শহরটা কুয়াশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে সোডিয়াম বাতি এক বিবর্ণ ধূসর-মেরুন রঙ লেপ্টে দেয় তার সড়কগুলোতে। রাস্তার পাশেই পাবলিক লাইব্রেরি, শহীদ মিনার আর নাটকপাড়া।
‘হিরুইঞ্চিদের জন্য যদি একটাও লাইট ভালো থাকে’—এমন অভিযোগ নিয়মিত উচ্চারিত হয়। যদিও লাইটগুলো মূলত প্রেমিকদের হাতেই ভাঙা পড়ে। এইযে বিপুল আর চম্পা রিহার্সেল শেষে যখন শহীদ মিনারের পেছনের নির্জন জায়গাটায় বসতো হয়তো এই আলোর জন্য চম্পা হাতটা পর্যন্ত ধরতে দিত না। সুতরাং বিপুলও ওই বাতি ভাঙতে পারে, কিংবা নোমান অথবা সাজ্জাদ।
আজ কিন্তু প্রেম জমেনি, গতকাল এর থেকেও ঘন কুয়াশায় এই অন্ধকারে হয়তো সাজ্জাদ ও সাবরিনার, কিংবা যুথি ও নোমানের শ্বাস গাঢ় হয়ে কুয়াশার সাথে মিতালী করেছিল। ডিসেম্বরের শীতে নটায় বেশ রাত হয়ে যায়। গাছ থেকে টুপটাপ শিশির ঝরার শব্দও তখন শুনছিল বিপুল। আর হঠাৎ রাস্তায় রিক্সার টুংটাং শব্দ যেন শহরের এত বড় ইমারত দেয়ালের থেকে তার কানের পর্দাটাতেই ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলতে উঠে পড়ে লেগেছে।
‘শালা খয়বার কি দোকান বন্ধ করবে না নাকি?’
প্রায় একশো গজ দূরে দুধের হাড়ি জ্বাল দেয়া আগুন, কুয়াশায় জড়িয়ে জড়িয়ে যখন নিথর প্রায়, তার দীপ্তিতে চোখ কুঁচকানোর কোনো কারণ নেই। কিন্তু বিপুলের চোখ জ্বলে।
এইতো তখনো সন্ধ্যা বলা যায় সময়টাকে, বেটে জেলা সংবাদদাতা আরিফ তার নববধূ চম্পাকে ভেসপার পেছনে বসিয়ে হটাৎ হাজির হয়েছিল। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে বেশ জানিয়ে গেল, তার বউ চম্পাকে বিপুল নানাভাবে বিরক্ত করছে। শাসানির এক পর্যায়ে দুই একটা ধাক্কা দিলে চম্পা স্বামীকে বেশ সামলানোর ভঙ্গিতে ধরে, সেসময় চম্পার থেকে আধহাত খানেক ছোট আরিফের নাকে চম্পার বুক ঘষা খায়। এই বুক ঘষা খাওয়ার দৃশ্যটা যেন বিপুল এখন বানিয়ে ফেলল, এতক্ষণ গোটা ব্যাপারটায় যে অপমান ছিল, লজ্জা ছিল সেটা যেন এই দৃশ্যটার কারণে বিপুলকে খানিকটা বেপরোয়া বানিয়ে তোলে। এতক্ষণ তার কুয়াশার ভেতরে আত্নগোপন যেন না ঘটা কোনো ঘটনামাত্র, সেটা প্রমাণ করতেই শিস দেয়ার জন্য ঠোঁট গোল করে সে, এবং শীতের প্রকোপে তার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট কোনো শব্দ তৈরি করতে না পারায় তার বেপরোয়া হয়ে ওঠায় বিঘ্ন ঘটায়।
বিপুল-চম্পার প্রেমটা অনেকদিনের। একদিন ক্লাস এইট নাইনে পড়া এক কিশোরী, যার নাকের নিচে কিছুটা গোঁফের রেখা, আকর্ষণীয় না হয়ে ওঠা স্তন, ভীতু ভীতু চোখ নিয়ে চম্পা যেদিন তাদের ‘অগ্নি’ নাটক গোষ্ঠীতে নাম লেখাল, তখন যাত্রা দলের নায়কদের মতো ফর্সা গাল, যাতে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নীল আর সবুজের আভা ফেলে, সুদর্শন বিপুল তখন শহরের নাটক পাড়ায় দারুণ জনপ্রিয়। প্রতিদিন কত মেয়ে যে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেছে। তখন এই ভীরু ভীরু কিশোরী চম্পা আর সুদর্শন বিপুলের প্রেম হয়ে গেল। চম্পার কিশোরীবেলাকে এমত এভাবে বর্ণনা করার ভেতরে যে ‘নিন্দা’ আছে, সেটাই বা ধ্রুব ধরবেন কেন? মা মরা মেয়েটার গুণ্ডা টাইপের ভাইটা বাসায় একটা ত্রাস তৈরি করেছিল, আর বাপ মায়ের মৃত্যুর পরপর যে তার খালাকে বিয়ে করে ফেলল, তার জন্য কিশোরীর মনোজগত আক্রান্ত হলে তার খানিক ছায়া যদি মুখে পরে তাহলে এতো কথারই বা কি মানে আছে? তাবাদেও নাট্য-দলে যোগ দেবার কিছুদিন আগে চম্পার টাইফয়েড হয়েছিল, সে ব্যাপারটা হিসেবে নিতে হবে।
কেউ যেন ভেবে না বসেন বিপুল বসন্ত হয়ে রং ছড়াল, বরং বলা যেতে পারে চম্পার স্বাভাবিক যে সৌন্দর্য তা যে কারণে তখন পর্যন্ত বিকশিত হয় নাই, মেয়েবেলার সাথে জড়িয়ে থাকা যে প্রতিবন্ধক তারই কারণে। চম্পা শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়নি বরং সে স্বভাব প্রজাপতি, যার ডানা তখনও বাতাসে ভাসার কৌশল শেখেনি।
তার বখাটে ভাইটা মধ্যপ্রাচ্যে চলে যাওয়ার পর, সে যখন কলেজে— তার কটা চোখ শিখে নেয় সমস্ত ভাষা, তার ধনুক মতো ঠোঁট যখন নিঃশব্দ হাসিতে বেঁকে যেত, টানটান ছিলায় তীরের মতো সেই হাসি নাটকপাড়ায় কতজনকে বিদ্ধ করেছে, এমনকি শিল্পীদের হাত থেকে মোটামুটি বই বগলে বয়ে বেড়ানো ঢাকা-ফেরত বুদ্ধিজীবীদের হাতেও পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরের নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে, কত রথী মহারথী চম্পার সামনে বোকাবোকা হাসিতে লালায় ভিজিয়ে ফেলত তাদের উচ্চারণ।
কিন্তু এমন হুট করে তার বিপুলকে ছেড়ে বেটে ধান্দাবাজ আরিফকেই বিয়ে করতে হলো? বিপুল এবার ক্ষেপে যায়, ‘আসলেই বেশ্যা একটা’, এবং বিগত প্রেমিকা ‘বেশ্যা’ হয়ে তার কটা চোখ, উন্নত বুক, রমণীয় নিতম্ব নিয়ে বিপুলের কল্পনায় এলে বিপুল তৃপ্ত হয়। এই উত্তেজনা শীতের ভেতরে তাকে উত্তাপ দেয়। তলপেটের চাপ তাকে প্রস্রাবের প্রয়োজনে যখন দাঁড় করিয়ে দেয়, আর সব পুরুষদের মতো ওই উত্থায়ন তাকে গর্বিত করে।
দেয়ালের যেই জায়গাটায় সে প্রস্রাব করার জন্য দাঁড়ায়, সেখানে লেখা ছিল ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’— সেটাকে চ্যালেঞ্জ করে কেউ লিখেছিল ‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস’—যা এখন কুয়াশায় আর অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু বিপুল জিপার খুলতে খুলতে ক্ষমতার উৎসদ্বয়কে চ্যালেঞ্জ করে, মনেমনে। সেসময় এক বেহুদা শীত তার তলপেটে আক্রমণ করে বসলে, ক্ষমতার যে ক্ষণস্থায়িত্ব সেটা মেনে নিয়ে সে নিভে যায়। এতক্ষণ চেপে রাখার কারণেই হয়তো ওই পথে খানিকটা জ্বলুনি অনুভব করে।
এখন কিন্তু বিপুল তার সমস্ত অসহায়ত্ব মেনে নেয়, চম্পার জন্য তার বুকে ভালোবাসা উথলে ওঠে। খয়বারের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, এখন সে চোরের মতো চত্বরের গেট দিয়ে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটতে থাকে। সোডিয়াম লাইটের ঘোলা ঘোলা আলো কুয়াশায় কামড় বসিয়ে ক্ষত করতে না পারার ব্যর্থতা যেন বিপুলের চোখে তার সাধ মিটিয়ে নেয়।
বিপুলের বাবা মা নেই। যেখানে থাকে ও— বাসাটা ওদেরই, বড় ভাই যশোর চলে যাওয়ায় দখলের জন্য খুঁটি হিসেবে বিপুলকে রেখে গেছে, একটা ঘর, তার সংলগ্ন নিতিন কাকার চা পানের দোকান কেবল তাদের মালিকানায় আছে, বাকিটা বড় ভাই বেচে দিয়েছেন। বিপুল কখনোই নিজেকে বঞ্চিত ভাবে নাই, কিন্তু আজকে তার ভাইকে শঠ মনে হয়, মনে হয় তার প্রতি অন্যায় করেছে সে। এবার অন্ধকারে বিপুলের ছায়াও হারিয়ে গেলে বিপুল সত্যি সত্যি আলাদা হয়ে পড়ে। বাড়ির গলির সামনে যথারীতি নেশাখোরদের জটলা, গৃহহীন কেউ কেউ পলিথিন আর কাগজ জড়ো করে আগুন জ্বালিয়েছে। পলিথিনের কালো ধোঁয়া কিন্তু গলির মুখে কুয়াশাকে বেশ শায়েস্তা করেছে। রাত কটা? হয়তো ১১। মানুষের সঙ্গ পেয়েই বিপুল এবার কিছুটা জীবন অনুভব করে।
গোলাপি নামের মেয়েটা, যে বিপুলের ঘরের মুখোমুখি বস্তিতে থাকে। গোলাপির ব্যাপারে বিপুল সচেতন না হবার জন্য রীতিমত চেষ্টা করেছে। না করে উপায় কী? মেয়েটা বেশি মাত্রায় সরব, শরীরে ও কণ্ঠে। বিপুলের জানালা খুললেই দেখা যায় ছাপড়া ঘরের ভেতরে ওর উদ্ধত গ্রীবা, আর চোখে চোখ পড়লেও সেই চোখ না নামানো। আর বিপুল যেহেতু চম্পার প্রেমে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল, গোলাপির দিকে তাকিয়ে সাময়িক যে ভালোলাগা সেটাকে সে অল্পসময়ের মধ্যেই তাড়িয়ে দিত। গোলাপির মা যখন তাদের বাড়িতে কাজ করতো—বিপুলের মা বেঁচে থাকার সময়কার কথা—তখন পাশের যে বাড়িটা—ভাই মালাউন হওয়ার অপরাধে যেটা আধা মাগনা বেচে দেওয়া হয়—সেই বাড়িতে। গোলাপির তখন ন্যাড়া মাথা, মাথায় বিশ্রী রকমের ফোঁড়া, তার উপরে সাদা পাউডার, তাদের রান্না ঘরের সামনে একটা বাটিতে মুড়ি নিয়ে তাকে বসিয়ে দিত বিপুলের মা। বিপুল গোলাপির সেই ছবিটা দিয়ে এই অসম্ভব প্রাণবন্ত নারী হয়ে ওঠা গোলাপিকে নাকচ করে দিয়েছে।
কিন্তু আজ গোলাপি যখন চারদিকের প্রতি তুমুল তাচ্ছিল্য নিয়ে রাস্তায় নেশাখোর আর গৃহহীনদের আড্ডায় দাঁড়িয়ে ছিল—স্বাভাবিক প্রবণতায় তাকে ওই ফোঁড়াওয়ালা শিশুচিত্রে প্রতিস্থাপিত করতে গিয়েও কিছু একটা ভজগট পাকিয়ে ফেলে বিপুল। তার মায়ের শাড়ির আঁচল আর ট্রেনের ঝমঝম শব্দ মাথা আর রক্ত অধিকার করে নেয়। এবং বিপুল যা কখনোই ভাবেনি, এমনকি যখন অন্ধকারে ভীষণ লজ্জায় অন্ধকার হয়ে মিশে যেতে চাইছিল সেসময়ও তার আত্মহত্যার সাধ জাগে। আর ঘরে ফিরে সে ট্রেনে কাটা পড়ার একটা পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনাকালীন ভাবনায় তার সাম্প্রতিক অস্বচ্ছলতাও তাকে মরিয়া করে তোলে। ভোরে গোলাপির জানালা খুলে গেলে আত্মহত্যার প্রস্তুতি শুরু হয় বিপুলের।
এনজিও আপাদের সাথে খুব খাতির গোলাপির। তার একটা ব্যবস্থা আছে, পুরুষদের বন্ধ্যাকরণ প্রোগ্রামের কোন এক আপার সাথে তার একটা লেনদেন আছে। পাড়ার বহু নেশাখোরদের একহাজার টাকার ব্যবস্থা সে করে দিয়েছে নিমেষেই। সকালে উঠে বিপুল গোলাপির ছাপড়া ঘরের সামনে ঘুরঘুর করে। তার পরিকল্পনা ভীষণ নিখুঁত। আজ সন্ধ্যায় কোনো একটা ট্রেনের নিচে কাটা পড়বে সে। তার আগে দিনটা সে হালকা স্বচ্ছল ভাবে কাটিয়ে দেবে।
গোলাপি তার দিকে তাকিয়ে বলে ‘আপনিও কি লাইনে নামছেন?’ বিপুল উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করে না। গোলাপি বলে ‘বিকালের আগে তো হবে না’, বিপুল দ্বিধাবোধ করলে, গোলাপি বলে ‘আচ্ছা আপনি বসেন, আমার কিছু কাম আছে, শ্যাষ হইলে আপনাকে নিয়া যাব। ’ বিপুলের রাতজাগা ফোলা চোখ দেখে গোলাপীর মায়া হয়ে থাকতে পারে।
গোলাপির ছাপড়া ঘরে, বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে বিপুল। ঘুমের ভেতরে ট্রেনের হুইসেল শোনে। লাইনম্যানের হাতের ফ্লাগটা তার মায়ের শাড়ির আঁচল দিয়ে বানানো!
বিকেলে গোলাপি তার ঘুম ভাঙায়। ওখানে গিয়ে তাকে কী কী বলতে হবে সংক্ষিপ্তভাবে বুঝিয়ে দেয়, এবং খুব স্পষ্ট করে জানায় ২০০ টাকা কিন্তু তাকে দিতে হবে। গোলাপি আর বিপুল যখন লাইগেশন সেন্টার থেকে বের হয়, তখন সন্ধ্যা। আজ কুয়াশা পড়েনি তেমন, সোডিয়াম বাতিগুলোর হলদেটে আলো খুব মলিন মনে হচ্ছিল বিপুলের কাছে। গোলাপির পাশে হাঁটতে ভালো লাগছিল তার। কী মনে করে সে গোলাপিকে বলে ‘আইসক্রিম খাবা?’ গোলাপির চোখে দ্বিধা দেখে সে ২০০ টাকা তাকে দিয়ে দেয়। তারপর আইসক্রিম খাওয়া হলে, গোলাপি চলে যায়। বিপুল পাবলিক লাইব্রেরির দিকে হাঁটতে থাকে। নিজেকে তার আর রিক্ত লাগে না। গালে হাত দিয়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ির জন্য সে বিব্রত বোধ করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৪