একটি জৈবিক চাহিদার গল্প; রাতারাতি চারিদিকে হৈচৈ ফেলে দেয়। গল্পকারের নতুন আগমন হয় বাংলা সাহিত্যে! তাও আবার একরাতের মধ্যে।
অতএব; একটি জৈবিক চাহিদার গল্পের লেখক মজনু তালুকদার।
তিনদিন পর।
লেখক মজনু তালুকদারের ঠিকানায় ডাকযোগে একটি খাম আসে; তাতে দুই হাজার টাকাসহ একটি শুভেচ্ছা বার্তা, স্বয়ং সাহিত্য পাতার সম্পাদকের হাতে লেখা চিঠি এবং আরও বেশি বেশি লেখা পাঠানোর অনুরোধ। যা এই লেখককে আরেক রকমের গ্যাঞ্জামে ফেলে দেয়। সেলিমের চাচাতো ভাইয়ের মামাতো বোনের বান্ধবী হচ্ছে সেফালি। আত্মীয় দূরের হলেও পরিবারের যোগাযোগ অনেক দৃঢ়, সেই সুবাদে এই দুই পরিবারের মধ্যে আসা যাওয়া প্রায়শই হয়ে থাকে এবং এমন করেই সেলিমের প্রেম শুরু হয় সেফালির প্রতি, তাদের আর দোষ কী— এই রকম বয়সে প্রেম করাটা স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করে গল্পের লেখক। মোহাম্মদ সেলিমের এইটাই একমাত্র এবং প্রথম প্রেম। কারণ হিসেবে বলা যায় যে, সেলিমকে কোনো মেয়ে পছন্দ করে না কিংবা সেলিম মোহাম্মদ সেই পছন্দের বিষয়টা বোঝে না অথবা প্রকৃত পক্ষে এই সেফালি বেগমকে ছাড়া আর কাউকে সেলিম ভাবতেই পারে না। এই না ভাবতে পারাটা এমনি এমনি হয় নাই, দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ বিরাজ করায় সেলিম এবং সেফালি বেগম কাছাকাছি থাকার এবং সময় কাটানোর অনেক সময় পাইছে; পাড়ার লোকে কয় এইটা পরিবারের চালাকি! ওরা ইচ্ছা কইরা এইটা করছে, পরিবার নাকি চাইতো ওদের মধ্যে একটা বিবাহ হোক। তারও অনেক পরে, আরো অনেক সময় কেটে যাবার পর, সেলিম মোহাম্মদ সেফালিকে নিয়া বেড়াইতে যায়, চিনা বাদাম খায়, জলপাই কিংবা কূল বড়ই খায় আর খায় সেভেন আপ। সেফালি, সেলিমকে ভাই ভাই বলিয়া ডাকে, তাতে মাঝে মাঝে সেলিম বলে, ভাইয়া বলার দরকার কী? এইভাবে প্রেমের শুরু হয় মোহাম্মদ সেলিম আর সেফালি বেগমের আর সেই সাথে আমরা ঢুকে যাই একটি জৈবিক চাহিদার গল্পে। যদিও আমাদের মূল গল্প একটি জৈবিক চাহিদা নয় কিংবা সেলিম ও সেফালি বেগমও নয়— আমাদের গল্প মজনু তালুকদারকে নিয়ে!
এক এক করে তিন, সাড়ে তিন বছরের প্রেম সেফালির আর সেলিমের। এর মধ্যে নানান ধরনের বাধা আর যন্ত্রণা সইতে হয় সেলিমকে। সেলিম জানে ফুল চাইলে কাঁটা লাগবেই; এই কারণেই মুখ বুঝে সহ্য করেছে ছোট, বড়, অহেতুক, যৌক্তিক আর অযৌক্তিক সকল ঝামেলা। বস্তুত মোহাম্মদ সেলিম এই প্রথম প্রেমের প্রকৃত সুখ অনুভব করছে আর সেফালির সাথে এই বিষয়ে আলোচনায় সেফালি এমন করেই পাশ কাটাইয়া এমনভাবে নিজের নাক মুখ লজ্জায় লাল করিয়া ফেলে তাতে সেলিম নিজেই অপরাধবোধে পড়ে যায়। ফলে সেলিম নিজের মুখে সহস্রবার সেফালিকে আই লাভ ইউ
বলিলেও প্রতিউত্তরে সেফালির মুখ থেকে সেলিম কোনো দিন আই লাভ ইউ টু শোনে নাই। সেলিম মনে মনে হাসে; লজ্জা নারীর ভূষণ, প্রেমের বয়স আরেকটু হলেই হয়তো নিশ্চিত সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সব কিছু ঠিকঠাক আর হলো না যখন মজনু তালুকদারের বন্ধু জালাল উদ্দিনের আবির্ভাব হয় দৃশ্যে।
জালাল কথা বলে না, চুপচাপ ব্যাপক চাপ নিয়ে রাগি-রাগি চোখে মজনুর দিকে তাকিয়ে থাকে আর মজনু বলে আমি কী করছি? আমার কী দোষ বল তুই? জালাল বলে হারামজাদা এই গল্প তুই পত্রিকায় ছাপাইছস কেন? মজনু বলে পত্রিকাওয়ালারা চাইলে আমি কী করমু? জালাল বলে এইটা কি আমি তোরে শিখাইয়া দিমু? তুই এইটা কী করছস? মজনু বলে পত্রিকা থাইকা অগ্রিম টাকাসহ চিঠি আসলে আমি কী করমু?
আসলেই সেলিমের আর কিছুই করার ছিল না, শুধু সেফালিকে একটা চুমু দিতে চাইছিল; জৈবিক চাহিদা বলে কথা। কিন্তু সেফালি কী করে একটা পরপুরুষকে চুমু খায় এই প্রশ্ন হয়তো সেফালির কাছে তখন প্রকট হয়ে দাঁড়ায়, ফলে আপাতত সেলিমকে চুমু বিষয়ক অভিজ্ঞতা থেকে বিরত থাকতে হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে সেফালির প্রতি একই সাথে রাগ এবং ক্ষোভ তৈরি হয় সেলিমের, এবং সেই সাথে সেফালির ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে মোহাম্মদ সেলিম আরও বেশি বেশি প্রেমে পড়ে যায় সেফালি বেগমের। প্রেম চলতে থাকে। আর সম্পর্কে ফাটল ধরে মজনু আর জালালের। জালাল বলে প্রথমটা হইছে ভালো কথা কিন্তু পরে আবার দিলি ক্যান? মজনু কয় বাজারে চাহিদা থাকলে না দিয়া উপায় আছে?
উপায়-অন্ত না পাইয়া মোহাম্মদ সেলিম একদিন সেফালির বাড়িত্ যায়, সেফালির বাড়িতে কেউ ছিলও না; সেফালি মুরগিরে খাওন খাওয়াইতেছিল। সেলিম চুপি চুপি সেফালির পিছনে যাইয়া তারে জড়াইয়া ধরে আর বলে সেফু আমার সেফু। সেফালি কোনো রকমে ছাড়াইয়া দেয় সেলিমের হাত। সেলিমরে কয়, এতো অস্থির কেন? লোকে দেখলে কইবো কী? সেলিম কয় জৈবিক চাহিদা, করমু কী? করার আরো অনেক কিছুই ছিল; জালাল মজনুরে বোঝায়। জালাল কয় মজনু তোর নিয়ত ভালো না। তুই এখনই সব খুইলা বল লোকজনরে। মজনু কয় এখন এতো সাহস তুই কই পাইলি? এতো দিন কই ছিল এই সাহস? একা বাড়িতে সাহস দেখাইয়া কোনো লাভ হইলো না সেলিমের, এইবার সাহস কইরা বাড়িতে জানাইলোও সেলিম— ‘আমি সেফালিরে বিয়া করমু’। তারপরে ঘটনাটা আরো অনেক বড় কিন্তু এই গল্প যেহেতু মজনুর গল্প ফলে সেলিম আর সেফালির গল্পটা না জানলেও কোনো দোষ নাই।
সেফালির বিয়ের কথা ঠিক হইলে সেফালি বাড়ি ছাইড়া পালাইয়া যায়। সেলিম মনে দুঃখ পাইলো কিন্তু সেফালিরে ভুলে গেল না। সেফালির সন্ধানে সে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়ায়। তবুও মজনু আর জালালের সমস্যা সমাধান হয় না। তারা দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসে। তর্ক এবং সমঝোতায় আসে। কিন্তু সেলিম আর সেফালির সমঝোতা আর হয় না। সমঝোতা করে নেয় সেফালি আর শরিফা। শরিফা সেফালির পুরানো স্কুল বান্ধবী। সেলিম বোঝে না কী করে সেলিমের স্থান দখল করে নিতে পারে শরিফা। জালালকে বোঝাতে থাকে মজনু। মজনুকে বোঝায় জালাল, বলে, তার খ্যাতির নেশায় পাইছে। একটি জৈবিক চাহিদার গল্পের লেখক মজনু তালুকদার, তাই মজনু চায় এই গল্পের লেখক মজনু তালুকদারই থাকবে। যেহেতু জালাল এই গল্পের লেখক হতে পারবে না আর কোনোদিন সেইজন্য মজনু এই গল্প অন্য পত্রিকায় ছাপতে দিছিল নিজের নামে; তাছাড়া পত্রিকাওয়ালা অগ্রিম টাকাসহ চিঠি পাঠালে মজনু কী করবে? যদিও একটি জৈবিক চাহিদার গল্পের প্রকৃত লেখক জালাল সরকার। ফলে এই যে সেলিম মোহাম্মদ আর সেফালি বেগমের গল্প, এইটা হতে পারতো কোনো এক কঠিন প্রেম কাহিনীর গল্প, হয়ে উঠতে পারতো কোনো সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে গল্প কিংবা হয়ে উঠতে পারতো এক নিছক অবুঝ প্রেম কাহিনী কিন্তু তা না হয়ে, বাজার চাহিদা প্রয়োজনে হয়ে গেল একটা সমকামিতার গল্প। আর এই জন্যই কি জালাল তার বন্ধু মজনুর নাম এবং ঠিকানার আশ্রয় নেয়?
এই ঘটনা যখন এলাকার লোকজনের কানে পৌঁছলো তখন তারা একটা বিচারের আসর বসালো। মজনু এবং জালাল দুজনকেই ডাকলো। সেই সাথে পূর্ব বাঘমারায় বসবাসকারী মর্জিনাকে ডেকে নিয়ে আসলো, মজির্নার সাথে ছিল তার স্কুল জীবনের বান্ধবী মিস বিউটি আক্তার এবং আরো অনেকেই। সেই বিচার আসর শুরু হইলো এবং বিচারকগণ মর্জিনারে জিজ্ঞেস করলো: জালাল মিয়ারে তুমি চিনো? দেখ তো এই পোলাটাই কি তোমারে ফোন কইরা ডিস্টার্ব দেয় নাকি? কলেজে আইতে যাইতে ডিস্টাব দিছে কুনো দিন?
মর্জিনা মুখ তুলে জনসম্মুখে তাকালো, জালাল আর মজনুরে দেখলো; সভা সম্মুখে মর্জিনা বইলা উঠলো, জালাল কোনটা? আমি তো শুধু মজনু ভাইয়াকে চিনি!
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৪