ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বাংলা ভাষায় অস্ট্রেলীয় কবিতার আদি-অন্ত

ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১০
বাংলা ভাষায় অস্ট্রেলীয় কবিতার আদি-অন্ত

পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগরের ওইপারেই রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। যেন  সোজা এক সাঁতার দিলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সেখানে।

যদিও বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে সামনের দিকে তাকালে আমাদের দৃষ্টি খুঁজে পায় না নোনা পানির বাইরের কোনো দেশ! দেখা যায় নোনা স্রোতের সাথে নোনা স্রোত গায়ে গা লাগিয়ে গর্জন করতে করতে আকাশের সাথে মিশে ধূসর হয়ে আছে!

আমাদের জানতে ইচ্ছে হয় কেমন দেশ সমুদ্রের ওইপারের না-দেখা অস্ট্রেলিয়া। মিডিয়ার প্রভাবে অস্ট্রেলিয়ার সাথে আমাদের পরিচয় মূলত দুটি কারণে, প্রথমত ক্রিকেটে তাদের আধিপত্য, দ্বিতীয়ত রূপসী গাভীর দুধ। সমস্যা হচ্ছে তাদের সাহিত্য বা কবিতা সম্পর্কে আমাদের বলার মতো ধারণা নেই বললেই চলে। অস্ট্রেলিয়ান কবিতার অনুবাদও ওই অর্থে খুব একটা চোখে পড়ে না।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বের হয়েছে অংকুর সাহা, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ও সৌম্য দাশগুপ্তের সম্পাদনা ও অনুবাদে অস্ট্রেলিয়ার কবিতার অনুবাদের বই ‘কবিতা ডাউন আন্ডার’। অস্ট্রেলিয়ান কবিতার ইতিহাস সামনে রেখে বইটির উপর দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন অংকুর সাহা। এই সঙ্গে সংকলনভুক্ত কবি ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী কবিতা নিয়ে দুটি গদ্য লিখেছেন সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ।

ভূমিকা পাঠে জানা যায়, ইউরোপশাসিত ম্যাপবিজ্ঞান অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ গোলার্ধে তলার দিকে হওয়ায় ইউরোপের দেওয়া অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশেষণ রয়েছে ‘ডাউন আন্ডার’। ওই বিশেষণকে সামনে রেখেই অস্ট্রেলীয় কবিতার এই সংকলনটির নাম রাখা হয় ‘কবিতা ডাউন আন্ডার’। বইটিতে অনুবাদ করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী গান ও সেখানকার প্রথম দিকের কবিতাসহ সমসাময়িক অনেক কবির কবিতা।

অনুমান করা হয়, ব্যারন ফিল্ড [১৭৮৬-১৮৪৬] অস্ট্রেলিয়ায় ইংরেজি ভাষায় প্রথম কবিতা লেখেন ১৮১৯ সালে। সারা জীবনে মাত্র ছটি কবিতা লিখেই এই কবি অস্ট্রেলিয়ার প্রায় প্রতিটি কবিতা-সংকলনেই জায়গা করে নিয়েছেন কেবল ঐতিহাসিক মূল্যের জন্য। উল্লেখ্য, ব্যারন ফিল্ড ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন নিউ সাউথ ওয়েলসের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হয়ে, ১৮১৬ সালে। ১৮১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার সরকার তার মাত্র দুটি কবিতা নিয়ে সে দেশ থেকে প্রকাশ করে প্রথম কাব্যসংকলন `First Fruits Of Australian Poetry`। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের অনুবাদে ব্যারন ফিল্ডের একটি কবিতার প্রথম ১৪ লাইন হচ্ছে এরকম :

ক্যাঙারু, ভাই ক্যাঙারু!
তুমি অস্ট্রেলিয়ার আত্মা
এই ব্যর্থতা থেকে পরিত্রাণ
এই নির্জনতার সঙ্গী।

তোমারই জন্যে তৈরি হয়েছে
পৃথিবীর এই পঞ্চম, ঘন
মহাদেশ, যেন
নতুন জন্ম হল তার, যেন
আদিযুগে সে তো ছিল না,

(গোড়ার কাজটা ভালো লেগেছিল,
সেই প্রেরণায় ঈশ্বর, তাঁর
আপন সৃষ্টি আশীর্বাদ করেছেন)

প্রথম পাপেই উঠে এল এই উপমহাদেশ, সেই
অভিশাপ থেকে আজ এ-বন্ধ্যা জঙ্গল!

[ক্যাঙারু: ব্যারন ফিল্ড]

ভূমিকা থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটির প্রথম আবিষ্কার ঘটে প্রায় ৫০০০০ বছর আগে। তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ জলপথে সেখানে হাজির হন এবং বসবাস করতে থাকেন। খুব সম্ভবত, সে সময় অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সংস্কৃতি ছিল জটিল, গভীর ও সমৃদ্ধ। ছিল প্রকৃতির সাথে নাড়ির টান, ঈশ্বরে গভীর বিশ্বাস, কীটপতঙ্গ, পশুপাখির সঙ্গে পৃথিবীকে ভাগ করে নেওয়ার পদ্ধতি। ছিল সঙ্গীত, গাথা, পার্বণ, সঙ্গে আনুষঙ্গিক নৃত্য, বাজনা ও পূজা। তবে শ্বেতাঙ্গ মানুষের আগমনের পরই বদলে যায় সেসব।

ব্রিটিশ নাবিক জেমস কুক প্রথম অস্ট্রেলিয়া যান ১৭৭০ সালে। পরে ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে ব্রিটিশরা সেখানে হাজির হয় যুদ্ধের সাজে, ১৭৮৮ সালে। ওই সময় তারা অস্ট্রেলিয়া পৌঁছেই সেখানকার সাড়ে তিন লাখ ভূমিজ নাগরিকদের ওপর চালায় নির্মম অত্যাচার, যারা এর আদি বাসিন্দা।

বিভিন্ন সময়ে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের পটপরিবর্তনের সাথে সাথে বদল হয় অস্ট্রেলিয়ার কবিতার ভঙ্গিও।   সংকলনটি পাঠ করলে বোঝা যাবে অস্ট্রেলিয়ান কবিতার ধারাবাহিক বিবর্তন। স্পষ্ট হয়ে উঠবে আদিবাসীদের গানের সাথে পরবর্তী আধুনিক কবিদের কবিতার পার্থক্য। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের অনুবাদে একটি আদিবাসী গান হচ্ছে এরকম :

লাল-লাল গাউনটা দেখা যায় যেন প্রজাপতি
লাল-লাল গাউনটা দেখা যায় কী চমৎকার
লাল-লাল গাউনটা দেখা যায় যেন প্রজাপতি

লাল-লাল গাউনটা দেখা যায় নাচে উল্লাসে
লাল-লাল গাউনটা দেখা যায় কী চমৎকার
লাল-লাল গাউনটা দেখা যায় যেন প্রজাপতি

লাল-লাল গাউনটা দেখা যায় নাচে উল্লাসে
লাল-লাল গাউনটা দেখা যায় কী চমৎকার
লাল-লাল গাউনটা দেখা যায় যেন প্রজাপতি
লাল-লাল গাউনটা দেখা যায় নাচে উল্লাসে
[লাল গাউন]

বইটিতে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান সময়ের একজন প্রধান কবি জন ট্র্যান্টারের  সাক্ষাৎকার ও তার কয়েকটি কবিতার অনুবাদ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অংকুর সাহা। সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে ট্র্যান্টারের কবিতা-ভাবনা, শৈশব-কৈশোর, পরিবারের প্রসঙ্গসহ তার বর্তমান সাহিত্য পাঠ ও কবিতাবিষয়ক নানান বিষয়। অংকুর সাহার নেওয়া এ সাক্ষাৎকারটি সংকলনটিকে গতানুগতিকতার বাইরে নিয়ে গিয়ে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।  

সংকলনটি শেষ হয়েছে ১৯৭৮ সালে জন্ম নেওয়া চলতি দশকের কবি জয়া সাভিজের একগুচ্ছ কবিতার অনুবাদের মধ্য দিয়ে। অংকুর সাহার অনুবাদে জয়া সাভিজের ছোট্ট একটি বিদ্রূপাত্মক কবিতা হচ্ছে এরকম :
যদি সাহস থাকে
কোনো শিল্পীর আঁকা নতুন ছবি কিনুন
তারপর খুন করুন তাঁকে
হু হু করে দাম বাড়বে ছবির

[বিনিয়োগ : জয়া সাভিজ]

৩২০ পৃষ্ঠার এই অস্ট্রেলিয়ান কবিতার বইটিতে ৬টি আদিবাসীদের গানসহ প্রায় ৯৩ জন কবির কবিতার অনুবাদ ছাপা হয়েছে। অংকুর সাহা, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ও সৌম্য দাশগুপ্তের সাবলীল অনুবাদে এই বইটি আমাদের অস্ট্রেলিয়ান কবিতা সম্পর্কে জানতে এবং উপলব্ধি করতে অনেকখানি সহায়তা করবে বলে আশা করি। এমন একটি সমৃদ্ধ বই প্রকাশের জন্য অনুবাদকদের পাশাপাশি ভাষাচিত্র প্রকাশনকেও ধন্যবাদ। আর একটি কথা, দুই বাংলার কোথাও এই মহাদেশের কবিতা নিয়ে এমন আয়োজন চোখে পড়েনি।

কবিতা ডাউন আন্ডার
সম্পাদনা ও অনুবাদ : অংকুর সাহা, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ও সৌম্য দাশগুপ্ত
প্রকাশক : ভাষাচিত্র, প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা, মূল্য : ৫০০ টাকা

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০১০, ডিসেম্বর ১৩, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।