ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ

জাকির তালুকদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১০
ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ

০৯. ঐ আসে ত্রাণকারী! আসে কি?

তাকে কাজে লাগানো হয়েছে তরকারির ক্ষেতে। রামশর্মার বিশাল ইক্ষুসাম্রাজ্যের এক পাশে তরকারির তে।

সেখানে অলাবু, কুষ্মাণ্ড(চালকুমড়া), করবেল(করলা), ইচ্ছর(এঁচর), বাতিঙ্গন(বেগুন), পটল, মূলক(মুলো), হিলমঞ্চি(হেলেঞ্চা শাক) ফলানো হয়। যে ঋতুতে যে তরকারির ফলন হয়, সেই ঋতুতে সেই তরকারির চাষ। এখানকার তরকারি দিয়ে রামশর্মার পরিবার-পরিজন তো বটেই, শ্রমদাসদেরও সারা বছরের তরকারির প্রয়োজন পূরণ করা হয়। একেই বলে মাছের তেলে মাছ ভাজা। রামশর্মার কাছে এই তরকারি েেতর গুরুত্বও অপরিসীম। তিনি আদর করে একে বলেনÑ ব্যাঞ্জন-উদ্যান।
কাছের পুষ্করণি থেকে ছোট আকারের একটি মৃৎপাত্রে জল ভরে এনে বাতিঙ্গন চারার গোড়ায় ঢালছে পপীপ। এই জলসেচনের কাজ সচরাচর করে থাকে গোলগোমী নারীরা। তারা কাঁখের কলস ভর্তি করে জল এনে ঢালে গাছের চারাগুলিতে। তাদের সাথে পপীপের মতো শিশুদের জুড়ে দেওয়া হয়। এইটুকু ছেলেকে জলটানার কাজ করতে দেখে মাতৃহৃদয় সহজেই জেগে ওঠে গোলগোমীদের ভেতরে। তারা কেউ কেউ পপীপকে কাছে টেনে নেয়। আঁচলে মুছিয়ে দেয় গায়ের ঘাম। মুখে হাত বোলায় স্নেহ-ভালোবাসা মিশিয়ে। কেউ কেউ শাপান্ত করে রামশর্মারÑ লোকটার বুকের মধ্যে হৃদয়ের বদলে ভগবান ঠেসে দিয়েছে প্রাগজ্যোতিষ পাহাড়ের শিলাপাথর। তা নাহলে এইটুকু দুধের সন্তানকে জলটানার মতো কঠিন কাজে লাগিয়ে রাখতে পারে! এই বামুন ঠাকুরের কত কার্ষাপণ আর স্বর্ণমুদ্রা প্রয়োজন? ও কি চিতায় ওঠার সময় ধন-সম্বল সঙ্গে নিয়ে যাবে? লোকটা মরলে সব সম্পত্তি শেয়াল-শকুনে খাবে। যা বাবা পপীপ, তুই ঐ পনস(কাঁঠাল) গাছের ছায়ায় গিয়ে বসে থাক। তোকে জল টানতে হবে না। আমরাই তোর কাজ করে দিচ্ছি।
    কিন্তু পপীপ গিয়ে গাছের ছায়ায় হেলান দিয়েছে কি দেয়নি, তেড়ে এল রামশর্মার উদ্যানপ্রহরী। হাতের লাঠি উঁচিয়ে ধরেছে মাথার ওপরÑ কাজের সময় কুঁড়েমি শ্রী শ্রী রামশর্মার রাজত্বে চলবে না। ওঠ ব্যাটা অসুরের বাচ্চা! যা কাজ কর! নইলে দিলাম বাড়ি মাথায়। এক বাড়িতে ছাতু বানিয়ে দেব তোর মাথার হাড়-মাংস।
    গোলগোমী যুবতীরা অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। একজন আগে বেড়ে হাতজোড় করে অনুরোধ জানায়Ñ ঐ টুকুন শিশু একটানা কাজ করতে পারবে না রে। দেখ না কেমন নেতিয়ে পড়েছে! ও থাকুক বসে। টুকুন বিরাম নিক। আমরা বাড়তি খেটে নাহয় ওর কাজটুকুন করে দেবো।
চলবে না! উদ্যানপ্রহরী চিৎকার করেÑ রামশর্মার খামারে নিয়ম মানতে হবে অরে অরে। কেউ কারো কাজ করে দেবে এমন নিয়ম নাই। এই বরাহনন্দন অসুরের ছাও, যা ওঠ্! নইলে দিলাম ঘা।
অসহায় মেয়েটা বিড় বিড় করে অভিশাপ দেয়Ñ তোর লাঠিধরা হাতে কুষ্ঠ হবে! মাংস খসে পড়বে! চামড়া খসে পড়বে!
উদ্যানপ্রহরী ততণে বীরত্ব দেখানোর ছুতা পেয়ে গেছে। তার আগ্রহ বেড়ে গেছে শতগুণ। সে লাঠি তুলে নাচায় পপীপের নাকের ডগায়। খোঁচা মারতে যায় তার মাথায়।
ঠিক তখনই উদ্যান-দরজার কাছ থেকে চিৎকার ভেসে আসে এক পুরুষকণ্ঠেরÑ সাবধান রামশর্মার কুকুর! ঐ শিশুর গায়ে যদি তোর ষষ্টির একটা পালকস্পর্শও ঘটে, তাহলে ওটা ঢুকিয়ে দেবো তোর পশ্চাদ্দেশে।
চমকে তাকায় সবাই নতুন কণ্ঠের উৎসের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘকায় এক পুরুষ। পরনে ধুতি। গায়ে উড়নি। এমন পোশাক সচরাচর ব্রাক্ষ্মণ আর অভিজাতরা পরে। কিন্তু এই লোকের গাত্রবর্ণ বলছে সে তাদের দলে নয়। বরং সে পপীপদেরই স্বজাতি। তাকে দেখামাত্র গোলগোমী যুবতীরা সহর্ষে চেঁচিয়ে ওঠেÑ মল্ল!
তাদের দিকে তাকিয়ে একমুখ হাসি দেয় মল্ল। তারপর এগিয়ে এসে দাঁড়ায় উদ্যানপ্রহরীর একেবারে পাশে। তার হাতের লাঠি তখনো উঁচু করে ধরা। সে আসলে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। মল্ল তার হাত থেকে লাঠিটা এমন সহজে ছিনিয়ে নিল যেন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর হাত থেকে কেড়ে নিচ্ছে মোয়া। উদ্যানপ্রহরী চিঁ চিঁ করে বললÑ দ্যাখ মল্ল ভালো হবে না বলছি! শ্রী শ্রী রামশর্মা জানতে পারলে তোর...
তার কথা শেষ করতে দেয় না মল্ল। মুখে তার বিদ্রƒপ মাখানো মৃদু হাসি। বলেÑ কী করবে তোর রামশর্মা?
তোর পিঠের চামড়া তুলে নেবে।
এবার হো হো করে হেসে উঠল মল্লÑ পিঠের চামড়া তুলে নেবে। তোর এই লাঠি দিয়ে? তাহলে আগে তোর লাঠির ব্যবস্থাই করা হোক কেনে।
লাঠির দুই প্রান্ত দুই হাতে ধরল মল্ল। তারপর সবেগে নামিয়ে আনল নিজের ভাঁজকরা হাঁটুর ওপর। মটাৎ করে ভেঙ্গে দুই টুকরা হয়ে গেল লাঠি। লাঠিভাঙ্গার শব্দে আঁতকে উঠে দুই পা পিছিয়ে গেল উদ্যানপ্রহরী। আর খিলখিল করে হেসে উঠল গোলগোমী মেয়েরা। হাতের লাঠির টুকরা দুটো দুই দিকে ছুঁড়ে ফেলল মল্ল। উদ্যানপ্রহরী অস্ফুটে বলেÑ আমার এত সাধের ষষ্টি! তেল খাইয়ে খাইয়ে পাকা করেছিলাম কতদিন ধরে!
আবার হাসে মল্লÑ এবার তুই নিজে পালা এখান থেকে। তা নইলে তোকেও দুই টুকরো করে  ছুঁড়ে ফেলব তোর লাঠির মতো।
প্রহরী ততণে পুরোপুরি পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে। মিনমিন করে বলেÑ কিন্তু আমাকে যে দায়িত্ব পালন করতে হবে! তা নাহলে রামশর্মা আমাকে কর্ম থেকে তাড়িয়ে দেবে। তাহলে আমি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকব!
যা তাহলে উদ্যানের দ্বারে গিয়ে বসে থাক। সেখানে বসে বসে তোর দায়িত্ব পালন কর। ততণ আমরা দুইদণ্ড রসালাপ করি।
প্রহরী চলে যাওয়ার পরে ধুতির খুঁট থেকে কিছু ছাতু বের করল মল্ল। একজন গোলগোমীকে বললÑ নে এতে জল মিশিয়ে পুয়াটাকে টুকুন খাইয়ে দে তো! আর তুই বাবা ছাতু খেয়ে এই ছায়াতে ঘুমিয়ে পড়। তোর কাজ এরাই করে দেবে।
মেয়েরা গোল হয়ে ঘিরে বসল মল্লকেÑ তা অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি বটি?
আমি কি আর একটা জায়গাতে ছিলাম? হ্যাঁ, যদি এককথায় জিজ্ঞেস করিস যে কোথায় ছিলাম, তাহলে বলব, পথে। পথেই ছিলাম আমি। পথ থেকে পথে। এক পথ থেকে আরেক পথে।
তা কোন কোন পথে ছিলি?
ধর যে কামরূপ থেকে পথ চলতে শুরু করলাম। গেলাম সমতটে। সমতট থেকে তাম্রলিপ্তি। তাম্রলিপ্তি থেকে কর্ণসুবর্ণ। সেখান থেকে ওড্র, কঙ্গোদ, কলিঙ্গ।
মেয়েদের চোখ তখন বিস্ফারিতÑ এত এত জায়গাতে গিয়েছিলি তুই!
হ্যাঁ।
ঐসব দেশ বোধহয় মোদের পৃথিমীর বাইরে! সেইস্থানে ভূত-পেতœীরা থাকে! লয়?
না না। সেইসব দেশে যারা থাকে তারাও আমাদের মতোই মানুষ।
আমাদের মতোই!
একেবারে আমাদের মতো লয়। তা ধরগে অনেক ভিন্তা আছে। তবুও তারা মানুষই।
তারা কেমন মানুষ? ভালো মানুষ?
ভালোও আছে। খারাপও আছে।
সেখানে তুই কী করলি বটি?
আমি তো কিছু করতে যাইনি। দেখতে গিয়েছি। দেখেছি।
শুধু দেখার জন্যে কেউ এত কষ্ট করে!
কেনে সখি, শুধু দেখার জন্যেও কি অনেক কষ্ট করতে হয় না! তোমার নাগরের সাথে যখন দেখা করতে যাও, তখন কষ্ট করতে হয় না?
আবার খিলখিল হাসির দমক।
একজন হাসতে হাসতেই বলেÑ তখন কি আর কষ্টকে কষ্ট মনে হয়? তখন খালি ঘোর নেশা। মহুয়ার নেশার থেকেও বড় নেশা।
তাহলেই বোঝো।
তা তুই কোন সুন্দরীর খোঁজে গিয়েছিলি? পেয়েছিস?
না। কোথাও কোনো সুন্দরী নাই। অন্তত তোদের মতো সুন্দরী কেউ নাই। তাই তো ফিরে এলাম তোদের কাছেই।
মেয়েরা সবাই জানে মিথ্যে কথা বলছে মল্ল। তবু এখন এই মিথ্যে কথা শুনতেও তাদের খুব ভালো লাগে। মিথ্যা এত মধুর হলে সত্যের কাছে কেই-ই বা ফিরতে চায়! তাছাড়া এই দিগন্তবিস্তারি ধূসর মাটির গা বেয়ে বেয়ে বেড়ে ওঠা সবুজ ছোপ ছোপ লকলকে শাক-তরকারির গায়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া উত্তপ্ত বাতাস শরীরে জমা বিনবিনে ঘামের ওপর উষ্ণ শিহরণ তুলে দিচ্ছে, সেই সময় সুপুরুষ এক ভূমিপুত্রের সান্নিধ্য, যার কীর্তিকলাপ ইতোমধ্যেই কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যে কোনো যুবতীর কাছে সত্যের চেয়েও অনেক বেশি আকাক্সিত মনে হতে থাকে।
এক তরুণী জিজ্ঞেস করেÑ এখন থেকে তুই এখানেই থাকবি?
থাকব বলেই না এলাম!
কোথায় থাকবি?
কোথায় থাকব তাই না? বড় কঠিন প্রশ্ন। আচ্ছা তোদের মধ্যে যার ঘরে পুরুষ নাই, তার ঘরেই না হয় থাকব।
আবারও খিলখিল হাসিতে চুর চুর হয়ে ভেঙে পড়ে উদ্যানের দুপুর।
শবর তরুণী হাসতে হাসতেই বলেÑ আমাদের কতজনের ঘরেই তো পুরুষ নাই। তা তুই কার ঘরে থাকবি বটি?
তৎণাৎ উত্তর আসেÑ তোর ঘরে।
কেনে কেনে? কলকলিয়ে প্রশ্ন করে একসাথে কয়েকজন যুবতীÑ মোদের সবাইকে বাদ দিয়ে তুই ওর ঘরে থাকবি কেনে?
আড়চোখে একবার পপীপের দিকে তাকায় মল্ল। ছেলেটি পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে মাটির বিছানাতেই। অবশ্য কৈবর্ত আর কোল-ভিল-কোচদের প্রায় সকলেই যখন-তখন মাটিতেই ঘুমাতে অভ্যস্ত। ঘুমের জন্য তাদের পালকের বিছানার প্রয়োজন হয় না। মাটিই তাদের খাদ্যের উৎস, কান্তির আশ্রয়। ছেলেটা বিভোর ঘুমে তলিয়ে আছে দেখে মল্ল এবার নিশ্চিন্ত মনে তরুণীদের সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠতে পারে। সে বলেÑ শবরীর যা আছে... কথা শেষ না করেই চোখ মটকায় মল্ল।
লজ্জায় কালো চকচকে পাথরকোঁদা মুখগুলোতে সিঁদুরের রং ধরে গেছে। তবু আলোচনা থেকে পিছে হটতে সম্মত নয় মেয়েরা। একজন জোরগলায় প্রতিবাদ করেÑ ওর এমন কী আছে যা আমাদের নাই?
তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। তোদেরও আছে বটি।
তাহলে?
তা... আমতা আমতা করে মল্লÑ মুখে একবার বলে ফেলেছি যখন ওর কথা...
না না কথা ঘুরান চলবে না। বলতে হবে তোকে। বল ওকে কেন পছন্দ করলি? কী আছে ওর?
তাহলে বলছি। ওর... মানে ওর বুক যেন পাকা তাল্য ফলের সমান।
কানে আঙুল দেয় শবরী।
আর ওর ঠোঁট যেন গরমের দিনের কচি তালশাঁসের মতো মিষ্টি।
এবার লজ্জায় মাটিতে শুয়ে পড়ার উপক্রম হয় শবরীর।
ওর গায়ের বর্ণ যেন প্রায় পক্ক তাল্যগুচ্ছের মতো মৃদু বাতাসে দুলে দুলে কাছে ডাকে।
আর না! আর না! তোর পায়ে পড়ি মল্ল এবার থাম বটি তুই!
শবরীর লজ্জাকাতর নিষেধের অনুরোধ কানেই যেন যায়নি মল্লর। সে বলতে থাকেÑ আর ওর কাঁকালের ভাঁজ... আহা ওখানে একবার হাত বুলাতে পারলে... আর ওর থোড়-না-ছড়ানো কদলীবৃরে মতো উরু... আহা! আহা!
কলকলিয়ে ওঠা হাসির হররা ছোটে উদ্যান জুড়ে। হাসতে হাসতে বেতসলতার মতো নুয়ে পড়তে যায় কোনো কোনো তরুণী। একজন সেই হাসির ফাঁকে জিজ্ঞেস করেÑ এমন সব মিষ্টি মিষ্টি খারাপ কথা তুই কোত্থেকে বলতে শিখলি?
এসব কী আবার আলাদা করে শিখতে হয়! তোদের মতো সুন্দরীদের সামনে এলে এসব কথা আপনা-আপনিই মুখ থেকে ছুটে বেরুতে চায়।
তাই? কিন্তু আর কোনো পুরুষের কাছ থেকে তো আমরা এমন সব কথা শুনতে পাই না।
ভাগ্যিস সব পুরুষ এই রকমভাবে কথা বলতে পারঙ্গম হয় না! তাহলে আমার ভাত মারা যেত বটি!
এবার এত জোরে সবাই হেসে ওঠে যে গাছের ডালে ডালে বসে থাকা পাখিগুলো ভয় পেয়ে উড়তে শুরু করে। কিন্তু আচমকা হাসির তোড় তাদেরও দিকভ্রান্ত করে দিয়েছে বলে ঠিক কোন দিকে উড়ে যাবে তা যেন তারা বুঝে উঠতে পারে না। তখন শুরু হয় তাদের ভয়-পাওয়া কণ্ঠের কলকাকলি। আর সেই শব্দে জেগে ওঠে পপীপও।
মেয়েরা নিজ নিজ কাজে ফিরতে শুরু করে। এবার মল্ল মন দেয় পপীপের দিকে। জিজ্ঞেস করেÑ তুই কে বাছা?
আমি পপীপ।
এখানে কেন?
ওরা এনেছে।
রামশর্মার লোক?
জানি না।
এখানে কে আছে তোর?
একটু ইতস্তত করে পপীপ। বলেÑ বাবা আছে।
বাবার নাম কী?
বট্যপ।
ও তুই বট্যপের ছেলে। চল তোকে তোর বাবার কাছে নিয়ে যাই।
উদ্যানের মূল দরোজা দিয়ে বেরুনোর সময় প্রহরী হাত কচলায়। মল্লকে বলেÑ ছেলেটাকে এখন যেতে দিলে... আর প্রভু জানতে পারলে... আমার কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাবে রে মল্ল।
মল্ল তার কথায় কান দেয় না। বলেÑ তোর প্রভুকে বলিস এই ছেলের ভাগে যে কাজ পড়বে, তা আমি করে দেব।
পপীপের হাত ধরে বেরিয়ে আসে মল্লÑ চল তোর বাবার কাছে যাই।
পপীপ বলেÑ আমি মায়ের কাছে যাব!
সেই অনুচ্চ কণ্ঠে বলা শব্দ কয়টিতে এতই নাড়িছেঁড়া আকুতি মেখে আছে যে শোনামাত্র মল্লর দুই চোখ জলে ভরে যায়। সে হাঁটু গেড়ে বসে পপীপের সামনে। উদ্গত কান্না চাপতে চাপতে বলেÑ অবশ্যই যাবি! আমি তোকে একদিন তোর মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাব বাপ!
নির্দ্বিধায় মল্লর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে পপীপ। মল্লর অবয়বের মধ্যে এমন কিছু একটা প্রচ্ছন্ন রয়েছে যে তাকে বিশ্বাস না করার কোনো উপায়ই নেই।
কী আছে মল্লর অবয়বে?
অনেক অনেক বছর পরে, পপীপ যখন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করতে শিখবে, তখন প্রথম দেখা মল্লর অবয়বকে সে বর্ণনা করবে এইভাবেÑ ‘তার বাহুযুগল আজানুলম্বিত, স্কন্ধ অতি উন্নত, গ্রীবাদেশ রেখাত্রয়ে অঙ্কিত, বস্থল অতি বিশাল, মস্তক সুগঠিত, ললাট অতি সুন্দর, জত্র“দ্বয়(কণ্ঠাস্থি) গূঢ়, হনু বিলণ স্থূল, নেত্র আকর্ণ বিস্তৃত ও বর্ণ লোহিতাভ, কৃষ্ণমৃত্তিকাতুল্য গাত্রবর্ণ। ’
এই বর্ণনা কার সাথে যেন মিলে যায়! কার সাথে?
এ তো অযোধ্যার রামের বর্ণনা! মহান রামচন্দ্র!
পপীপ ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি এনে বলবেÑ দূর কোথায় মল্ল আর কোথায় রামচন্দ্র! অমন রামসদৃশ পুরুষসিংহ কৈবর্তদের ঘরে ঘরে জন্মায়।
 
১০. পপীপ তুমি কে?

মনে রাখিস তুই হলি কৈবর্ত। কৈবর্তের জন্যে কয়েকটা লিয়ম আছে। ভগমান যেদিন কৈবর্তকে বানালেন, সেদিন থেকেই তাকে শিখিয়ে দিলেন কীভাবে সেইসব লিয়ম মেনে চলতে হবে। সেইসব লিয়ম যে মেনে চলতে পারে না, সে আসলে কৈবর্র্ত লয়। প্রথম লিয়ম, কৈবর্ত কোনোদিন অন্য কোনো জাতির মানুষকে নিজের চোখের জল দেখাবে না। তারপরের লিয়ম হলো, কারো কাছে কৈবর্ত কোনোদিন হাত পাতবে না। তারপরের লিয়ম, মুখ থেকে একবার কথা বের হলে সেই কথা থেকে দূরে হটবে না। তার জন্যে দেহ নিপাত হলে হবে, কিন্তু মুখের কথার লড়চড় হরে না। তারপর হলো, লিজের জাতির জন্যে লিজের জীবন দিতে হলে দিতে হবে। সভায় আলোচনা করার পরে, মানে পাঁচজনার পাঁচ কথা শোনার পরে কৈবর্তের মোড়ল-মণ্ডলরা যা বলবে তা অপ্রশ্নে মেনে চলতে হবে।
    পপীপের দিকে দুচোখকে তীরের ফলার মতো ধারালো করে নিয়ে তাকায় মল্লÑ বুঝতে পেরেছিস আমার কথা?
    সেই তীব্র দৃষ্টির সামনে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায় পপীপ। মুখ থেকে কথা বের হয় না। তখন  মল্লই কথা বলে আবারÑ বুঝতে পারলি কি না তাতে কিছু আসে-যায় না। মনে রাখতে হবে, আর মেনে চলতে হবে লিয়মগুলো। তাহলেই হবে।
    পপীপ তাকিয়ে থাকে মল্লর মুখের দিকে। সেই দৃষ্টিতে দেবতাকে দেখার মুগ্ধতা। মল্লর সব কথা মেনে চলতে সে সম্মত। কারণ মল্ল কথা দিয়েছে তাকে সে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। মল্লর কথা শেষ হতেই সে আবার নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেÑ মায়ের কাছে যাব!
    অবশ্যই যাবি। কিন্তু তার লগ্ন আসতে হবে রে বাপ।
    লগ্ন কী?
    যে কাজের যে সময়, সেটাই হলো তার লগ্ন বুঝলি?
বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, মাথা নাড়ে পপীপ। বুঝেছে।
এবার তাহলে যা। ঐদিকে গিয়ে খেলা করগে যা!
একা একা কি খেলা করা যায়?
সত্যিই তো! তাহলে এখন কী করা যায়?
গল্পই চালিয়ে যেতে হয়।
কৈবর্ত কী?
কৈবর্ত হলো একরকম মাটি। হ্যাঁ মাটিই। ভগবান ওলান ঠাকুর মাটি বানালেন। কারণ মাটি দেখলে তার চোখের আরাম হয়। রোদের দিকে অনেকণ তাকিয়ে থাকার পরে চোখে-মুখে ছায়া ঢাকা দিঘীর জলের ঝাপটা দিলে যে রকম শান্তি লাগে, সেই রকম আরাম। তা মাটি তো তৈরি হলো। কিন্তু মাটিরও তো সঙ্গী-সাথী চাই। তার যে বড় একা একা লাগে! তখন ওলান ঠাকুরের ইঙ্গিতে মাটির জায়গার জায়গার দানাগুলি একটার গায়ে একটা লেগে লেগে তৈরি হলো মানুষ। তাই মাটিরও যে রং, মানুষেরও সেই রং। এক বরেন্দির মাটি থেকেই তৈরি হলো কত রকমের মানুষ! কৈবর্ত হলো, কোল হলো, পুণ্ডু হলো, কোচ হলো, ভিল হলো। তাদের আলাদা আলাদা সীমানা। ওলান ঠাকুর নির্দেশ দিলেন, নিজের নিজের সীমানাতে থাকবে সবাই। ওঠাবসা, চালাচালি থাকবে, কিন্তু কেউ কারো মাটি নিয়ে খামচাখামচি করতে পারবে না। কেউ তা করেও নি। দরকারই তো ছিল না। সকলেরই তো যা যা দরকার সব ঠিক ঠিক পেয়েছিল ওলান ঠাকুরের কাছ থেকে। একসময় সকলের সবকিছু ছিল।
এই পর্যন্ত এসেই উদাস হতে থাকে মল্ল। তার কণ্ঠ মন্দ্র এবং জলভারাক্রান্ত মনে হতে থাকেÑ
কৈবর্তদের সব ছিল। সোনাফলানো মাটি ছিল। অঞ্জনলক্ষ্মী ধান ছিল। ছিল ককচি ধান। কৈজুড়ি, কেসুরভোগ, জলরাঙ্গি, চন্দ্রমণি, খয়েরশালি, খেজুরছড়ি, কিয়াপাতি, গোহোম, চড়–ইনেচা, ছিছরা, কলামচা, গুয়াশালি, ছায়ারতœ ধান। সেই ধানের ভুঁয়ে চড়াই-দোয়েলের নাচানাচি ছিল, ধানের চারার সাথে নাচারি-পাছারি ছিল উত্তরা-দণিা-পূবাল বাতাস-ঝঞ্ঝার, কৈবর্ত নারী-পুরুষের গায়ের ঘাম শুকানোর জন্যে মোদের আদিযুগের বাপ-দাদুরা আদর করে যে ফুঁ দিত, সেইসব ফুঁ-ই তো বাতাস হয়ে এসে লাগত মোদের আর মোদের সন্ততিদের গায়ে! কৈবর্তদের নদী ছিল। লাল আর ঘোলাজলের মিশেল নদী। মানুষের চামড়ার নিচ দিয়ে কত যে নদী বয়ে যায়! তাদের জলের রং লাল। তাদের আমরা বলি রক্ত। সেই রক্তের চিহ্ন নিয়ে লালজলের নদী ছিল কৈবর্তদের। তার জলে যে ঘোলা রং মিশে থাকে, তা তো কৈবর্তের গায়ের ঘাম। তাই মোদের নদী মোদের চিহ্ন মাখা। কৈবর্ত যেখানেই যাক, এক লহমায় চিনে লিবে তার লিজের নদী। যেখানে সেই শোনিত-ঘামের নদী নাই, সেটা কৈবর্তের ঘর লয়। কৈবর্তরা তাই কোনোদিন নিজেদের বরেন্দি ছেড়ে কোনো জায়গাতে যায়নি। কিন্তু বরেন্দিতে এসেছে অনেক মানুষ। মানুষ  এসেছে সূর্য উঠার দিক থেকে, মানুষ এসেছে সূর্য ডোবার দিক থেকে, মানুষ এসেছে পাহাড়-নদী-বন পেরিয়ে তবিত পা নিয়ে, মানুষ এসেছে নদীর বানের সাথে যুঝতে যুঝতে পায়ের নিচে শক্ত মাটির পরশ পাওয়ার আশায়, মানুষ এসেছে নিজের বুক চেপে ধরে প্রাণদায়ী নির্মল বাতাসের আশায়, মানুষ এসেছে অন্য মানুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিরাপদ ঘরের আশায়। বরেন্দি তাদের ছায়া দিয়েছে, মায়া দিয়েছে, তস্থানে প্রলেপ দিয়েছে, শত্র“-বাঘ-সাপের হাত থেকে বাঁচানোর নিরাপত্তা দিয়েছে, অতিথিকে ভগবান জেনে ভগবানের পূজার ডালি দিয়েছে, শীতের রাতে পোয়ালজ্বালানো উম দিয়েছে, সব দিয়েছে, সব দিয়েছে, সব দিয়েছে।
আর ওরা?
ওরা ওঁত-ঘাঁত চিনে লিয়ে গোপনে গোপনে সংবাদ পাঠিয়েছে লিজেদের জাতির কাছে। ওরা জেনেছে কৈবর্তরা অস্ত্র বানাতে জানে। কিন্তু মানুষ খুনের জন্যে অস্ত্র বানায় না। শিকারের জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি একটাও অস্ত্র বানায় না কৈবর্তরা। অহেতুক অস্ত্র বানানো আর অস্ত্র শানানো কৈবর্তদের ধর্মে নিষেধ। তারা কোনোদিন কোনো মানুষের দিকে উঁচায়নি তাদের বল্লম। তারা কোনোদিন কোনো মানুষের দিকে তাক করেনি তাদের ধনুকের তীর। কৈবর্তের কাছে মানুষ অবধ্য। কৈবর্তদের এই ধর্মই অন্য মানুষদের সুযোগ এনে দিল। সেই সুযোগ ওরা গ্রহণ করল। ওরা অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল বরেন্দির ওপর। তারপর...
মল্লর বুক ফুঁড়ে বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসেÑ তারপর কত শত বৎসর যে কেটে গেল! বরেন্দি আর কৈবর্ত-বরেন্দি রইল না! কৈবর্তের বরেন্দি আর কৈবর্তের কাছে ফিরল না।
পপীপ সব কথা বুঝতে পারেনি। কিন্তু মল্লর বরেন্দি যে আর মল্লর নেই, মল্লদের নেই, তা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। আস্তে আস্তে জিজ্ঞেসের ভঙ্গিতে বলেÑ বরেন্দি আবার ফিরবে! লয়?
মল্লর উদাস ভাব কাটে নাÑ করে যে ফিরবে রে বাপ! আমার বুক যে টাটায়! আমি শিকলপরা বরেন্দির মাটিতে তিষ্টাতে পারি না। বরেন্দি মোরে বারবার তার শিকলবান্ধা দুই হাত দেখায় আর বলে হাতের শিকল মোর খুলে দে মল্ল! এই শিকলের বড় জ্বালা! বড় অপমান! শিকল খুলে দে মল্ল! কিন্তু আমি বরেন্দির কান্না দেখে নিজেও শুধু কাঁদতেই পারি। আমার তো সেই শক্তি নাই! বরেন্দির হাতের শিকল খুলে দেওয়ার শক্তি তো আমার একার নাই।
কেনে? নাই কেনে?
সে প্রশ্নের উত্তর দেয় না মল্ল। সে নিজের আগের কথাই চালিয়ে যায়Ñ বরেন্দির সেই কান্না আমি শুনতে চাই না। তাই বারবার বরেন্দি ছেড়ে পালাই। দূরে চলে যাই। শ্রমণদের সাথে হেঁটে হেঁটে যাই, সার্থবাহদের সাথে তাদের জলের নৌকায় ঢোল-সমুদ্দুর পাড়ি দিয়ে চলে যাই পৃথিবীর আরেক পারে, অচেনা ভাষার মানুষের সাথে অচেনা পৃথিবীতে চলে যাই, অশ্ববিক্রেতা তুড়–কদের সাথে চলে যাই তাদের দেশে... কিন্তু বরেন্দির কান্না যে আমার কানকে ্যামা দেয় না রে পপীপ, বরেন্দির কান্না আমার বুকরে যে ্যামা দেয় না রে পপীপ! বরেন্দির বুকের ওপর দুপদাপ করে হাঁটে ওরা কারা? ওদের গায়ের বণœ দেখেছিস? ওদের গায়ের বণেœ মাটির কোনো ছোপ নাই। ওদের শরীরে মাটির কোনো ছোঁয়া নাই। ওরা তাই মাটিকে ভালোবাসতে জানে না। মাটিকে পূজা করতে জানে না রে পপীপ। ওরা জানে মাটির সাথে তস্করতা করতে, মাটিকে লুঠ করতে।
ঢোল-সমুদ্দুর কোনটা? পপীপ জিজ্ঞেস করেÑ মোদের এখানে আনার সময় একটা সমুদ্দুর পার করিয়েছে কাকা। সে কী ফোঁসফোঁসানি সেই সমুদ্দুরের জলের! সেইটাই কি ঢোল-সমুদ্দুর?
মল্ল বোঝায়Ñ যে সমুদ্দুরের একপাড়ে দাঁড়িয়ে খুব জোরে জোরে ঢোল, মানে জয়ঢাক বাজালেও তার শব্দ আরেক পারে পৌঁছায় না, সেইটা হলো ঢোল-সমুদ্দুর।
শব্দ পৌঁছায় না কেনে? শব্দ কোথায় যায়?
কোথায় আবার যাবে! সমুদ্দুর লিজেই সেই শব্দ গিলে নেয়।
নদী-সমুদ্রের কথা থেকে আবার বরেন্দির কথায় ফিরে আসে পপীপÑ বরেন্দি ফের মোদের হবে! লয়?
হবেই তো। অবশ্যই হবে! বরেন্দির মাটি ঐ দস্যুদের শাপ দিচ্ছে না? সেই শাপ লাগবেই। মাটির হয়ে মাটির সন্তানরা প্রতিশোধ লিবেই লিবে। মনে রাখিস পপীপ, প্রতিশোধ লিতেই হবে তোকে-আমাকে!
তারপর কিছুণ চোখ বন্ধ করে বুদ্ধমূর্তির মতো নিশ্চল বসে থাকে মল্ল। শুধু চোখ বেয়ে অবিরল ঝরে পড়তে থাকে অশ্র“। তারপর, অনেক অনেক পল, প্রায় একটা প্রহরের সমান পল কেটে যাবার পরে যখন সে চোখ মেলে তাকায় তখন তাকে অনেকটা ধাতস্থ দেখায়। সে শান্তভাবে পপীপকে বলেÑ এইসব দস্যুদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র কোনটা তা কি জানিস পপীপ?
পপীপ কী উত্তর দেবে!
উঠে গিয়ে একটুকরো শক্ত গাছের ডাল তুলে আনে মল্ল। সেটা দিয়ে মাটির ওপর আঁকিবুকি করে। একটা চিত্র ফুটে ওঠে মাটির ওপর। সেদিকে ইঙ্গিত করে মল্ল বলেÑ ওদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এটা।
হতভম্ব পপীপ জানতে চায়Ñ ওটা কী বটি?
মল্ল কিষ্ট হাসেÑ এটা হলো অর। এটাই হলো ওদের শক্তির প্রাণভোমড়া।
অর!
হ্যাঁ। এটা দিয়ে ওরা লিখতে পারে। পড়তে পারে। লিখে রাখতে পারে বলে ওদের একজনের জ্ঞান কোনোদিন হারায় না। এই অর দিয়ে ওরা শাস্ত্র বানায়, লিয়ম বানায়। সেই শাস্ত্র দিয়ে রাজ্য চলে। এটাই ওদের প্রাণভোমড়া। তাই ওরা আমাদের কোনোদিন এই জিনিস শিখতে দিতে চায় না।
তুমি শিখলে কীভাবে?
রামশর্মার কন্যা মুকুলিকার কাছ থেকে।
সে তোমাকে শিখাল কেনে?
রামশর্মার প্রাণ বাঁচিয়েছিলাম প্রাগজোতিষের বাঘের থাবা থেকে। সেই কৃতজ্ঞতায় সে আমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নিয়ে গেল তার পরিবারের দেখশোনার জন্যে। সেখানে মুকুলিকার সঙ্গে আমার প্রেম-পিরিতি হলো। মুকুলিকাই আমাকে শিখিয়েছে।
তার কী হলো?
একদিন ধরা পড়ে গেলাম আমরা। তখন ব্রাক্ষ্মণরা বিধান দিলÑ শূদ্রপুরুষের বীর্য ধারণ করে মুকুলিকা গর্ভবতী হয়েছে। তার গর্ভের সন্তান হবে সমগ্র আর্যজাতির কলঙ্কচিহ্ন। তাই গর্ভস্থ সন্তানসহ তাকে পুড়িয়ে মারা হলো।
শিউরে  উঠল পপীপÑ আর তোমাকে কিছু বলেনি? তোমার কিছু তি করেনি?
চেষ্টার কমতি তো করেনি! চেষ্টা তো এখনো করছেই। সুযোগ পেলেই আমাকে প্রাণে মারবে ওরা। কিন্তু সরাসরি কিছু করতে পারছে না। কারণ আমি তো ওদের ক্রীতদাসও নই। ওদের রাজ্যের প্রজাও নই। ওদের শাস্ত্র আমাকে ফাঁসাতে পারছে না। শাস্ত্র না মেনে ওদেরও উপায় নাই। আসলে ওরা নিজেরাও ওদের শাস্ত্রের দাস। তাই সবসময় চেষ্টা করে আমাকে অন্য কোনোভাবে বিপদে ফেলার। কিন্তু  মল্লকে কে কী করতে পারে! গর্ব ফুটে ওঠে মল্লর কণ্ঠে। তারপরে বলেÑ সে অনেক কথা। সেসব কথা আরেকদিন বলব। এখন তোকে এই জিনিস শিখতে হবে। অর শিখতে হবে। লিখতে শিখতে হবে। পড়তে শিখতে হবে। তাহলে হয়তো তুই একদিন খুঁজে পাবি বরেন্দির শিকল ছেঁড়ার পথ।
কে শেখাবে মোরে?
আমি যতটুকু জানি শেখাব। তারপরে তোকে যেতে হবে কাহ্নপার কাছে।
সে কে?
সে জগৎগুরু। পৃথিবীর সকল বিদ্যা তার ঠোঁটের ডগায়।
তাকে কোথায় পাব?
তা তো জানি না রে বাপ। কাহ্নপা যে কখন কোথায় থাকে কেউ তা বলতে পারে না। তবে ভয় নাই। সময় হলে সে নিজেই তোকে দেখা দেবে। যদি তার মনে হয় যে তোকে তার প্রয়োজন। যদি তার মনে হয় যে তোকে বরেন্দির প্রয়োজন, তাহলে সে নিজেই তোর কাছে আসবে। তোকে সর্বশিা-মন্তর দেবে। এখন আয় তুই। তোর পাঠ নেওয়া শুরু হলো এখন থেকে।

১১. কণ্ঠ ছেনে বজ্র আনো

তারপর শুরু হয় আরেক লুকোচুরি খেলা। পূবের পাহাড় থেকে আসা বাতাসের গায়ে ভেসে ভেসে সূর্যটা তাদের দাসকুঠিরগুলোর চালায় ঠিকরে পড়ার আগেই রামশর্মার স্তোত্রপাঠ আর কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ জাগিয়ে তোলে ইুেেতর কর্মীদের। বিন্তু তারও আগেই বট্যপের ঝুপড়ির দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে মল্ল। সে আলতো ধাক্কায় জাগিয়ে দেয় পপীপকে। আর পপীপ কোনো দ্বিধা-আলস্য না করে শয্যা ছেড়ে চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে যায় মল্লর সাথে। পিতা বট্যপ ভয় পেয়েছিল। মল্ল তো সকলের কাছে ডাকাবুকো। তার খামখেয়ালিপনা আর অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে বিপদে ঝাঁপ দেওয়ার অভ্যাসের কথা সকলেরই জানা। এই রকম একজন মানুষের সংস্রব তার ছোট্ট ছেলেটার জন্য কী বিপদ ডেকে আনে কে জানে! কিন্তু মল্ল যখন জানাল যে পপীপ এই ইুেেত ক্রীতদাসত্বের জীবন কাটানোর জন্য জন্ম নেয়নি, সে সেই ব্রক্ষ্মাস্ত্র আয়ত্ত করার কাজে নিমগ্ন হয়েছে যা দিয়ে বরেন্দিকে মুক্ত করা হবে চিরতরে, তখন সবকথা না বুঝলেও আশীর্বাদ করে ছেলেকে মল্লর হাতে তুলে দিয়েছে সে।
রামশর্মার স্তোত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পপীপের পাঠগ্রহণ। একটানা চলে জলখাবারের ঘণ্টা বেজে ওঠা পর্যন্ত। জলখাবারের সময় অন্যদের সাথে পংক্তিতে বসে যবাগু(যবের মণ্ড দিয়ে তৈরি জাউ), অথবা কড়কচ্চ(লবণ) মেশানো ছাতু খায় পপীপ। সবাই নিজ নিজ কাজের দিকে অগ্রসর হলে সে আবার আলগোছে সরে পড়ে। ব্যঞ্জন-উদ্যানের প্রহরীর সাথে বলা-কওয়া আছে। সে কখনো পপীপের খোঁজ নেয় না। গোলগোমী মেয়েরা পপীপের অংশের কাজ করে দেয়। আর পপীপ চলে যায় মল্লর সাথে এখান থেকে কয়েক শত নল দূরে এক বনছাওয়া কুটিরে। সেখানে চলে পাঠাভ্যাস। একটানা দ্বিপ্রহরের আহার পর্যন্ত। দিনের পাঠ শেষ করে দুপুরে পপীপকে অন্যদের সাথে পংক্তিভোজনে পৌঁছে দিয়ে মল্ল চলে যায় অন্যত্র। কোথায় যায় জিজ্ঞেস করলে মল্ল উত্তর দেয় না। শুধু হেসে বলেÑ বড় হলে বুঝবি!
এভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন।
দুই মাস পরে পপীপের জীবনে আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটে। দ্বিপ্রহরের আহারের জন্য মল্লর সঙ্গে ইুেেত ফিরছিল সে। হঠাৎ প্রবেশ তোরণের সামনে সে থমকে দাঁড়ায়। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তোরণের সামনে টাঙানো তাম্রফলকটির দিকে। তার চোখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে জোরে জোরে। উত্তেজনায় সে দুই হাতে সর্বশক্তিতে চেপে  ধরেছে মল্লর হাতের কবজি। পপীপকে অমন করতে দেখে মল্লও থমকে যায়। জিজ্ঞেস করেÑ কী হয়েছে রে পপীপ?
পপীপ কথা বলতে যায়। কিন্তু দেখা গেল উত্তেজনায় তার কণ্ঠে শব্দ ফুটছে না। মল্ল অভয় দেবার ভঙ্গিতে তার পিঠে-মাথায় হাত বোলায়। বার বার বরাভয় দেয়। আবার জিজ্ঞেস করেÑ কী হয়েছে রে বাপ?
পপীপ এবার হাত ছাড়ে মল্লর। নিজের ছোট্ট ডান হাতটিকে পূর্ণ প্রসারিত করে তোরণের তাম্রফলকটির দিকে। তার তর্জনি তাক করা ফলকটির দিকে। তার তর্জনিকে অনুসরণ করে মল্লও তাকায় তাম্রফলকটির দিকে। রোজকার দেখা জিনিস। তার ভিন্ন কোনো বিশেষত্ব খুঁজে পায় না মল্ল। পপীপ এই সময় ফিসফিস করে বলেÑ ঐ ফলকটি মোর সাথে কথা কইছে কাকা!
এমন কথা শুনে প্রথমে মল্লও হকচকিয়ে যায়। পরণেই বুঝতে পারে পপীপের এই কথার তাৎপর্য। খুশির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার মুখমণ্ডলÑ তার মানে, তুই এখন পড়তে পারছিস কী লেখা রয়েছে ঐ তাম্রফলকটাতে তাই না?
হ্যাঁ কাকা পারছি বটি!
এবার আনন্দে মল্ল বুকে জড়িয়ে ধরে পপীপকে। তার মুখে এমন এক হাসি ফুটে ওঠে যে হাসি কেবল ফুটতে পারে সন্তানের কৃতিত্বে বুক জুড়িয়ে যাওয়া পিতার মুখে, কিংবা চূড়ান্ত পরীায় শিষ্য কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হবার পরে সদ্গুরুর মুখে, কিংবা অনেক পরিশ্রমে প্রতিকূল জলবায়ুর সাথে যুঝতে যুঝতে অবশেষে বিরূপ মাটিতে পোঁতা বীজ থেকে অংকুর গজিয়ে উঠতে দেখলে বরেন্দির কৃষকের  মুখে। হাসতে হাসতে মল্লর চোখ থেকে জল গড়াতে থাকে। সে আবেগী কান্নায় জমে যাওয়া গলায় স্বর ফোটাতে পারে কোনোক্রমেÑ নিয়েছে! বরেন্দি-মা আমার পূজা নিয়েছে! এই অধম সন্তানের নৈবেদ্য বরেন্দি-মা গ্রহণ করেছে। এবার আর আমি একা লই। এবার দুইজন হয়েছি। তারপর পাঁচজন হবো। শতজন হবো। অযুত জন হবো। তারপর বরেন্দি-মায়ের বুকের মধ্যে জলৌকার মতো গেঁথে বসে থাকা সব কাঁটা উপড়ে ফেলব! আজ যে আমার কী আনন্দ পপীপ! চল তোকে আজ অন্য এক জায়গাতে লিয়ে যাই।
কোথায় কাকা?
হাসে মল্ল। স্নেহের হাসি। বললÑ এ্যাদ্দিন তো শুধু মাটিতে আঁকা অর দেখলি। এবার সত্যিকারের পুঁথি দেখবি।
আগ্রহের আতিশয্যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে যেন পপীপেরÑ সত্যিকারের পুঁথি?
হ্যাঁ। একেবারে ভূর্জপত্রের ওপরে লেখা সুতায়-বাঁধানো পুঁথি! ব্রাক্ষ্মণদের কাছে যেসব থাকে। রাজার পাঠাগারে যেসব থাকে। বিহার-মহাবিহারগুলিতে যেসব থাকে।
ওরা মোদের পড়তে দেবে?
দূর পাগল! তাই কোনোদিন দেয়!
তাহলে?
মুকুলিকার পুঁথিগুলো লুকিয়ে রাখা আছে একজনের কাছে। তার কাছে যেতে হবে মোদের।
চলো তাহলে এুণি যাই!
যাব তো বটি। কিন্তু আধাবেলার পথ। আগে কিছু ছাতু-কড়কচ্চ লিয়ে আসি। পথে খেতে তো হবে।
কিন্তু আর যেন তর সইছিল না পপীপের। চলো কাকা এখনই যাই! ছাতুর দরকার নাই।
মল্ল হাসে। বলেÑ এখন বলছিস দরকার নাই, কিন্তু খানিক পরেই খিদে লাগলে তখন আর পা চলবে না। তার চেয়ে একটু অপো কর।
সেই ছাতু গামছাতে পেঁচিয়ে হাঁটতে শুরু করে তারা।

এমনিতেই পথে বেরুলেই নতুন কিছু দেখার প্রত্যাশায় সবসময় পপীপের চোখদুটো অনবরত চারপাশ ছাঁকতে ছাঁকতে যায়, আর এখন তারা চলেছে কামরূপের একেবারে না-দেখা অঞ্চলের দিকে। আর সাথে আছে মল্লকাকা। যে সঙ্গে থাকলে ভয়-ভাবনা কিছুই ঠাঁই পায় না কারো মনে। তাই খুশিমনে চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে হেঁটে চলে পপীপ। যা দেখে, সেটাই তার ভালো লাগে। কিন্তু হঠাৎ ওপরের দিকে তাকিয়ে আকাশের পটভূমিকায় এমন একটা জিনিস সে দেখতে পায় যে তৎণাৎ তার দৃষ্টি আটকে যায়। কিছুতেই আর অন্যদিকে চোখ সরাতে পারে না সে।
অনেকটা দূর থেকেই চোখে পড়ছিল মন্দিরের সোনাবাঁধানো চূড়া। সূর্য থেকে গলগলিয়ে নেমে আসা রোদ সেই সোনার সাথে মিশে যাচ্ছে অথবা পিছলে যাচ্ছে সোনার গায়ে আছড়ে পড়ে। যেটাই ঘটুক না কেন, চূড়ার উজ্জ্বলতা তাতে বেড়ে যাচ্ছে শতগুণে। প্রথম দৃষ্টি পড়ার পরেই পপীপের মুখ থেকে আশ্চর্যবোধকতা নিয়ে বেড়িয়ে এসেছিল সুন্দরের স্তবÑ উটা কি ভগমানের আলো কাকা?
মল্ল তিক্ত হেসে বলেÑ উটা হচ্ছে অন্য মাটি থেকে এসে মোদের কাছ থেকে বরেন্দি-পুণ্ড্র কেড়ে নেওয়া দস্যুদের বিজয়চিহ্ন।
পপীপ বুঝতে পারেনি একথার তাৎপর্য। প্রশ্ন চোখে নিয়ে কয়েকবার তাকালেও মল্ল আর কিছু বলছে না দেখে তাকেও শেষ পর্যন্ত চুপ করেই থাকতে হয়। কিন্তু সোনারঙের আকাশধাঁধানো চূড়া থেকে কিছুতেই চোখ সরাতে পারছিল না পপীপ। এঁকেবেঁকে যাওয়া হাঁটাপথ। কখনো কখনো পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহাবৃরে সুউচ্চ ডালপালা পপীপের চোখ থেকে আড়াল করে ফেলছে মন্দিরের চূড়াকে। তখন মনে মনে অধীর হয়ে উঠছে পপীপ। ওটাকে আবার দেখতে পাওয়ার আশায় বৃরে বিস্তার পেরিয়ে যাওয়ার জন্য হাঁটছে জোরে জোরে। তারপর আবার যখন চোখে পড়ছে উজ্জ্বল চূড়াটি, তখন নিজের অজান্তেই সুন্দরকে দেখার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে তার চোখও। নিজের অভিভূত অবস্থা শেষ পর্যন্ত মুখে প্রকাশ না করে পারল না পপীপ। বলে উঠলÑ মনে হচ্ছে উটা ভগমানের চোখের জ্যোতি বটি কাকা!
থমকে দাঁড়ায় মল্ল। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে পপীপের মুখ। কী যেন খুঁজছে। বিব্রত পপীপ অনুভব করতে পারছে তার মুখের ওপর চঞ্চল হয়ে ছুটে বেড়ানো মল্লর চোখের তীè দৃষ্টি। সে কি কোনো অন্যায় কথা বলে ফেলেছে? মল্ল কাকা কি অসন্তুষ্ট হয়েছে তার কথা শুনে? কিন্তু কিছুণ পরেই অনুচ্চ কণ্ঠে হেসে ওঠে মল্ল। ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকায় পপীপ। মল্লর চোখে এখন আরো বেশি স্নেহ। সেই স্নেহকে স্পর্শে রূপ দিতেই বোধকরি তার মাথায় আলতো হাত রাখে মল্লÑ তুই আসলে জম্ম-কবি বটি পপীপ।
আবার হতভম্ব হবার পালা পপীপেরÑ কবি কী বস্তু?
নিজেই বুঝবি এক সময়। চল্ এখন পা চালা! এখনো অনেক দূর যেতে হবে।

পথে একটা বড় খাল। অনেক বড় খালটি। প্রায় নদীই বলা যায়। খালের পাশে থমকে দাঁড়ায় মল্ল। খালের পাড় ধরে কিছুণ এদিক-ওদিক হাঁটে। কিন্তু পার হবার কোনো উদ্যোগ নেয় না। তার দিকে তাকায় পপীপ। মল্লকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগে মল্লই বলেÑ এই জায়গাটা একটু অন্যরকম। তুই কি বুঝতে পেরেছিস পপীপ?
ঘাড়ের দুইপাশে মাথা নাড়ে পপীপÑ না, সে কিছু বুঝতে পারছে না।
মৃদু হাসে মল্ল। সস্নেহে বলেÑ তোর বোঝার কথাও লয় অবশ্য। তোর আর কতই বা বয়স! কিন্তু তোকে খুব তাড়াতাড়ি সবকিছু শিখতে হবে বাপ। আকাশের দিকে তাকা!
মল্লকাকার নির্দেশে আকাশের দিকে তাকায় পপীপ। তাকে কিছুণ আকাশ নিরীণ করতে দেয় মল্ল। তারপর জিজ্ঞেস করেÑ কী দেখলি?
আকাশ দেখলাম। মেঘ নাই। খুব রোদ।
পাখি উড়তে দেখছিস না?
হ্যাঁ হ্যাঁ অনেক পাখি! উৎসাহিত হয়ে বলে পপীপÑ পাখিগুলো একবার নেমে আসছে খালের জলের কাছাকাছি, একবার উড়ে যাচ্ছে আকাশে। বার বার একই কাজ করছে।
ঠিক বলেছিস। মল্ল বলেÑ পাখিগুলোর খুব জলতেষ্টা পেয়েছে।
ও। তা ওরা জল খেলেই পারে। খালে তো অনেকই জল।
তা পারে। কিন্তু পাখিগুলো তো আর খালের জলে ডুব দিয়ে জল খেতে পারে না। ওদের তো এমন কোথাও বসতে হবে যেখান থেকে ওদের ঠোঁট জলের নাগাল পাবে। কিন্তু খালের পাশে তেমন কিছু তো নাই। দেখতে পাচ্ছিস?
না।
খালের পাশে অনেক গাছ থাকার কথা। সেসব গাছের হেলে-পড়া ডালে বসেই পাখিরা জল খায়। এই খালের পাশে সে রকম কোনো গাছ নেই। কোনো হেলে-পড়া ডালও নেই। আয়, একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
তাকে সাথে নিয়ে পাশের বুনো ঝোঁপগুলির দিকে হাঁটতে থাকে মল্ল। ঝোঁপের মাঝখানে দুই-একটা বৃরেও দেখা পাওয়া যাচ্ছে। ঝোঁপের কাছে পৌঁছে কিছুণ চিন্তিত ভঙ্গিতে গাছগুলির দিকে তাকিয়ে রইল মল্ল। তারপর যেন নিজেকেই শোনাচ্ছে এমন নিচুকণ্ঠে বলেÑ সঙ্গে তো কাটারি নেই রে, ডাল কাটব কীভাবে?
পপীপ কোনো উত্তর করে না।
মল্ল তরতর করে উঠে পড়ে একটা গাছের ওপর। তারপর ভাঙতে থাকে একটার পর একটা ডাল। ভেঙে ভেঙে নিচে ফেলতে থাকে। চেঁচিয়ে পপীপকে বলেÑ তুই ডালগুলোকে টেনে নিয়ে এক জায়গায় জড়ো কর পপীপ।
একটা গাছ থেকে কয়েকটা ডাল ভাঙার পরে সেটা থেকে নেমে আবার আরেকটা গাছে ওঠে মল্ল। এইভাবে গাছের ডাল ভাঙতে ভাঙতেই বেলা গড়িয়ে যেতে থাকে। পপীপ একটু অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। এইভাবে দেরি করলে যেখানে যাওয়ার কথা, আজ তো সেখানে গিয়ে পৌঁছানোই যাবে না। কিন্তু সেকথা মল্লকে বলা যায় না।
অনেকণ পরে বেশ কয়েকটি গাছের ডাল ভাঙার পরে নিরীণের দৃষ্টিতে জড়ো করা ভাঙা ডালগুলোর দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির ঢঙে মাথা ঝাঁকায় মল্ল। বিড়বিড় করে বলেÑ হ্যাঁ, এই কটা হলেই বোধহয় কাজ চলবে।
এবার পপীপকে বলেÑ ধর, একটা একটা করে টেনে খালপাড়ে নিয়ে চল।
বিনাপ্রশ্নে সেটাই করে চলে পপীপ।
সবগুলি ডাল খালপাড়ে নিয়ে আসার পড়ে পরনের কাপড় খুলে শুধু নেংটি পড়ে জলে নেমে যায় মল্ল। একটা একটা করে ডাল টেনে নিয়ে পুঁততে থাকে খালের জলের তলাকার কাদায়। পপীপ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। যখন মল্ল আদেশ করে, ডালগুলিকে একটা একটা করে এগিয়ে দেয় তার কাছে।
জলের তলায় ডাল পোঁতার কাজ শেষ হতে হতে সন্ধ্যা। ভেজা গায়ে জল থেকে উঠে এসে মল্ল সন্তুষ্টির দৃষ্টিতে দেখে এইমাত্র শেষ করা নিজের কাজটিকে। একটু দূরে দূরে পোঁতা ডালগুলিকে এখন খালের ওপর অনেকটা জায়গাজুড়ে বিছিয়ে থাকা চাদরের মতো মনে হয়। পপীপ আর কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসেÑ খালের মধ্যে গাছ লাগিয়ে কী হবে কাকা?
কই! খালের মধ্যে আমি আবার গাছ লাগালাম কখন?
একটু বিব্রত পপীপ বলেÑ এই যে ডালগুলো পুঁতে এলে। এগুলো তো গাছ হয়ে যাবে তাই না?
ও এই কথা! মল্ল হাসেÑ তা দুই-একটা ডাল হয়তো শিকড় বাড়িয়ে গাছ হয়েও যেতে পারে। কিন্তু আমি তো গাছ লাগাতে চাইনি। আমি ডালগুলোকে এখানে পুঁতেছি যাতে পাখিরা ওগুলোতে বসে জল খেতে পারে।
পাখিদের জল খাওয়ার জন্য এতকিছু করতে হবে!
করতে হবে না! আহারে জল খেতে না পেয়ে পাখিগুলো কী অসহায়ভাবে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল! ভগমানের রাজ্যে কেউ জলকষ্টে ছটফট করবে, তাই কি কোনোদিন হয়?
এ বিষয়ে আর কথা বলতে চায় না পপীপ। শুধু জিজ্ঞেস করেÑ আমরা যেখানে যাচ্ছিলাম সেখানে আজ আর যাওয়া হবে না?
একটু বিব্রত লজ্জার সাথে হাসে মল্লÑ তাই তো রে! অন্ধকার নেমে এসেছে। আজ আর সত্যিই যাওয়া যাবে না।
তাহলে পুঁথি? পপীপের কণ্ঠে হতাশা।
সে আজ হলো না, কাল হবে। কিন্তু ভেবে দ্যাখ জলকষ্টে ভগমানের এতগুলো জীব কষ্ট পাচ্ছিল। তাদের কষ্ট লাঘবের কাজ না করলে আমরা আর কীসের কৈবর্ত! ঠিক না?
পপীপ পুরোটা না বুঝেই মাথা নেড়ে সায় দেয়। বোধহয় তার ভেতরের কৈবর্তই তাকে দিয়ে কথা বলিয়ে নেয়Ñ ঠিক।      

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৪৫০, ডিসেম্বর ১১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।