ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ধ্বংসের পথে কবি শেখ ফজলল করিমের স্মৃতিচিহ্ন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৪
ধ্বংসের পথে কবি শেখ ফজলল করিমের স্মৃতিচিহ্ন ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লালমনিরহাট: ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক/ কে বলে তা বহুদূর/ মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক/ মানুষেতে সুরাসুর’ হৃদয়র্স্পশী এ কবিতার রচয়িতা কবি শেখ ফজলল করিমের ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকী ২৮ সেপ্টেম্বর।

দিনটি উপলক্ষে সরকারি কোনো আয়োজন না থাকায় পরিবারের পক্ষ থেকে ছোট পরিসরে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।



এছাড়া কবির নিজ গ্রাম লালমনিরহাটের কাকিনা জনমিলন কেন্দ্রে মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও গবেষক শামসুন নাহার জামানের সম্পাদনায় কবির জীবনী নিয়ে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

এছাড়াও জেলা শহরে অবস্থিত কবি শেখ ফজলল করিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মিলাদ মাহফিল ও রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এদিকে, অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংস হতে চলেছে নিজ গ্রামে কবির অবশিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন। দখল হয়ে যাচ্ছে কবির নামে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারের জমি।

সরেজমিনে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনায় কবি শেখ ফজলল করিমের স্মৃতিবিজড়িত গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বাড়িটি।

বাড়িতে প্রবেশের পর দেখা যায়, কবির কবরের ঠিক সামনেই বিরাট এক কাঁচারি ঘর। প্রশস্থ বারান্দায় সৌখিন কাঠের কারুকাজ। কাঁচারি ঘরের চালজুড়ে মনোহরী ফুলের বাগান। নজরকাড়া এ বিশাল ঘরটিতেই কেটেছে কবির জীবন।

ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, অযত্ন আর অবহেলায় ঘরের দরজা ও চৌকাঠের ভগ্নদশা। সৌখিন কারুকাজ করা কাঠগুলো উইপোকার অত্যাচারে খ‍ঁসে খঁসে পড়ছে। ঘরের ভেতরে কাঠের দেয়ালজুড়ে কবির বেশ বড় দুটি ছবি টাঙানো।

ভেতরে আরো রয়েছে কবির ব্যবহৃত একটি জীর্ণ চেয়ার, খাট ও একটি গ্রামোফোন। ঘরটির এক কোণে একটি কাচের শোকেস। শোকেসের কাচগুলো ফেটে চৌচির। তার ভেতরে অযত্নে পড়ে আছে কবির ব্যবহৃত টুপি, দাড়ি, দোয়াত-কলম, ছোট্ট কোরআন শরীফ, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ও কিছু বোতাম। কিন্ত‍ু কবির অমূল্য এ স্মৃতি রক্ষায় নেই কোনো উদ্যোগ।

এছাড়া ঘরের মেঝেতেও সিমেন্টের প্রলেপ উঠে ছোট ছোট অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

কবি বাড়ির বর্তমান রক্ষক কবির অন্যতম প্রপুত্র ওয়াহিদুন্নবী বাংলানিউজকে বলেন, কবির স্মৃতি ধরে রাখতে চেষ্টা করছি। কিন্তু আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় সংস্কার করতে পারছি না। দীর্ঘদিন এমনি পড়ে থাকায় কবির ব্যবহৃত জিনিসগুলো নষ্ট হতে চলেছে।

সাহিত্য চর্চার সুবিধার্থে স্থানীয় জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত কবি বাড়িতে ১৮৯৬ সালে করিমস্ আহামদিয়া লাইব্রেরি নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করেছিলেন কবি। এখন তার কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট নেই।

জীবদ্দশায় সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন কবি শেখ ফজলল করিম। তিনি মোট ৫৫টি গ্রন্থ লিখেছিলেন কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে যার অনেকগুলোরই এখন আর হদিস মেলেনা।

এদিকে, ২০০৫ সালে গ্রামের বাজারে কবির নামে প্রতিষ্ঠিত হয় ফজলল করিম স্মৃতি পাঠাগার। কিন্তু এখন এর কার্যক্রম নেই বললেই চলে। সম্প্রতি পাঠাগারের প্রবেশ পথের সামনে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ জমে উঠেছে। ‍এছাড়া একটি প্রভাবশালী চক্র ইতোমধ্যে পাঠাগারের প্রবেশপথের কিছু অংশ দখলে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা সদরে কবির নামে একটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ছাড়া জেলার অন্য কোথাও তার জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয় না। তার নামে জেলার তেমন কোনো স্থাপনাও তৈরি করা হয়নি। ফলে এ প্রজন্মের অনেকেই জানে না কবি শেখ ফজলল করিম সম্পর্কে।

তবে লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের পাশে কাকিনায় কবির স্মৃতির উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। যা কবির বাড়ির দিক নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে।

১৮৮২ সালের ১৪ এপ্রিল তৎকালীন কালীগঞ্জের কাকিনা গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে কবির জন্ম। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী বিনবিনা গ্রামের গনি মোহাম্মদ সর্দারের মেয়ে বসিরন নেছা খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয় কবির।

কাকিনার মতো অজো পাঁড়াগায়ে নিজ বাড়িতে শাহাবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন কবি। তার বৈচিত্র্যময় রচনায় ফুটে উঠেছে সমসাময়িক ঘটনা, চিন্তা-চেতনা, ধর্ম-দর্শন, সাম্প্রদায়িক বিরোধ, সমাজ-সংস্কার, নারী শিক্ষাসহ সমাজ পরিবর্তন ও মননশীলতা অঙ্গীকার।

কবির উপদেশমূলক রচনা ‘পথ ও পাথেয়’ গ্রন্থের জন্য তবি পেয়েছিলেন রৌপ্য পদক। পরবর্তীতে বাংলা ১৩২৩ সনে ভারতের নদীয়া সাহিত্য পরিষদ তাকে সাহিত্য বিশারদ উপাধিতে ভূষিত করে।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে তৃষ্ণা (১৯০০), পরিত্রাণ কাব্য (১৯০৪), ভগ্নবীণা বা ইসলাম চিত্র (১৯০৪), ভুক্তি পুষ্পাঞ্জলি (১৯১১), উপন্যাস লাইলী-মজনু, শিশুতোষ সাহিত্য হারুন-আর-রশিদের গল্প, নীতিকথা চিন্তার চাষ, ধর্মবিষয়ক পথ ও পাথেয় প্রভৃতি অন্যতম।

১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি। এরপর থেকেই অরক্ষিত হয়ে পড়ে কবি শেখ ফজলল করিমের স্ম‍ৃতিচিহ্ন।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৪ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।