যে ‘ধারাবাহিক অন্ধকার’ মানিকবাবুর ভিখু ও পাঁচি মাতৃগর্ভ হতে সংগ্রহ করে দেহের ভেতর লুকিয়ে পৃথিবীতে এনেছে, সে অন্ধকার সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর ভেতর গোপন রেখে যাবে ওরা, ওটা প্রাগৈতিহাসিক, এতে কারো দ্বিমতের অবকাশ নাও থাকতে পারে। পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তার নাগাল পায়নি, তাও মেনে নেয়া যায়।
সময়ের তুখোড় চিত্রনির্মাতা ভিক্টর ব্যানার্জি, দেশসুদ্ধ মানুষ যাকে আদর করে ডাকে ভিখু টু, ওর সন্দিগ্ধ চোখ সার্চলাইটের মতো আলো ফেলে জনসমে তুলে আনে ইতিহাসের অন্ধকারতম গলিঘুঁজিও। জার্মানির বন শহরের আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনীর আলোচিত ছবি ‘প্রাগৈতিহাসিক’। মানিকবাবুর গল্পের চিত্রণ নয় ওটা। তাঁর সৃষ্টির উপর কাজ করার মতো গম্যি এখনো হয়নি বলে মনে করে ভিক্টর। যেখানে মানিকবাবু ভিখুকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেখান থেকে শুরু করেছে ভিখু টু।
উনিশশো সাঁইত্রিশের অগ্নিযুগের এলোমেলো দিনের টুকরো সব ছবি, অনেক কিছুই ঝাপসা, ধীর লয়ের। একদিকে রাজানুগত ভৃত্যদের ‘লং লিভ দ্য কিং...গড সেভ দ্য কিং’ অন্যদিকে মুক্তিকামী জেদি মানুষের প্রস্তরীভূত সংকল্প- অগ্নিগোলার বিনিময়ে অগ্নিগোলা। এর ভেতর দিয়ে জেগে ওঠে রাঢ়বাংলার এক গ্রাম, আকাশে পান্ডুর চাঁদের ছায়া। নবমীর চাঁদের আলোয় কতটুকুই বা আর মেঘ দেখা যায়, সামনে ঝুঁকে ক্রমাগত পথ চলতে থাকা ভিখুও যেন মাটির বুকে ছুটে চলা এক টুকরো ঝঞ্ঝাব্ধ মেঘ! যেখানে এসে থামে ওরা, সেখানটাকে মনে হয় একটা সমুদ্র। সামনে টলটলে স্বচ্ছ কাকচু জলের প্রসারিত কল্লোল, দৃষ্টিভ্রম জাগানো ভয়াল বিস্তার। চাঁদের আলো কিছুটা উজ্জ্বল এখানে, প্রকৃতি মনে হয় নির্ভার, চলতে চলতে হঠাৎ থেমে পড়ায় ভিখুর চোখ দুটো কিছুটা আলো ঠিকরে দেয় সম্মুখের চরাচরে।
পিঠ থেকে পাঁচিকে নামানোর মতো শক্তি শরীরে অবশিষ্ট নেই ভিখুর, কিংবা কে জানে, পাঁচি ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা। এক হন্দর শস্যের একটা থলের মতো পিঠ থেকে নদীর বালুচরে গড়িয়ে ফেলে ওকে। পুলক অনুভব করে পাঁচি, হেসে ওঠে। পাশে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে থাকে ভিখু।
নবমীর চাঁদ এখন লুকিয়েছে কোথাও, ঘন অন্ধকারের ভেতর হারিয়ে যায় আরো অন্ধকার কালো মানুষ দুটো, অসীম এই অন্ধকারের ভেতর শুয়ে থেকে, অথবা ঘুমিয়ে, ভিখু স্বপ্ন দেখে ভিখুকেই। অন্ধকারের ভেতর প্রেতের ছায়ার মতো অনাদিকাল থেকে পাঁচিকে পিঠে বয়ে চলেছে ভিখু। মাঝে মাঝে মনে হয়, ও পাঁচি নয়, চৌকো এক অন্ধকার তোরঙ্গ, যার ভেতর ভিখু অচিরেই লুকিয়ে রাখবে আরো গাঢ় ও গভীর এক অন্ধকার রহস্য!
ঘুম ভাঙে অনেক দেরিতে, অবাক চোখে দেখে, শুয়ে আছে বিস্তীর্ণ এক নদীর নির্জন বালুচরে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। নদীর প্রসারিত রূপ দেখে ভিখু বোঝে এটা ঐ প্রমত্তা, কারণ, এ যে মানিকবাবুর সেই প্রিয় পদ্মা! ধারেকাছে এর যতগুলো বাঁক আছে, সবই তার চেনা, কিন্তু এবার ভুল হয়েছে ভিখুর। যেমন ভেবেছিল, সকালে ছিপতিপুরের জঙ্গলের ভেতর সারাদিনের জন্য পালিয়ে থেকে রাতে সদরে পাড়ি দেবে, তার বিপরীতে এসে পড়েছে। নদীর তীরে একটা জঙ্গল আছে বটে, কিন্তু ওপাশে সদর নয়। অবশ্য ওতে কিছু যায় আসে না। ওখানে কেউ অপো করে নেই, এখানে বরং সঙ্গে আছে পাঁচি, যাকে এখন একটা বাকশোই মনে হয়!
গঙ্গার এদিকটা একেবারে জনমানবশূন্য, ভিখু ও পাঁচি, দুজনেরই ভালো লেগে যায়। প্রাতকৃত্যের জন্য উঠে দাঁড়াতে যেয়ে ভিখু বুঝতে পারে, ভীষণ কান্ত সে। জঙ্গলের দিকে কিছুটা এগিয়ে যেয়ে আবার ফিরে আসে। বসিরের টাকাগুলো, নিজের সামান্য ভিক্ষে-সঞ্চয়, আর পাঁচির পুঁজি, সব হাতিয়ে তীরের দিকে দ্রুত হেঁটে যায়। কিছুটা ভড়কে যেয়ে শুধায় পাঁচি
কনে যাও? ঘুরে দাঁড়ায় ভিখু
তোরে থুয়ে যামু কনে?
পালাবি নে?
পালিয়েই তো এইচি।
আমি তো তোর বোঝা।
এই বোঝা মোর বাকি জনুমের!
আশঙ্কা ও বিস্ময় মেশানো এক অভিনব দৃষ্টিতে ভিখুর দিকে তাকিয়ে থাকে, মানুষের এরকম একটা মুখ জীবনে এই প্রথম দেখতে পেয়েছে পাঁচি, মুখে আর কথা সরে না, তাকিয়ে থাকে অপলক, যেন অনন্তকাল।
রোদ কিছুটা তেতে ওঠে, স্নান সেরে নিতে চায় ওরা। ভিখুকে আড়ালে যেতে বলে পাঁচি, নাছোড়বান্দার মতো বেঁকে বসেছে ভিখু, নড়ে না। কে জানে, নির্জন প্রকৃতি কি পরিবর্তন এনে দেয়, ওদের সামান্য সম্বল, সব চেয়ে ভালো কাপড়গুলো গঙ্গাজলে খুব ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার বালুচরে শুকাতে দেয়, অন্য কাপড়গুলোও পরিষ্কার করে ধুয়ে নেয়। পাঁচির দিকে এবার ভালো হাতটা বাড়ায়, পানির মধ্যে এক হাতে ওকে কাবু করা কি এতই সহজ, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, একসময় হাল ছেড়ে দেয় পাঁচি, প্রকৃতির অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের কাছে সমর্পণ করে নিজেকে।
শৈশবের স্নানের দৃশ্য সব আবছায়া মনে পড়ে ভিখুর, সেই সব দিনে আবার যেন ফিরে গেছে আজ, নোংরা চুলের জটা পানিতে ভিজে নারকেল ছোবড়ার মতো জড়িয়ে ধরে মাথায়। অনেক কসরত করেও ওটা আয়ত্তে আনতে পারে না পাঁচি। নদীর ঐ অংশে শুধু বালি। তীরে উঠে ভিখুকে খুঁজতে হয় কিছুটা এঁটেল মাটি। বিশাল এক প্রস্তরখণ্ডের মতো মাটির ঢেলা কুড়িয়ে আনে। এটাকে পানিতে ভিজিয়ে সাবান বানায়, পরস্পরকে মাখিয়ে দেয়, কালো কুচিলা মাছের মতো পিছলাতে থাকে দুজনে, দীর্ঘ স্নানের পর সূর্যনমস্কার করে ওরা। জীবনে এই প্রথম। বালুচরে শুকোনো কাপড় দুটো পরে সেঁধিয়ে যায় জঙ্গলের ভেতর। পেছন ফিরে দেখে ভিখু, এখনো জলে ভেসে রয়েছে ওর ফতুয়া ও অন্যান্য নোংরা কাপড়, শরীরের খোলস যেনো ওগুলো। অবশিষ্ট জীবনে আর কখনো ওই কেদাক্ত খোলসের ভেতর প্রবেশ করবে না ওরা।
গত রাতের কান্তির পর, পরিপূর্ণ পরিচ্ছন্নতার তৃপ্তি সবার আগে যে জৈব উপলব্ধির তাড়না সৃষ্টি করে ওদের ভেতর, তা হচ্ছে ক্ষুধার। ফলপাঁকুড় খেয়ে সারা দিন কাটিয়ে দেয়। বসিরের একশো টাকা একটা গাছের নিচে পুঁতে এভাবে চিহ্ন সব মুছে ফেলে যেন ভিখুরও দ্বিতীয়বার খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। পাঁচিকে জঙ্গলে রেখে বাকি টাকাগুলো নিয়ে কাছের গঞ্জের পথে পা বাড়ায় । বাজারে যেয়ে সন্তর্পণে কিছু কাপড়, খাবার ও একটা টিনের তোরঙ্গ কিনে ভালোয় ভালোয় ফিরে আসে। ফেরার পথে সিঁদুর ও কিছু গয়না-পাতি কিনে নেয় পাঁচির জন্য। বদ্যির দোকান থেকে এক কৌটো মলম নিতেও ভুলে না।
জঙ্গলে ফিরে অবাক হয় ভিখু। ডালপালা ভেঙ্গে রীতিমতো একটা ঘর বানিয়ে ফেলেছে পাঁচি। খুঁটির ওপর বনজ লতা দিয়ে আড়াআড়ি ডালপালা বেঁধে, গোছা গোছা কাশপাতা চাপিয়েছে ছাদের উপরে। শুকনো মরা পাতা পুরু করে নিচে বিছিয়ে শয্যা তৈরি করেছে।
দশমীর চাঁদ যেনো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আজ। কবে জুতো পরেছিল এ জীবনে, ভুলে গেছে ভিখু। চাঁদের আলোয় নতুন জুতো জোড়াও কলকলিয়ে হাসে। নুলো যে হাতটাকে ভিরে বিজ্ঞাপন বানিয়ে উদোম রাখতো, সেটাকেও ঢেকে দেয় ফুলহাতা একটা শার্টে। ধুতির মাড় না কেঁচেই শরীরে জড়িয়ে নেয়। নতুন সব পরিচ্ছদ সুড়সুড়ি দেয়। পাঁচিকেও মুড়িয়ে দেয় নতুন কাপড়ে। ওর হাতে শাঁখা পরাতে যেয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে ভিখু। কখনোই তো ওহাত দুটোয় চুড়ির ঘষা লাগেনি, হাত তো নয়, যেনো মাঁদারের খসখসে ডাল দুটো, কাঁটার মতো উঁচিয়ে আছে খোঁসপাঁচড়া। নমনীয়তা বলে তো কিছু নেই। ধস্তাধস্তি করে অবশেষে পাঁচিকে ঢোকানো সম্ভব হয় ওগুলোর ভেতর, ওখানে গড়াগড়ি খায় ওর হাড়সর্বস্ব কবজি দুটো। কালো কাইতনে বাঁধা পাঁচটা মাদুলির একটা মাদুলিমালাও যতœ করে গলায় পরিয়ে দেয়। আবারো সমস্যা দেখা দেয় কানের দুল পরাতে যেয়ে, কানে যে ফুটোই নেই, ও দুটো আঁচলে বেঁধে রাখে অগত্যা। হৈমন্তিকা দশমীর সোনার থালা চাঁদ, আর আকাশের অগুনতি তারার আলোয় সিঁথিতে সিঁদুর মেখে দেয় ভিখু। মুক্তো হয়ে জ্বলে ওঠে পাঁচির চোখ দুটো। গড় হয়ে প্রণাম করে ভিখুকে। দুজনের কাছেই এ আচরণ প্রথম ও অভিনব!
গঞ্জ থেকে আনা খাবার খেয়ে চাঁদের আলোয় এক জোড়া বাঘ ও বাঘিনীর মতো উবু হয়ে গঙ্গার স্বচ্ছ জল আকণ্ঠ পান করে ওরা, পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে, প্রাণভরে। গাওয়ার মতো কোনো গানই জানে না ভিখু, কিংবা পাঁচি, কিন্তু মনে হয় চাঁদের আলোয় সুরের বন্যায় ভেসে বেড়ায় ওরা, একের উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ অন্যের কাছে মনে হয় ভুবনভোলানো সঙ্গীত!
কাইল নওমির চান্দে পলাইছিলি না?
হ।
আইজ দশমীর রাইতে মা আইছে আমাগো মাথার উপর।
হ।
আশীর্বাদ কইরতে।
তোর পোলা অইবো।
চাই না, আইজ বিজয়া দশমী, মায়ের চরণে ঠাঁই পাইলেই বাঁচি, বহুত পাপগো আমার!
আমারও!
পাঁচির নিজের হাতে গড়া বাসরশয্যায় শুতে যায় ওরা, রাতের গভীরে, চাঁদ ডুবে গেলে, ভিখু লুকিয়ে রাখে পাঁচির রহস্য-গভীর তোরঙ্গে সেই ধারাবাহিক অন্ধকার! জীবনে এই প্রথম সুখী মানুষের মতো একটা রাত কাটায় ওরা। সকালে ঘুম ভেঙ্গে ভিখু দেখে অন্য জগৎ! কখন উঠেছে পাঁচি, স্নান সেরেছে, নতুন কাপড়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, বলতেও পারে না। নতুন বেশ, ভূষণ, চুল আঁচড়ে, সিঁথি সাজিয়ে, সিঁদুর মেখে, গ্রামবাংলার ভাদ্রবধূর যে মুখ, সে তো কখনোই ভিখু দেখেনি। এ কি সেই পাঁচি, যাকে সে স্বপ্নের ঘোরে পিঠে বয়ে বেড়ায় অনন্তকাল, একটা এক হন্দর শস্যের থলে!
এখানে কোথায় শুয়ে আছে সে? সকালে ঘুম ভেঙেছে কোথায় আজ! গত সকাল মনে আনতে চেষ্টা করে। মনে পড়ে না কিছুতেই। আরো আগের সকাল? কোথাও যে মিল খুঁজে পায় না। জীবনের এই আশ্চর্য উন্মোচনে বিস্ময়াভিভূত হয়ে থাকে। পাঁচির ভেতর কী দেখে ভিখু, কে জানে? ধাঁধায় পড়ে পাঁচি!
কী অমন দেখিচো গো ঠাকুর?
ঠাকুর! চমকে লাফিয়ে ওঠে ভিখু বেতের মতো।
কী বুললি?
ক্যান, ঠাকুর?
ডাকাত, বদমাশ, এক নুলো ভিখারিকে কেউ ঠাকুর ডাকতে পারে, এটা কিছুতেই মাথায় আসে না। আশ্চর্য এক জগৎ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় ওর সামনে, কোনো ধারণায়ই ছিল না এসব। ভালো হাতটা দিয়ে ওকে পাঁজাকোলা করে দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গঙ্গায়। এটাই ওর ভালোবাসার তীব্রতম বহিঃপ্রকাশ। পরিশীলিত কিছু যে ওর জানা নেই। কতণ জলকেলিতে মেতেছিলো ওরা, কেউই বুঝতে পারেনি, যখন উঠে আসে, পাঁচির সকালের শাড়ি শুকিয়ে গেছে, ভেজাটা পাল্টে আবার ওটা পরে। গঙ্গাজলে ছায়া দেখে সিঁথিতে সিঁদুর মাখে আবার। ভিখুও আরেক প্রস্থ নতুন কাপড় পরে। জলপান করতে বসে আবারও অবাক হবার পালা। কোথা থেকে খুঁজে কলাপাতা জোগাড় করেছে পাঁচি, ভেজানো চিঁড়ে ও বাতাসা ছড়িয়ে দেয় ওখানে, চিঁড়েগুলো নিশ্চয়ই শাড়ির আঁচলে বেঁধে ভিজিয়েছে। পাত্র তো নেই কোনো! সবুজ পাতায় শিউলি ফুলের মতো দেবতার প্রসাদ! চিঁড়েগুলো সারা জীবন দেখে যেতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু খিদে, সে তো দেবতারও আছে, তাই সে হাত বাড়ায়, পাঁচিকেও নিতে বলে, কিছুতেই খেতে চায় না পাঁচি।
আইজ একাদশীর দিন, আমি উপাষ দিমু গো ঠাকুর।
এই পাঁচি, তুই কি আমারে ঠাকুর ঠাকুরই ডাকপি সব সমুয়?
হ্যাঁ গো, তুমি মোর বাকি জনমের ঠাকুর।
তাইলে, তুইও আমার বাকি জনমের পাঁচু।
এভাবেই নতুন জীবনের শুরু ওদের। চমৎকার কিছু ক্যামেরার কাজ করেছে এখানে ভিক্টর। রাঢ়বাংলার রু প্রান্তর একটানা ড্র্যাগ করে, পরস্পর বিপরীত, অথচ এই বৈপরীত্যই যেন সঙ্গতিপূর্ণ, এমন টুকরো টুকরো দৃশ্য চমৎকার মোন্টাজ করে দর্শকদেরও ধাঁধায় ফেলে দেয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে রবিশঙ্করের আশ্চর্য বাদন শ্রোতাকে নিয়ে গেছে অন্য এক জগতে।
ওদের নবজন্মের তৃতীয় দিনে অবাক করা আরো কিছু ঘটে। ভিখুর মাথা নতুন ব্লেডে পরিষ্কার করে কামিয়ে দেয় পাঁচি, তারপর দাড়ি-গোঁফও। জলের উপর নিজের ছায়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে ভিখু, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে পেছনে, নিজেকে চিনে নিতে অনেক সময় লাগে। পাঁচিকেও চেনা যায় না আর। নতুন চিরুনিতে চুল আঁচড়ে, পরিষ্কার পোশাকে, পাঁচি যেন কোনোভাবে পাঁচিই নয় আর। পরিচ্ছন্ন থাকায়, এবং ওষুধ লাগানোয় পায়ের ব্যামোটাও সেরে উঠেছে, চলাফেরায় এসেছে কিশোরীর স্বাচ্ছন্দ্য ও চপলতা।
দুপুরের খাবার খেয়ে পান খাওয়ার আয়োজন করে ওরা। অনভ্যাসে বেশি চুন খেয়ে জিভ পুড়ে যায় ভিখুর, আর পাঁচির গাল। ঠোঁট দুটো এতোটাই লাল হয়ে ওঠে ওর, যে ভিখুর মাথাটা সাঁই করে ঘুরে যায়। এভাবে কদিন যেতো, কে জানে? বিকেলের ম্লান আলো আবার একটা বাঁক এনে দেয় ওদের জীবনে।
নদীতে ভেসে আসা কালো বস্তুটাকে দূর থেকে দেখে বুঝতে পারেনি ওরা। অনেকণ পর কাছে এলে বোঝে, ভেসে আসা মাঝিহীন নৌকো এটা। হয়তো দড়ি ছিঁড়ে, কিংবা শত্র“তা করে কেউ নৌকোটা ভাসিয়ে দিয়েছে। তখন কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয় ওটা। দ্রুত কটা ভাবনা বিদ্যুতের মতো মাথায় খেলে যায়, কিন্তু নৌকোটা তীর থেকে যত দূরে, তা এক হাতে সাঁতরে পেরুনো সম্ভব কিনা ভাবতে যেয়ে সব কিছু গুলিয়ে যায়। ভিখুর চোখের দিকে তাকিয়ে পাঁচি বোঝে ওর উদ্দেশ্য, প্রাণপণে বাধা দেয়, কিন্তু শেষ বারের মতো নিজের উপর ঝুঁকি নেয় ভিখু।
প্রথমে ভালো হাতটা দিয়ে, অনেক পানি ছিটিয়ে, ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় নৌকোর দিকে। অচিরেই গতি শ্লথ হয়ে আসে ওর, পেছনের পা দুটো পানির ভেতর তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে চলে, নৌকো থেকে ওর দূরত্ব বোঝা যায় না। এক সময় মনে হয় বুঝি তলিয়েই যাচ্ছে ভিখু। পাঁচির সংজ্ঞা হারানো দশা, মূর্ছা যেতে যেতে দেখে, নৌকোর পার্শ্ব ছুঁয়ে একটা হাত আড়াআড়ি আঁকড়ে ধরে আছে। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে আসে। একটু পরে দেখতে পায় আর একটা পা নৌকোটাকে ধরে ফেলেছে, তারপর পুরো মানুষটা নৌকোর খোলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়। বেশ অনেকটা সময় পরেও যখন সে উঠে বসে না, ধন্ধে পড়ে যায় পাঁচি। ভিখুকে নৌকোয় গড়িয়ে পড়তে দেখেছে, না পানিতে? চিৎকার করে ডাকতে যেয়েও থেমে যায়, উঠে বসেছে ভিখু। পাটাতনের একটা কাঠ দিয়ে নৌকোটাকে তীরের দিকে চালিয়ে আনার চেষ্টায় দাঁড় বাইতে শুরু করে প্রাণপণে।
নদী আর নৌকোর দূরত্ব কমিয়ে আনতে প্রায় আধ মাইল ভাটিতে চলে যেতে হয় ভিখুর, শেষ রে বোধ হয় আর হয় না, ওর অবিরাম চিৎকার ও ইশারার নিষেধ না মেনে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাঁচি। সাঁতরে নৌকাটা ছুঁতেই এক হাতে টেনে তোলে ওকে ভিখু। তারপর সদ্য জাল-ছাড়ানো বিশাল দুটো মাছের মতো নৌকোর খোলের ভেতর তড়পাতে থাকে। যখন কূলে ভিড়ে, গঙ্গার উভয় তীরে রাত নেমেছে জম্পেশ করে। কিছুটা টেনে হিঁচড়ে নৌকোটাকে চরে আটকে ডেরায় ফিরে আসে ওরা।
পুরানো একটা শাড়ি লম্বালম্বি ছিঁড়ে দড়ি পাকায় শক্ত করে। গাছের ডাল ভেঙ্গে খুঁটি বানিয়ে রাখে। ভোর না হতেই নৌকোটা বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেয়। খুঁটিটাও পোঁতে পানির অনেক নিচে। তীরে চিহ্ন রেখে ফিরে আসে ওরা।
নৌকোর খোঁজ নিতে কেউ আসে কিনা শুধু এজন্য আরো দুটো দিন বসে থাকে নদীর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে। চৌর্যবৃত্তি কিংবা ভিাবৃত্তির যে জীবন ছেড়ে এসেছে তার দায়, অথবা ছায়া কোনোভাবে আর নতুন জীবনে দেখতে চায় না ওরা। নিজেদের জীবনের উপর যতটা ঝুঁকি ও পরিশ্রম করে নৌকোটা উদ্ধার করেছে, তার বিনিময়ে এমনিতেই ওটার মালিকানা পেতে পারে ওরা। তারপরও সিদ্ধান্ত নেয়, নদী পেরিয়েই ওটাকে ভাসিয়ে দেবে আবার।
অতীত জীবনে শুকপকে জেনে এসেছে ভিখু, অপয়া হিসেবে, অন্ধকারেই খুঁজে পেয়েছে জীবনের সব সফলতা। জ্যোৎস্নাও যে এতো মধুর হতে পারে, কল্পনাও করতে পারেনি। আজকের পূর্ণিমায় নিস্তরঙ্গ পদ্মার বুকে ভেসে বেড়ানো এই মানুষ দুটোকে মর্ত্যরে মনে হয় না। খুব ছোট থাকতে, মনে নেই, কার কাছে স্বর্গের বর্ণনা শুনেছিল, এখন মনে হয় ওটা বোধ হয় এরকমই।
নদী পেরিয়ে আসতে সারা রাত অকান্তভাবে নৌকো বেয়ে চলে। পাটাতনের দুটো কাঠ গাছের শক্ত ডাল দিয়ে পিটিয়ে, সঙ্গে আরো দুটো সোজা ডাল জোড়া দিয়ে, দুটো বৈঠা বানিয়েছে, গলুইয়ে বসে হালের মতো একটাকে ধরে আছে যার পাঁচি, অপরটা এক হাতে টেনে চলেছে ভিখু। প্রতিকূল এই ধরণীতে, ওদের এই দীর্ঘ যাত্রা যেন কখনোই আর শেষ হবে না, আদি ও অশেষ অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধানে ছুটে চলার এই ধারাবাহিকতা, এর বুঝি শেষ নেই, কস্মিন কালেও!
সেই সময়ে, পদ্মার বুকে অসংখ্য চর ছিল, সেগুলোয় মানুষের আনাগোনা ছিল না। অনেক কটা খাঁড়ি ও বাঁক পেরিয়ে একটা জঙ্গুলে জায়গায় নেমে পড়ে অবশেষে, মানুষ জীবনের কোনো যাত্রাই যেহেতু অন্তহীন নয়।
ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর ও কান্ত মানুষ দুটো এ ধরিত্রীর কোমল ও কঠিন মাটিতে অসংলগ্ন পা ফেলে ধীরে ধীরে এগুতে থাকে। ওদের ধারণা নদী অতিক্রম করে এসেছে ওরা। কিছু দূর এগুনোর পর, অনেকটা আচমকা দেখতে পায় সামনে একটা মানুষ! প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো কারণ না থাকায় কাছে এসে লোকটা জিজ্ঞেস করে, কোথা থেকে এসেছে ওরা? কী জবাব দেবে ভিখু? ওর ঘাড়ের পেছনে বিস্তৃত পদ্মার দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে ধরে, তারপর যখন আবার জিজ্ঞেস করে, কার কাছে, কোথায় যাবে? দৃষ্টি আরো প্রসারিত হয় ওর। ঠিকই তো, এসব তো কখনো ভেবে দেখেনি। লোকটা যখন স্বগতোক্তির মতো উচ্চারণ করে, ও নদী-ভাঙ্গা? তখন ভিখুর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। তা যে জলে নয়, লোকটা বুঝতে পারে না। সেই সঙ্গে, কে জানে কেন, পাঁচিও ফুঁপিয়ে ওঠে। এবার লোকটা নিজে নিজেই নিশ্চিত হয় যে ওরা নদী-ভাঙ্গা মানুষই, কিছুটা খেঁকিয়ে ওঠে।
তা বাপু, সব নদী-ভাঙ্গারাই যদি এখানটায় উঠে আসে, তাহলে নদীটাও যে একদিন এখানে উঠে আসবে। দেখতে তো দেখি জোয়ান মাগ-মদ্দা। হাতে একখান ফুটো সুটকেস শুধু, শ্বশুর বাড়িতে জামাই এইসেচো নাকি? নদী-ভাঙ্গারা সব মাথায়, কোলে কাঁখে ঝুলিয়ে ভাঙ্গা কুলোটা পর্যন্ত নিয়ে আসে, তেনারা সব বিসর্জন দিয়ে এসেছেন! নাকি ভাঙনের সময় ফূর্তিতে ছিলেন বাবুরা? একনাগাড়ে কথা কটা বলে হেসে ওঠে লোকটা, যেন খুব একটা শাঁসিয়ে নিলো, তার পর বলে
চলে এসো আমার পিছু পিছু।
ভিখু ও পাঁচি যেন দেবতার সন্ধান পেয়ে গেছে। জন্মাবধি ঈশ্বর-অবিশ্বাসী পাঁচি মনে মনে ঈশ্বরের স্মরণ করে, ‘ঈশ্বর সহায় হও। ’
অনেকণ হাঁটার পর যেখানে নিয়ে আসে লোকটা, তা গঙ্গার অপর পাড় নয়। এখনো ভিখুরা জানে না যে নদীটা অতিক্রম করতে পারেনি ওরা, এটা হচ্ছে ছোট বকুলপুর।
হ্যাঁ, মানিকবাবুর সেই ছোট বকুলপুরই। আন্না নামে যে মেয়েটা, মানিকবাবু পরে তোয়ের করেছিলেন, সেটা ভিখুরই। আর যে বাচ্চা ছেলেটার নোংরা কাঁথা স্বেচ্ছাসেবকটার হাত ও রাইফেল নোংরা করে দিয়েছিল, সেই হচ্ছে ভিক্টর ব্যানার্জি। আমাদের ভিখু টু। মানিক বাবুর ভিখুর নাতি।
বিশ্বাস হয় না? ‘আন্না’ কেন ভিখুর মেয়ের নাম? টিকে থাকার জন্য তেতাল্লিশের দুর্ভিরে সময় ভিখুকে একবার খ্রিষ্টান হতে হয়েছিল। তখনই আন্নার জন্ম। সিস্টার ওর নাম রেখেছিল ‘আন্না’। তলস্তয়ের আন্না ক্যারেনিনার আন্না। নয়তো কি তখন কোনো হিন্দু মেয়ের নাম শখে ‘আন্না’ রাখে কেউ? কেন, মানিকবাবুর অকুতোভয় আন্না চরিত্রটাকে দেখে মনে হয় না, ও ভিখুরই মেয়ে? বিশ্বাস না হয় ভিক্টরের ছবিতে দেখবেন। বিস্তারিত আছে।
ভিক্টর তাহলে আবার ব্যানার্জি কেন? সেও তো আরেক গল্প! বাবা কেন চাকর? স্বামী কেন আসামি? এসবের মতো?
না, তা নয়। ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় প্রাণ বাঁচাতে আরেকবার মুসলমান হতে হয়েছিল ভিখুকে। তখনই আন্নার বাচ্চাটার জন্ম। নাম রাখা হয়েছিল বখতিয়ার। পরে ভিক্টর নিজেই ওটা পাল্টে ভিক্টর ব্যানার্জি নাম নেয়। গাঁজাখুরি মনে হচ্ছে? তেতাল্লিশে আন্নার জন্ম আর ছেচল্লিশে ভিক্টরের!
আমি জানি এ গল্প বিশ্বাস না করার কোনো না কোনো কারণ খুঁজে বের করবেনই আপনারা। রূপকথায় বিশ্বাস করবেন আপনারা, যাদুবাস্তবতায় বিশ্বাস করবেন, আমার কথায় বিশ্বাস করবেন কেন? সময়ের ব্যপারটা কি খুব বেশি কিছু? একুশ শতকে তো সবই সম্ভব! ভিক্টরের ছবি আপনাকে সময়ের হিসেব ভুলিয়ে দেবে। আমি নিশ্চিত যে আপনি তন্ময় হয়ে তা শুধু দেখেই যেতে থাকবেন। শুধু সময় কেন, সম্পর্কের হিসেব ছাড়াও এগিয়ে যাবেন।
সাঁইত্রিশে ভিখুর বয়স কত ছিল জানেন? একুশ। তাহলে এখন কত হতে পারে? অথচ ছবিতে দেখবেন ভিখুর শুধু গোঁফ-জোড়াই সাদা! মুখের ভাঁজগুলো কখনোই বলবে না ওর এতোটা বয়স। আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সঙ্গে স্বগতোক্তিটা শুনবেন?
‘আহারে মানিকবাবু! তুমিই না বলেছিলে মানুষ সে বাঁচিবেই! অথচ তুমি মানুষ মরে ভূত হয়েছো, সেই ভূত মরে ভূতের পো হয়েছে, কিন্তু আমি ভিখু, এখনো বেঁচে আছি। আমার দৌহিত্র আমাকে নিয়ে ছবি বানায়। তার সব খরচও আমার। আমার এখন সম্পদ কত জানো?
ভিক্টরের ছবির পর্দাজুড়ে ভিখুর গোঁফ চাড় দেয়ার দৃশ্য ঝুলে থাকে, যেন অসীম শূন্যতার ভেতর এক খণ্ড উজ্জ্বল প্রস্তর! ধীরে ধীরে ছবিটা ফেড হয়ে আসে। এখানেই কিন্তু ছবি শেষ নয়। ইন্টারমিশান।
দ্বিতীয় পর্ব আপনাকেই দেখতে হবে। কারণ ওটা সায়েন্স ফিকশন। ওতে আমার আগ্রহও তেমন নয়। ওখানে ভিখু দেখাতে চেয়েছে আলোতেও মানুষের জন্ম হতে পারে। টেস্ট টিউবে, কোন করে প্রভৃতি। অর্থাৎ অন্ধকারের ধারাবাহিকতাও কোনো না কোনো দিন ছিন্ন হবেই। ওই যে, প্রথমেই বলেছিলাম, কিন্তু কোনো দিনও পাবে না- এটা মেনে নেয়া কঠিন!
এই আর কি!
চ্যালেঞ্জ!
কামাল রাহমান
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ০০১০, জুলাই ২০, ২০১০