ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগজিন কোনো ভাষা ও সাহিত্যের স্বচ্ছ দর্পণ। বিশ্বের সব দেশেই সৃজনশীল সাহিত্যের বিবর্তনে ছোটকাগজগুলো উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে।
একজন প্রবাসী সাহিত্যকর্মী, বাংলাদেশ থেকে সমসাময়িক সাহিত্যবিষয়ক পত্রপত্রিকা পেলে যে কেমন আনন্দিত হন তা হয়তো প্রবাসী লেখক ছাড়া অন্য কেউ অনুমানও করতে পারবেন না।
যে যাই বলুন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে যে কিছু সিরিয়াস কাজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা স্বীকার না করে উপায় নেই। অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বুক স্টলগুলোতে গিয়ে ঢুঁ মারলে এদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলো সে বিশ্বাস আরো সুদৃঢ় করে দেয়। সাহিত্যের কাগজ বিশ্বের কোনও দেশেই মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হওয়ার কোনও সংবাদ আমার জানা নেই। সাধারণত যারা সাহিত্য বিষয়ে কাজ করেন, তারাই সাহিত্য পত্রিকাগুলো পড়েন। আর যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্ট-এর মতো প্রভাবশালী দৈনিকগুলোর বুক রিভিউ বিভাগে কোনও আলোচিত বই-এর রিভিউ বের হলে গোটা বিশ্বেই তোলপাড় লেগে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কাব্যচেতনাকে যুগ যুগ ধরে শাণিত করছে যে কটি সাহিত্য পত্রিকা,‘আমেরিকান পোয়েট্রি রিভিউ’এদের অন্যতম। গেল প্রায় চার দশক ধরে বের হচ্ছে এই পত্রিকাটি। ফিলাডেলফিয়া শহরে এর সদর দফতর। ‘আমেরিকান পোয়েট্রি রিভিউ’ প্রত্যেক সংখ্যাতেই একজন প্রতিভাবান কবিকে নিয়ে প্রচ্ছদ করে থাকে। ঐ কবির সাক্ষাতকারসহ ছাপে তার দীর্ঘ গুচ্ছকবিতা। যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক কবিরা শব্দের যে নান্দনিক ভাঙচুর করছেন তার খণ্ডচিত্র অবলোকন করা যায় এই পত্রিকায়। তাছাড়াও কবিতাকে আরো জনপ্রিয় করে তোলার জন্য এই পত্রিকাটি প্রতি বছর আয়োজন করে বেশ কয়েকটি কবিতা প্রতিযোগিতার। যার মূল্যমান কয়েক হাজার ডলার। সরকারি অনুদান ছাড়াও বিভিন্ন সমাজকল্যান সংগঠনগুলো এসব প্রতিযোগিতার কো-স্পন্সর করে থাকে। ডব্লিউ.এস.মারউইন, জেরাল্ড স্টার্ন, এডরিন রিচ, জেমস টেট-এর মতো সমসাময়িক খ্যাতিমান মার্কিনি কবিরা এসব প্রতিযোগিতার বিচারকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
‘আমেরিকান পোয়েট্রি রিভিউ’-এর কয়েকটি সংখ্যা পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক আধুনিক কবিতাগুলোর চিত্রকল্প, অনুপ্রাস এবং ব্যঞ্জনায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। অভিবাসী, অন্য ভাষাভাষি যেসব কবি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন তাদের কবিতাও অন্যভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছেপে থাকে ‘আমেরিকান পোয়েট্রি রিভিউ’। বুর্জোয়া তন্ত্রের অন্যান্য শাখাগুলোতে আমেরিকার ভূমিকা যাই হোক না কেন সাহিত্যের ক্ষেত্রে, অন্য ভাষার কবি ও তার সাহিত্য রসদকে টেনে এনে আমেরিকান মূলধারার সাথে মিশিয়ে দেয়ার যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আমেরিকান সাহিত্যকর্মীদের সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রশংসা না করে উপায় কি!
বিশিষ্ট কাব্যসাধক মি. হ্যারল্ড ব্লুম-এর একটি উক্তিকে আমি বার বার স্মরণ করি। তিনি বলেন,‘সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে স্রষ্টার স্বত্ব যখন মিশে একাকার হয়ে যায় তখনই আমরা একটি প্রকৃত কবিতার ধ্বনি শুনি। ’
এরকম কিছু চিত্রকল্প আমরা দেখি এসময়ের একজন বিশিষ্ট মার্কিন কবি মিস ডারা উয়ের-এর কবিতায়। ‘সংগঠিত জল’ কবিতায় তিনি লেখেন, ‘প্রথমে জল পড়ার শব্দের মতোই মনে হয়/যেন এক-একটি ফোঁটা পড়ছে চীনামাটির স্বচ্ছ টেবিল টপে/একটি সূর্যোজ্জ্বল সকাল যেমন একটি ছোট্ট শহরে/যেখানে একটি মুদি দোকান পর্যন্ত নেই। ’
সুস্থ সভ্যতা এবং সংস্কৃতির বিশ্বায়নে যুক্তরাষ্ট্রের কবিরা পালন করছেন অগ্রণী ভূমিকা। এমনকি অন্য ভাষার প্রতি তাদের যে আগ্রহ, যে আন্তরিকতা, তা দেখলেও মুগ্ধ হতে হয়। কবি কেনেথ কোচ তার ‘ইটালিয়ান ভাষার প্রতি’ কবিতাটির চিত্রায়ণ করেন এভাবে, ‘আমি কখনো ভুলবো না/যখন প্রথম তোমাকে আমি শুনি/এবং বুঝতে পারি কয়েকটি শব্দ/তোমাকে শিখতে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম/এবং আমি শিখেছি ...’
যুক্তরাষ্ট্রের কবি সিড করম্যান দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করছেন জাপানে। ‘আমেরিকান পোয়েট্রি রিভিউ’ জুলাই-আগস্ট ২০০০ সংখ্যায় তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার এবং একত্রিশটি ছোট ছোট কবিতা ছাপা হয়েছিল। সিড করম্যান-এর এক একটি ছোট কবিতা যেন হাজারো কথার সম্মিলিত শক্তি। এর গতিময়তা পাঠককে নিয়ে যায় একান্ত আলোর ভুবনে। প্রথম কবিতাটি হচ্ছে,‘ডাক’। ‘জীবনই কবিতা/এবং কবিতাই জীবন হে/জাগ্রত-মানুষ। ’ মাত্র তিন লাইনের কবিতাটির মতো তার প্রত্যেকটি কবিতাই যেন এক একটি মন্ত্র। ‘ডাক’ শিরোনামের তিন নম্বর কবিতাটিতে করম্যান লেখেন,‘আমরা আকাশের দিকে তাকাই/তারপর দেখার জন্য পৃথিবীর দিকে/সেখানে জানার কী আছে’।
বলছিলাম লিটল ম্যাগাজিনগুলোর কথা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব নিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন বের হয় এর সংখ্যা কয়েক হাজারের মতো। এখানেও প্রকাশিত-বিকশিত হবার পথ বড় দুর্গম। নিউ ইয়র্কের গ্রিনিচ ভিলেজ কিংবা মধ্য ম্যানহাটানের ছোট ছোট বুকশপগুলোতে গেলে দেখা যায়, কোনও প্রতিভাবান আমেরিকান তরুণ কবি হয়তো প্রকাশের সুযোগ না পেয়ে শেষ পর্যন্ত চমতকার হাতে লিখে ফটোকপি করে নিজ হাতে বাঁধাই কয়েক পৃষ্ঠা কবিতা রেখে গেছেন দোকানগুলোতে। মূল্য এক অথবা দু ডলার। হ্যাঁ, নিজেকেই নিজে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছেন কবি। আর এভাবেই এখানে উঠে এসেছেন বারবারা গেস্ট, টম ক্লার্ক, মার্ক আইরউইন, ম্যাগি অ্যান্ডারসন প্রমুখ। গেল পয়ত্রিশ বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সৃজনশীল লেখালেখিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে ‘পোয়েটস অ্যান্ডরাইটার্স’ নামের দ্বিমাসিক একটি ম্যাগাজিন। সাহিত্য সংবাদ, কবিতাবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, সাহিত্য ব্যক্তিত্বের জীবন দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে চমতকার নিবন্ধ প্রকাশ করে থাকে এ ম্যাগাজিন। সবচেয়ে সুখকর বিষয় হচ্ছে সৃজনশীল লেখক তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো সাহিত্য ম্যাগাজিন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আয়োজন করে থাকে কবিতা উৎসবের, যা পুরো বছর ধরেই চলতে থাকে। বিশেষ করে এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়টিতে বিভিন্ন কাব্যকর্ম লেগেই থাকে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে।
তুলনামূলক কম পরিচিত কবিদের মধ্যে যারা ভালো লিখছেন তাদের একজনক মিস রেচেল জুকার। থাকেন নিউ ইয়র্ক নগরীতে। তার ‘দৃষ্টি’ কবিতার কটি লাইন আমাদেরকে আলোর প্রয়োজনীয়তা আবারো স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘শাদা হরিণ শাবকের দুটি চোখ দিয়ে আমি যখন/গ্রহের গমন পথ দেখি/তখন ফ্যাকাশে আকাশ/আমাকে আবারো স্মরণ করিয়ে দেয়/এভাবে আলোহীন/এভাবে প্রেমহীন/আমাদের যাত্রা/আর যেন দীর্ঘায়িত না হয় ...’।
১৯৯৯ সালে জাতীয় কবিতা সিরিজ প্রতিযোগিতায় একজন ফাইনালিস্ট হয়েছিলেন সারাহ মাংগুসো। প্রকৃতিপ্রেমিক এই কবির কবিতায় যুক্তরাষ্ট্রের সমাজচিত্রের একটি স্থিরচিত্র পাওয়া যায়। ‘সৌন্দর্য’ কবিতায় তার বর্ণনা আমাদের বুকে লাগে : ‘প্রাচীন স্বর্ণের ধারালো সৌন্দর্য আমাকে/বিক্ষত করে বারবার/টাইম স্কোয়ারের মোড়ে/যে গৃহহীন মানুষটি না খেয়ে পড়ে আছ/ গেল দু দিন ধরে/তার একটু খোঁজ নেয়ার ফুরসতও আমার নেই ...। ’
প্রবহমান কবিতার স্রোত চলছে এবং অনন্তকাল ধরেই চলতে থাকবে। কবিতায় বলার ভঙ্গিমা, বক্তব্যের গতি হয়তো বদলাবে। বাঁক ফিরবে বার বার। কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলো কি বদলাবে? হয়তো বদলাবে না। কবি যাবে, কবি আসবে। তাইতো সেন্ট্রাল ইউরোপের প্রধান কবি, স্লোভেনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী টমাট সালামুন-এর ‘যাও’ কবিতায় নির্দেশ শুনি এভাবে, ‘যাও,/চূর্ণ করো প্রকৃত আলো এবং নিশ্চিহ্ন করে দাও/প্রকৃত আলোর উপর দাঁড়াও/এটা সেখানে, যা একটি পতাকার মতো কম্পিত হয় ...’।
নিউ ইয়র্কের ইস্ট ভিলেজের কোনও কফি শপে গেলে দেখা যাবে এখানের কবিরা কবিতা বিষয়ে আড্ডায় মত্ত। জীবন নিয়ে, প্রেমের লাভক্ষতি নিয়ে তাদের তাদের নিরীক্ষণ, চিন্তা, মানসাংক চলছে প্রতিদিন। একজন অত্যন্ত তরুণ কবি মিগাল সিরাক-এর মাত্র দু লাইনের একটি কবিতা দিয়ে আমি এ লেখাটির যবনিকা টানতে চাই। ‘বৃষ্টির জন্য ভালোবাসা’ কবিতায় তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির জল হয়ে আমি যেন অনন্তকাল ঝরতে পারি/যে বৃষ্টিকে তুমি গভীর ভালোবাসো হে প্রিয় নারী। ’
কবিতার জন্য, মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা অক্ষয় হোক দেশে দেশে, অনুকল্পে-অনুপ্রাসে।
নিউ ইয়র্ক
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৭১৫, জুলাই ১৩, ২০১০