ভোরের আলো ফোটার জন্য অধীর অপেক্ষা। অন্ধকারে নাকি ভুত-প্রেত, দৈত্য-দানব সব ঘুরে বেড়ায়।
ভোরে যখন ছোট্ট বোনটিকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরুতাম, তখন বাবা-মা-ঠাকুরমা ঘুমিয়ে। তাই রিকশাভাড়ার টাকা জুটত না। তা নিয়ে অবশ্য আমাদের কোনো মাথাব্যাথাও ছিল না। শিশিরভেজা শিউলির পথ মাড়িয়ে আমরা দুই ভাই-বোন অক্লান্ত হেঁটে যেতাম এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে। দু’-একজন পরিচিত মুখ, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গেও দেখা হয়ে যেত। আমরা তখন রীতিমত শিল্প-সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতাম। কেউ বলতো— অমুক মন্দিরে দুর্গাপ্রতিমার মুখটা সুন্দর হয়েছে; কিন্তু তার বাহন সিংহটা একদম বাজে হয়েছে। মনে হচ্ছে, বড় আকারের একটা বিড়াল! আর শিবঠাকুরকে এত ছোট বানিয়েছে যে, দেখাই যাচ্ছে না। আরেকজন হয়তো বলতো— পূর্বপাড়ার মন্দিরে প্রতিমা তেমন ভালো হয়নি, কিন্তু সাজিয়েছে (ডেকোরেশন) ভালো। উপসংহারে গোঁয়ারের মতো সবাই দাবি করতাম— সব মিলিয়ে নিজের পাড়ার পূজাটা সবচেয়ে ভালো হয়েছে। বলাই বাহুল্য সেই আলোচনা কখনো মতৈক্যে পৌছাতো না। তাই বলে মন কষাকষিতেও শেষ হতো না। এভাবে মফস্বল শহরের আট থেকে ১০টি পূজামণ্ডপ পরিদর্শন শেষে যখন বাড়িতে ফিরতাম, ততক্ষণে আমাদের খোঁজ শুরু হয়ে গেছে। আমার মা ভীষণ কড়া। অন্য কোনোদিন এমন ঘটনা ঘটলে তার শাস্তি যে হাতেনাতে পেতে হতো সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা দুষ্টু ভাই-বোন এটাও জানতাম, পূজার দিনে মা কিছু বলবেন না! সম্ভবত এমন কিছু একটা ধর্মীয় সংস্কার রয়েছে যে, ছোট-বড় সবার মা দেবী দুর্গা মর্ত্যে অবস্থানের সময় তিনিই সবার সাক্ষাৎ অভিভাবক। তাই তাকে টপকে অন্য কারো শাসন-বারণ ঔদ্ধত্যের পর্যায়ে পড়ে। মমতাময়ী মায়ের উপস্থিতির সেই সুবর্ণ সুযোগটা আমরা একটুও হাতছাড়া করতাম না। ফলে পূজার দিনগুলোতে খাওয়ার সময় ছাড়া বাবা-মায়েরা আমাদের হাতের নাগালেই পেতেন না।
লুকোচুরি-লুকোচুরি গল্প
ছোটবেলা থেকেই আমি কল্পনা আর পরিকল্পনা করতে বেশ ভালোবাসতাম। কোথাও হয়তো বেড়াতে গেছি, একটা কোনো দৃশ্য, মুহূর্ত বা বস্তু আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সেটা নিয়ে আমি এমনভাবে পরিবেশ-পরিস্থিতি ভুলে ডুবে যেতাম যে, তা ওই বয়সের তুলনায় অস্বাভাবিকই দেখাতো। বাবা-মাকে অনেক সময় লোকজন বলতো— ‘আপনাদের ছেলেটা এতো ভাবুক কেন? কোনো সমস্যা নাকি?’ সে যাক, পূজার প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই শুরু হতো আমার কাউন্টডাউন, আর কল্পনা-পরিকল্পনার জাল বুনে চলা। আর মাত্র পাঁচ মাস, চার মাস, তিন মাস...২৫ দিন, ২০ দিন ১৫ দিন...মহালয়া। এর মধ্যে শেষ এক মাস টানটান উত্তেজনা। একটা করে দিন কমছে, আর এগিয়ে আসছে আনন্দযজ্ঞের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
এক মাস আগে যখন দেবী প্রতিমার নির্মাণ শুরু হয়, তখন থেকেই মন্দিরে উঁকি-ঝুকি দেওয়া শুরু। কী কারণে যেন কারিগররা নির্মাণ প্রক্রিয়া দেখাতে ততটা উৎসাহী ছিলেন না। ত্রিপল দিয়ে আড়াল গড়ে তারা বাঁশ কাঠের কাঠামো তৈরি করতেন। এরপর খড় দিয়ে বানাতেন প্রাথমিক অবয়ব। তার ওপর মাটির প্রলেপ। চূড়ান্ত ধাপে রঙ দিয়ে জীবন্ত করে তোলা। তবে কারিগররা যতই বাধা দিক, বিচ্ছু বাহিনীকে কি আর ঠেকানো যায়? আমরাও চুপিচুপি ত্রিপল সরিয়ে, কারিগরের অনুপস্থিতির ফাঁকে ঠিক দেখে আসতাম—কতদূর কাজ এগুলো। রঙ করার ধাপটাকেই আমার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক মনে হতো। যেন এক জাদুকরের হাতের ছোঁয়ায় সাধারণ মাটির মূর্তি হয়ে উঠছে স্বর্গের দেব-দেবী! হয়ে উঠছে মানুষের আরাধ্য, প্রণম্য, আশ্রয়। স্বামী বিবেকানন্দ বুঝি তাই লিখেছেন— ‘পুতুল পূজা করে না হিন্দু কাঠ-মাটি দিয়ে গড়া/ মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরি হয়ে যাই আত্মহারা। ’
পূজার বাজেট ২০ টাকা!
পূজার এক মাস আগে থেকেই আমার একটি বড় কাজ ছিল টাকা জমানো। সাধারণ ঘরের ছেলে। বাবা-মা পূজায় খরচের জন্য তেমন একটা পয়সাকড়ি দিতে পারতেন না। তাই টিফিনের বরাদ্দ দুই টাকা থেকে এক টাকা করে জমাতাম পূজার জন্য। মোটামুটিভাবে ২০ টাকা জমানোর টার্গেট থাকতো। আর সেই টাকা দিয়ে আমি কী কী কিনবো তার একটা তালিকাও মনে মনে তৈরি করতাম। তখন জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলক সস্তা ছিল। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, ২০ টাকায় অনেক কিছু কেনা যেত। আসলে আমি সামর্থ্যের মধ্যেই স্বপ্নগুলোকে মেলানোর চেষ্টা করতাম। যেসব খেলনার দাম দুই থেকে পাঁচ টাকা— সেগুলোই থাকতো আমার তালিকায়। তবে প্রতিবারের তালিকায় আমার ফেভারিট ছিল স্টিলের পিস্তল আর কেরোসিনে চলা স্টিমার। কিন্তু দু’টোরই দাম ছিল ১৫ টাকা থেকে ওপরের দিকে। দু’-একবার আত্মীয়-স্বজনদের বদৌলতে বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লেও বেশিরভাগ সময় আমাকে দুর্মূল্য পিস্তল আর স্টিমারের জন্য হাপিত্যেশ করতে হয়েছে। আরো অনেক পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত কবিতায় খুঁজে পেয়েছি নিজের অনুভূতি— ‘একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনও/ লাঠি লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্কর বাড়ির ছেলেরা...। ’
দশমী মানে মন খারাপের দিন
প্রতিবার নবমীর রাতে চাইতাম— এটি হোক স্মরণকালের দীর্ঘতম রাত। কারণ এই রাত ফুরালেই খেলা শেষ। বিজয়া দশমী মানে তো মন খারাপ করা বিদায়ের গান। নবমীর রাতে তাই অনেক রাত অবধি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। হাইস্কুল পেরোনোর আগে বছরে ওই একটা দিনই আমার গভীর রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি ছিল। তারপর মন খারাপ করে প্রিয়জনকে বিদায় জানানোর আগাম কষ্ট নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। দশমীর সকালটা অবশ্য ততটা মন্দ মনে হতো না। নানারকম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে করতেই দুপুর। দশমীর দুপুরে থাকতো জম্পেশ ভোজের আয়োজন। দুর্গাপূজার সময় সাধারণত নিরামিষ খান সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। দশমীতে সেই সংযম ভেঙ্গে মাছ-মাংস-মিষ্টির নহর বয়ে যেত। বিকেল থেকে মন্দিরে-মন্দিরে শুরু হয়ে যেত বিদায় উৎসব। ঢ্যাম-কুড়-কুড় ঢাকের তালে আরতী প্রতিযোগিতা, দেবীকে সিঁদুর ছোঁয়ানো, মিষ্টিমুখ করানোসহ আরও কত কী। নারীরা একে অন্যের গালে-মুখে সিঁদুর মাখানোর খেলায় মেতে উঠতেন। দেবর-বৌদির মতো ঠাট্টার সম্পর্ক হলে ছেলেরাও বাদ যেত না। অবশেষে সন্ধ্যার পর নদীতে দেবী দুর্গা ও তার সঙ্গীদের বিসর্জন দিয়ে বাড়ি ফিরতাম। তখন কণ্ঠে থাকতো চিরচেনা স্লোগান— ‘আবার কবে?/ বছর পরে। ’
মনে হচ্ছে—এই তো সেদিনের কথা। সবকিছু প্রায় তেমনই আছে। এখনও পূজা আসে। আলোয় ঝলমল করে চারপাশ। আনন্দেও মাতি সবাই। কিন্তু শৈশবের সেই অমল অনুভূতি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তখন নানা অপ্রাপ্তির মধ্যে যা ছিল, এখন শত প্রাপ্তির মধ্যেও তাকে আর খুঁজে পাই না।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৪