশিগে (Horishige), কোরিন (Korin), উতামারো (Utamaro), হোকুসাই (Hokusai), হারুনোবু (Harunobu), হোরিশিগে অ্যান্ড জাপানিজ লেন্ডস্কেপস (Horishige and Japanese Landscapes) প্রভৃতি গ্রন্থে- এ ধরনের বড় মাপের কাজ আর কোনো জাপানি কবি করেছেন বলে জানা নেই। এ কারণে জাপানে মর্যাদাসম্পন্ন শিল্পকলাবিষয়ক পুরস্কারও তিনি অর্জন করেছিলেন। কবির দৃষ্টিতে চিত্রশিল্পী হোরিশিগে, উতামারো, হোকুসাই, হারুনোবু প্রমুখের চিত্রকর্মগুলোর বর্ণনা ভিন্নমাত্রা পেয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ যেমন সাহিত্য সাময়িকী সাধনা, তত্ত্ববোধিনী প্রভৃতি সম্পাদনা বা পরিচালনা করেছেন, নোগুচিও প্রকাশ ও সম্পাদনা করেছিলেন ত্রৈমাসিক দি আইরিশ (জাপানি ভাষায় আয়ামে ফুল) নামে কবিতাপত্র ১৯০৬ সালে। এই সাময়িকী প্রকাশ উপলে একটি কবিসংস্থা গঠন করেন ‘আয়ামে কাই’ নামে। তখনকার বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ কবিদের কবিতা তিনি প্রকাশ করেছেন, আর কোনো কবি জাপানে এমন উদ্যোগ নেননি। যদিও সমসাময়িক স্বনামধন্য কবি, সাহিত্যিক,  জার্মানভাষা ও সাহিত্য বিশেষজ্ঞ এবং সেনা চিকিৎসক ওওগাই মোরি (১৮৬২-১৯২২) জার্মান কবি ও সাহিত্যিক যথাক্রমে গ্যাটে (Johann Wolfgang von Goethe, ১৭৪৯-১৮৩২), ফেডরিক ফন শিলার (Friedrich von Schiller, ১৭৫৯-১৮০৫), হেনরিক ইবসেন (Henrik Ibsen, ১৮২৮-১৯০৬), হান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন (Hans Christian Andersen, ১৮০৫-৭৫), হাউপ্টমান (Bruno Richard Hauptmann, ১৮৯৯-১৯৩৬) প্রমুখের রচনা জাপানিতে অনুবাদ করেছেন; আধুনিক সাহিত্য ম্যাগাজিন শিগারামিজোশি প্রকাশ করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন, নিঃসন্দেহে জাপানি সাহিত্যকে আধুনিক করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন কিন্তু নোগুচির মতো বহির্বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেননি।

রবীন্দ্রনাথ যেমন শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, ধর্ম, দর্শন, শিল্পকলা, নাট্যকলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদান রেখে গেছেন বলে ভারতের ইতিহাসে পৃথিকৃৎ, নোগুচি অত বিষয়ে চিন্তা না করলেও বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৮০টি গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত এত বেশি সংখ্যক গ্রন্থ আর কোনো জাপানি কবি বা লেখক লিখেছেন বলে জানা নেই। নোগুচি ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় লিখেছেন। এক্ষেত্রে সমসাময়িক জাপানি শিল্পকলার পন্ডিত ও দার্শনিক তেনশিন ওকাকুরার (১৮৬২-১৯১৩) সঙ্গে মিল রয়েছে।

রাজনৈতিক চিন্তার দিক দিয়েও নোগুচি ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে মিল ও বিভ্রান্তি রয়েছে। ওকাকুরা, নোগুচি এবং রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যবাসী তথা শ্বেতাঙ্গসমাজের জাতিগত বৈষম্য এবং উন্নাসিকতার সুস্পষ্ট অভিজ্ঞতা জীবনের আদিলগ্নে বিদেশেই অর্জন করেছেন। কিন্তু কোনো বিরূপ সমালোচনা না করে নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, স্বতন্ত্র শিল্পকলা ও সঙ্গীত, মানবিক সৌন্দর্যবোধ এবং প্রকৃতিনির্ভর ধর্ম-দর্শনকে ইংরেজি ভাষায় লেখার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সমক হতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এই তিনজন ছাড়া এশিয়া থেকে আর কাউকে আমরা এই রকম ব্যাপক ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে পাই না। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, ইতালি এবং রুশ ভাষার শ্বেতাঙ্গ সাহিত্যের প্রতি আমৃত্যু সম্মান ও অনুরাগ বজায় রেখেই তিনজন শ্বেতাঙ্গদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা ও জাতিগত বৈষম্যের কারণেই জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। নোগুচি আমেরিকায় থাকাকালীন সানফ্রান্সিসকোতে প্রকাশিত একটি জাপানি পত্রিকায় কাজ করেন কিছুদিন, এটা পরিচালনা করতেন আমেরিকা প্রবাসী জাপানিরা যারা, মেইজি যুগে গণতান্ত্রিক ও গণমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জাপানের অভ্যন্তরে সকল প্রকার সরকারি বৈষম্য, রাষ্ট্রনায়কদের স্বজনপ্রীতি বন্ধ এবং আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশসমূহের সঙ্গে অসমচুক্তির পুনর্বিবেচনা ইত্যাদি দাবি নিয়ে সামাজিক আন্দোলন তখন চলছিল, যা তাইশো যুগে (১৯১২-২৬) এসে তাইশো ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠাকে ফলপ্রসূ করতে সম হয়। নোগুচি স্বচে বহির্বিশ্বে সেই তরুণকালেই শ্বেতাঙ্গ বৈষম্য প্রত্য করেছিলেন। তৎকালে আমেরিকা ও ইউরোপে এশিয়ানদের জন্য ভদ্র কোনো চাকরি ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও নানা বৈষম্যমূলক নিয়মনীতি ছিল। তিনি আমেরিকার বিভিন্ন শহরে গৃহপরিচারক, পত্রিকার হকারি এবং বোহেমিয়ান জীবনযাপনও করেছেন। স্থির হতে পারেননি কোথাও। ফলে সেই মাতৃভূমি জাপানেই ফিরে এসেছিলেন ১৯০৪ সালে স্ত্রী বা প্রেমিকা লেওনি গিলমোরকে ছেড়ে। কেন তা এক রহস্য। উন্নাসিক শ্বেতাঙ্গ জীবনসংস্কৃতি কি তাকে হতাশ করেছিল? জাপানে ফিরে আসার পর তিনি মাৎসুকো নামের নারীকে বিয়ে করে একাধিক পুত্র-কন্যা সন্তানের জনক হন। কিছুকাল ইংরেজিতে লেখালেখি করলেও জাপানি ভাষায় আত্মসমর্পণ করেন অনেকটা মাইকেল মধুসূদন দত্তর মতো। আমেরিকা-সৃষ্ট কবির ইংরেজি কবিতা বিদেশি ভাষা না-জানা জাপানিরা গ্রহণ করবেন কেন? কিন্তু তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধে গভীর দেশাত্মবোধের কথা স্বীকার করেছেন তৎকালীন ইংরেজি সাহিত্যের পন্ডিত মাকোতো সানগুউ (১৮৯২-১৯৬৭)। তিনি মন্তব্য করেন, ‘অগণিত মানুষের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নোগুচি ছিলেন জাপানি সংস্কৃতির ভাষ্যকার এবং দেশপ্রেমিক। জাতীয় শিল্পকলা পুরস্কার অর্জন (১৯৪৩) তারই প্রমাণ। ’ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন: ‘At last the poet has come, the poet who is the true messenger of the spirit of his people representing the culture which is national, but above all universal, and of all time…’

তথাপি দেশে ফেরার পরও তিনি আমেরিকা ও ইউরোপ ভ্রমণ করেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক ও বৈচিত্র্যময় পাশ্চাত্য কাব্যচিন্তার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে, আবার একইসঙ্গে জাপানে বিস্মৃতপ্রায় প্রাচ্যসৌন্দর্যকে পুনরাবিষ্কার তাঁকে দীর্ঘদিন মানসিক দ্বন্দ্বে দোলায়িত করেছে। এই জটিলতা তাঁর বিখ্যাত দ্বৈনাগরিকত্বধারীর কবিতা কাব্যগ্রন্থে বিধৃত আছে। এই দ্বন্দ্ব থেকেই কি তিনি তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন? আমেরিকান স্ত্রী জাপানে শিশু পুত্রসন্তানকে নিয়ে এসে দীর্ঘবছর ইংরেজি ভাষার শিকতা করে জীবন অতিবাহিত করেছেন- একবারও নোগুচি তাঁর প্রতি, পুত্রসন্তান ইসামু নোগুচির প্রতিও আগ্রহ প্রকাশ করেননি বলে জানা যায়। এমনকি পুত্র নোগুচিকে তাঁর পদবি ব্যবহার না করার বিষয়ে চাপও প্রয়োগ করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ইসামু নোগুচি পরবর্তীকালে ভাস্কর ও কলাবিদ হিসেবে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছিলেন।

মনে করা যেতে পারে নোগুচির ধমনীতে প্রবহমান সামুরাই রক্ত তাঁকে প্রভাবিত করেছিল জাতীয়তাবাদের দিকে। সামন্তবাদী সামুরাইরা ছিলেন প্রচন্ড জাতীয়তাবাদী। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তাকে নাড়া দিয়েছিল স্বদেশের সার্বভৌমত্ব রার্থে। বলা হয়ে থাকে, তাঁকে রাজকীয় সমরবাদ প্ররোচিত করেছিল চীনের প্রতি জাপানের রাজ্যবিস্তারের পরিকল্পনাকে সমর্থনদানের জন্য। কিন্তু যিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি তরুণ বয়স থেকেই সোচ্চার, বিখ্যাত বামপন্থী জাপানি কাগজ কাইজোতে লিখেছেন গণতন্ত্র, গণমুক্তির বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং রুশ-জাপান মহাযুদ্ধের (১৯০৪-৫) বিরুদ্ধে বিজয়ী একজন জাপানি নাগরিক হয়েও কট্টর জাতীয়তাবাদ তাঁকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। ১৯৩৭ সালে যখন দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ বাঁধে বেইজিংয়ের মার্কোপলো ব্রিজ আক্রমণকে কেন্দ্র করে, তখন তিনি জাপানের ভবিষ্যৎ বিষয়ে অশনিসঙ্কেত অনুভব করেন। তখন অধিকাংশ জাপানি বুদ্ধিজীবী ছিলেন এই যুদ্ধের পক্ষে। মূলত এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল কমিউনিস্টপন্থী জনৈক চীনা নাগরিক, যুদ্ধের পর অনুষ্ঠিত টোকিও মিলিটারি ট্রাইবুনালে (১৯৪৬-৪৮) তিনি তা স্বীকারও করেছেন। কথিত আছে, নোগুচি তিনবার জাপান সরকারের প্রতিনিধি হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে এই যুদ্ধের পটভূমি, মূল কারণ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেবার জন্য। প্রভাবশালী ভারতীয়দের মধ্যে তাঁর প্রিয় বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সরোজিনী নাইডুও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল নোগুচিকে ভারতে আমন্ত্রিত করে জাপান সম্পর্কে বক্তৃতা প্রদানের। এর ফল হিসেবে ১৯৩৫ সালে তিনি ভারতে আসেন এবং দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন, বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থানসমূহ পরিভ্রমণ করেন এবং রবীন্দ্রনাথ, নাইডু, গান্ধী, উদয়শঙ্কর প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করেন। ভারতে তাঁর তিনটি বক্তৃতা ছিল যথাক্রমে ‘জাপানের কবিতা ও গান’, ‘জাপানের শিল্পকলা’ এবং ‘প্রকৃতি প্রশস্তি’ কিন্তু এর বাইরে ‘জাপানের শান্তিবাদী আদর্শ’ বিষয়ে বক্তৃতা করেছিলেন যা স্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে সমালোচিত হয়েছিল। পত্রিকাটি নোগুচিকে উদ্দেশ করে বলেছিল, ভারতবাসী জাপানে সমরবাদবিরুদ্ধ আন্দোলন এবং জাপানের চীন অভিযান সম্পর্কে অধ্যাপকের কী ভাষ্য তা জানতে আগ্রহী। নোগুচি এই বিষয়ে ভারতীয় সংবাদপত্র ও জনগণকে বিদেশী সংবাদপত্রকে অতিরিক্ত বিশ্বাসের দোষে অভিযুক্ত করেছিলেন। এই সফরের সময় রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ হয়েছিল সন্দেহ নেই কিন্তু সেই তথ্য কেউ লিপিবদ্ধ করে যাননি। কাজেই অজ্ঞাত রয়ে গেছে সেই আলোচনা।

১৯৩৭ সালে যখন চীন-জাপান যুদ্ধ বেঁধে গেল এর পরের বছর ১৯৩৮ সালে নোগুচি ও রবীন্দ্রনাথ দুজনের মধ্যেই তীব্র এক পত্রযুদ্ধ বাঁধে। এই যুদ্ধে দুজন দুজনকে নগ্নভাবেই বাস্তব সব যুক্তিসহকারে আক্রমণ করেন। দুজন কবির দুটি করে চারটি পত্রযুদ্ধের এমন ঘটনা ইতিহাসে আর নেই। বস্তুত রবীন্দ্রনাথ যে জাপানি জাতীয়তাবাদী সমরবাদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন চীনে মানুষহত্যার ব্যাপারে, সেই রবীন্দ্রনাথ জাপানি সমরবাদকে পরো-প্রত্যভাবে সমর্থনকারী একাধিক কট্টোর জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জাপানেই সাক্ষাৎ করেছিলেন, জাপানে আশ্রিত ভারতীয় বিপ্লবীদের সমর্থন দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় যে বিব্রতকর ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি তা হলো: ইতালিতে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর সঙ্গে করদর্মন! তাতে করে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার গভীরতা সম্পর্কে বেশ প্রশ্ন উঠেছিল। শুধু তাই নয়, তিনি কোরিয়া ও চীনের প্রতি জাপানের রাজনৈতিক ভূমিকার কথাও খুব ভালো করে ভেবে দেখেছিলেন কিনা সন্দেহ জেগেই থাকে। বিদেশী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত চীন, আমেরিকা, ব্রিটেন ও রাশিয়ার প্রপাগান্ডামূলক সংবাদ ও আলোকচিত্র দেখে রবীন্দ্রনাথসহ ভারতীয় নেতৃবৃন্দ আগাগোড়াই বিশ্বাস করেছিলেন। এসব তথ্য ও আলোকচিত্র আজকে মিথ্যে বলে প্রমাণিত হচ্ছে জাপানি ও বিদেশী গবেষক এবং তৎকালীন চীনে অবস্থানরত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের স্বীকারোক্তিমূলক ইতিহাসের মাধ্যমে। চীনা জাতীয়তাবাদী নেতা জেনারেল চিয়াং কাই-শেক (Chiang Kai-shek, ১৮৮৭-১৯৭৫) যাকে রবীন্দ্রনাথ বীরোচিত যোদ্ধা বলে অভিহিত করেছিলেন নোগুচিকে লিখিত একটি চিঠিতে- তাঁর কী অবস্থা হয়েছিল? আমেরিকার কাছে টাকার বিনিময়ে দেশবিক্রি করার গুরুতর অভিযোগ ছিল কাই-শেকের বিরুদ্ধে। আমেরিকা, ব্রিটেনের সামরিক শক্তি ধার করেও কাই-শেক চীনকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেননি, রাশিয়াপ্রভাবিত কমিউনিস্টদের কাছে পরাজিত হয়ে ফরমোজা দ্বীপ তথা তাইওয়ানে পালাতে হয়েছে আপন জন্মস্থান ছেড়ে। অথচ তিনি তাঁর গুরু চীনা জাতির পিতা একনিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী নেতা ও প্যানএশিয়ানিস্ট ড. সান ইয়াৎ-সেনের (SunYat-sen, ১৮৬৬-১৯২৫) কূটনীতি অনুযায়ী যদি জাপানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হতো কিনা সন্দেহ হয়। ভারতের স্বাধীনতাও কবে যে আসত বলা কঠিন। শেষ পর্যন্ত সেই তো জাতীয়তাবাদী সমরবাদীদেরই জয় হলো, জাপানের সাহায্য নিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫?) ভারতবর্ষকে স্বাধীন করে দিয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ দেখে যেতে পারলেন না এই বিজয়।

অন্যদিকে নোগুচি যেমন রাজনীতিবিদ ছিলেন না রবীন্দ্রনাথও নন, বরং দুজনেই ছিলেন মানবপ্রেমী এবং খাঁটি দেশপ্রেমিক। ১৯৪৭ সালে মৃত্যুর আগে নোগুচি চীন-জাপান যুদ্ধকে সমর্থনদান এবং পুত্র ইসামুর প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা প্রদর্শন যে ভুল ছিল তা স্বীকার করে গেছেন। ভুল করে ভুল স্বীকার করা মনে হয় প্রকৃত মহানুভব ব্যক্তিদেরই মানায়। দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে দুজনেই সঠিক ছিলেন শুধু প্রকৃত জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন বলে মনে হয়। আবার যদি আজকের বাস্তবতার দিকে নজর রাখি দেখতে পাই এশিয়ার প্রতি জাপানের তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকাও এক এশিয়ার ঐক্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস থেকেই উৎসারিত ছিল। পন্ডিত ওকাকুরা ‘এশিয়া ইজ ওয়ান’ এই আপ্তদর্শনের স্বাপ্নিক পুরুষ ছিলেন, প্রভাবিত করেছিলেন এশিয়ার তৎকালীন বহু প্যান-এশিয়াস্টিকে- নোগুচিও তাঁদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার অর্ধশতাব্দী পর নোগুচি এবং রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এতটুকু ম্লান হয়নি। নোগুচির চিন্তা ও লেখা সাম্প্রতিককালে আমেরিকার এশিয়ান-আমেরিকান প্রজন্মের কাছে ক্রমশ আগ্রহ জাগিয়ে তুলছে আন্তঃজাতীয়তাবাদের (Transnationalism) আলোকে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ একুশ শতকে এসে প্রকৃতিচিন্তার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ভারতের বাইরে যে দেশের সূচিস্নিগ্ধ এবং রৌদ্রপ্রাণ প্রকৃতি দ্বারা তিনি গভীরভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন, সেই দেশটি ছিল জাপান। জাপানি মানুষের প্রকৃতিপ্রেম তাঁকে বারবার জাপানে টেনে এনেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণ করেছেন পাঁচবার, নোগুচি ভারত তিনবার। ভারতে ব্রিটিশ অপশাসনের সত্যিকার চিত্রটি তিনি প্রথম অনুধাবন করেছিলেন কবি সরোজিনী নাইডু কর্তৃক প্রেরিত স্বরচিত কাব্যগ্রন্থ দি ব্রোকেন উইং (The Broken Wing) পড়ে। বিস্মিয়াহত হয়েছিলেন নোগুচি। তারপর থেকেই পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি গভীরভাবে সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর ভারতভ্রমণ দিনলিপি ইনদো ওয়া গাতার বা ভারতভাষ্য (১৯৩৭) ছাড়াও অকিতেয়ো ইনদো বা জেগে উঠো ভারত (১৯৪৩) প্রকাশ করেছেন। অকিতেয়ো ইনদো কাব্যগ্রন্থে তিনি বাংলা অঞ্চলের প্রকৃতি, নারীকে যে কতখানি অনুভব করেছিলেন একাধিক কবিতায় সেই অনুভূতি বর্ণিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকেও নিয়ে লিখেছেন কবিতা তাগো-রু নি আতাহেরু বা টেগোরকে নিবেদিত শিরোনামে । মৃত্যু পর্যন্ত বন্ধু রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাভক্তি ও ভালোবাসার যে এতটুকু ঘাটতি হয়নি এই কবিতাই তার বড় প্রমাণ। এই দুই কবির মধ্যে মিল-অমিল থাকা সত্ত্বেও তাঁরা অনেক বিষয়েই ছিলেন এশিয়ার মধ্যে অগ্রসর এবং পথিকৃৎ।

Japan
জাপান থেকে
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫৫৯, জুলাই ০৪ ২০১০
এসকেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।