বাংলাদেশের আরো অসংখ্য কিশোর, বালকের মতোই বাল্যকালে সুকুমার রায়ের ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ভক্ত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। তাঁর যখন এগারো বছর বয়স, সুকুমার রায় হুট করে মারা যান।
‘মৌচাক’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সুধীরচন্দ্র সরকার। এই পত্রিকার নামকরণ করেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। ‘মৌচাক’-এর প্রথম সংখ্যার শুরুও হয় তাঁর কবিতা দিয়ে। এই পত্রিকাটি এতোই অসাধারণ ছিল যে, ‘সন্দেশ’-এর অভাব অনেকাংশেই পূরণ করতে সক্ষম হয়।
এতে লিখতেন সেসময়ের বিখ্যাত অনেকেই। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, শিল্পী চারুচন্দ্র রায়, নরেন্দ্র দেবসহ অনেকেই। সময়ে সময়ে অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন। বিখ্যাত লোকদের বাইরে কিশোর-কিশোরীদেরও নানাভাবে লেখায় উৎসাহ দিতেন সুধীরচন্দ্র। এঁদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছেন।
‘মৌচাক’ বের হওয়ার পর থেকেই এর ভক্ত বনে যান বুদ্ধদেব বসু। এর নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন তিনি। সেই সময়ে বুদ্ধদেব বসু থাকতেন নোয়াখালীতে। ছড়া, কবিতা, গল্প ইত্যাদি লিখে এলাকায় ক্ষুদে সাহিত্যিক হিসাবে বেশ নাম-ডাক হয়। তো তাঁর শখ হলো ‘মৌচাক’-এ লেখার। এর পিছনে অবশ্য মোহনলাল-শোভনলাল নামে দুই বালকের ভূমিকা ছিল। ওরা দুজনেই ‘মৌচাক’-এ গল্প লিখতো। বুদ্ধদেব বসু কোথা থেকে যেন জেনে যান, এরা দুজন তাঁর সমবয়সী। এদের লেখা যদি ‘মৌচাক’-এ ছাপা হতে পারে, তবে তাঁর লেখা কেন নয়? তিনি শুরু করলেন ‘মৌচাক’-এ লেখা পাঠানো। লেখা ছাপা হয় না, তিনিও হাল ছাড়েন না। একের পর এক লেখা পাঠাতে থাকেন মৌচাকে। শেষে যখন কোনো লেখাই ছাপা হয় না, তখন তাঁর বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে, সম্পাদক নিশ্চয় পক্ষপাতদুষ্ট একজন মানুষ। শুধুমাত্র তাঁর পরিচিত এবং খাতিরের লোকজনের লেখাই ছাপান। এই ধারণা মনে বদ্ধমূল হবার পরেই বিশাল এক চিঠি তিনি লেখেন সম্পাদক মশাইকে। এ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘আমার ছেলেবেলা’ বইতে লিখেছেন,
“মৌচাকে লেখা ছাপাবার অদম্য ইচ্ছে আমাকে পেয়ে বসলো। আমি ছুঁড়ছি তীরের পর তীর— অনবরত— কিন্তু সবগুলোই সম্পাদকের দপ্তরে ঠোক্কর খেয়ে অবিলম্বে আমারই গায়ে এসে বিঁধছে। অবশেষে একদিন লম্বা একখানা চিঠি লিখে পাঠালাম সম্পাদকমশাইকে— তিনি ‘পক্ষপাতদোষে দুষ্ট’, ‘দলের লোকের বাইরে’ লেখা নেন না, এমনি নানারকম অভিযোগ করে, যা চিরকাল দুর্বলের মুখে শোনা গিয়েছে। বলতে দোষ নেই, চিঠিখানা আমি ঠিক নিজের বুদ্ধিতে লিখিনি, লিখেছিলাম আমার বিষয়ে স্নেহান্ধ দাদামশাইয়ের নির্দেশমতো, যদিও— সন্দেহ নেই— আমারই বিক্ষোভ দেখে তিনি মাত্রাজ্ঞান হারিয়েছিলেন। ”
এটা মোটামুটি বেশ কড়া চিঠিই ছিল। বুদ্ধদেব বসুর নিজের ভাষাতেই, ‘সে-চিঠি যেমন মূঢ়, তেমনি দুর্বিনীত; যেমন উদ্ধত তেমনি কর্কশ। ’ স্বাভাবিকভাবেই সুধীরচন্দ্র খুব ভালোভাবে নেন নি এই চিঠিকে। চিঠিটা ছাপা হয় না মৌচাকে। কিন্তু পরের সংখ্যাতেই পত্রলেখককে একেবারে ধুয়ে দেন সুধীরচন্দ্র। মৌচাক অবশ্য একটা কাজ করেছিল। এই পত্রের লেখক কে— সেটা ফাঁস করে নি। (সম্পাদকের এই চিঠিটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি। মৌচাকের এই সংখ্যাটা দুষ্প্রাপ্য। )
একটা বিষয় বুদ্ধদেব বসু জানতেন না। শুধু তিনি নন, মৌচাকে তাঁর মতো অসংখ্য কিশোর লেখা পাঠাতো। উপযুক্ত নয় বলে, সেগুলো ছাপতেন না সুধীরচন্দ্র। মৌচাকের অষ্টম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় (এই সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছিল নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘দেখব এবার জগৎটাকে’) সম্পাদকের চিঠিতে তিনি লিখেছেন,
“আমাদের সবচেয়ে বেশী দুঃখ এই যে তোমাদের কাছ থেকে আমরা ভালো লেখা মোটেই পাই না। রোজই অনেক লেখা আমাদের হাতে এসে পৌঁছয় বটে কিন্তু সেগুলো ছাপাবার উপযুক্ত নয়। তোমাদের লেখা ছাপাতে পারলে আমাদের খুব আনন্দ হয়। মৌচাকের এই একটা প্রধান উদ্দেশ্য। আশা করি, এই নূতন বৎসরে তোমরা ভালো ভালো লেখা পাঠিয়ে মৌচাক পরিপূর্ণ করে তুলবে। ”
এরপর বেশ কিছুদিন চলে গেছে। বালক বুদ্ধদেব বসু এখন তরুণ। কলেজে পড়েন। খান দুয়েক বই বের হয়েছে তাঁর। মাসিকপত্রের সম্পাদনা করেন। সাহিত্যজগতে কিছুটা হলেও নামডাক হয়েছে, পরিচিতি বেড়েছে। ছুটিতে কোলকাতায় এসেছেন তিনি। তাঁর বন্ধু অচিন্ত্যকুমার বললেন যে, মৌচাকের সম্পাদক সুধীরচন্দ্র সরকার তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে চান। তারপরে কী ঘটেছিলো সেটা বুদ্ধদেব বসুর নিজের লেখাতেই শুনবো আমরা।
মৌচাকের পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বের হয়েছিলো জয়ন্তী-মৌচাক। এই সংখ্যায় লিখিতভাবে শুভ কামনা জানিয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জহরলাল নেহেরু, বিজয়লক্ষ্ণী পণ্ডিত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সি ভি রমণ, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখ। এবং সেই সাথে অতি অবশ্যই বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধব্দেব বসু সেই শুভকামনার লেখায় লিখেছেন,
“একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে কোলকাতায় এসেছি। বন্ধু অচিন্ত্যকুমার বললেন, ‘সুধীরবাবু তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান, চলো তোমাকে নিয়ে যাই। ’ একদিন দুপুর বেলা ১৫ নং কলেজ স্কোয়ারের খসখস এর পর্দ্দা ঢাকা ঘরে অচিন্ত্যকুমারের সঙ্গে প্রবেশ করলুম। সুধীরবাবু আমার কাছে মৌচাকের জন্য লেখা চাইলেন। আমি বললুম, ‘ছোটদের জন্য তো কখনো লিখিনি। ’ সুধীরবাবু বললেন, ‘লিখুন না। ’ মনে মনে ভাবলুম, দেখি না চেষ্টা করে, হয়তো পারবো। ঢাকা ফিরে গিয়েই একটি কবিতা লিখে পাঠালুম, পরের সংখ্যার প্রথমেই সেটি ছাপা হলো। মৌচাকে সেই আমার প্রথম লেখা, তারপর গদ্য-পদ্য অজস্র লেখা মৌচাকে লিখেছি তা সকলেই জানেন। ”
এই হলো ঘটনা। একদিন মাথা কুটেও যে ঘরের দরজা খুলতে পারেন নি তিনি, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে, সেই বাড়িতেই ডেকে নিয়ে ভোজ খাওয়ানো হয়েছে তাঁকে। এর পর থেকেই সুধীরচন্দ্রনাথের সাথে প্রীতির সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন বুদ্ধদেব বসু। তাঁদের এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক সুধীরচন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিল।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪