ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আইনুদ্দি | শাহ ইয়াছিন বাহাদুর

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৪
আইনুদ্দি | শাহ ইয়াছিন বাহাদুর অলঙ্করণ: যতীন দাস

পাঁচটা লাল নিয়ে ডায়মন্ডের গোলামে তুরুপ মারতে গিয়েও না মেরে তেরছাভাবে রাজহাঁসের মতো গলাটা উঁচু করে একজন বলে উঠলো, ‘লোকটা কে রে?’

দেখা গেল, উপজেলা সদরের আবছা ভাসা বিল্ডিং আর সারি সারি বৃক্ষের এক কোমর কুয়াশাকে ঠেলে সরিষা মাঠের মরা দ্যুতি দুপাশে মাড়িয়ে একটা লোক হেঁটে আসতে আসতে বসে গেল। এই অবস্থায় মানুষটার পিশাব চাপতে পারে বা অন্যকোন কারণেও সরিষা গাছের আড়ালটা হয়তো তার দরকার কিন্তু লোকটা কিছুমাত্র দেরি না করে আবার উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় ডুবন্ত পশ্চিমের সূর্যে তাকিয়ে রইলো।

এরপর মাথা ঘুরিয়ে দুটো হাত মাথার উপর চেপে টলতে টলতে যখন আবার হাঁটতে শুরু করলো, তখনই আরেকজন তার হাতের অবশিষ্ট সব তাস দিয়ে তুরুপ মেরে কুঁতিয়ে চিৎকার করে উঠলো, আইনুদ্দি না? অন্য একজন উঠে দৌড়ে স্কুলঘরের সামনে গিয়ে আসমানে আঙুল উঁচিয়ে এক দঙ্গল মানুষকে জাগিয়ে দিল, ওই, আইনুদ্দি আসতেছে রে, আইনুদ্দি।

উপজেলা সদর থেকে এ গ্রামের শেষ মাথা পর্যন্ত দুই মাইল পথ এভাবেই হেঁটে আসা আইনুদ্দির স্বভাব। হাঁটতে হাঁটতে বসে যাওয়া আর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে চলার স্বভাবটাও আইনুদ্দিরই। এই নরম বিকেলে ধেয়ে আসা পৌষের হীমশীতল ধারালো হাওয়ায় যখন একটা মানুষ সমুদয় লক্ষণ সাথে করে এগিয়ে আসে তখন আর সবার মতো খাঁ সাহেবও নিশ্চিত হন—আইনুদ্দিই আসতেছে।

স্কুলের পাশেই মসজিদে তজবি নিয়ে বসেছিলেন খয়ের খাঁ। তিনিও স্পষ্ট আইনুদ্দিনের নামটা শুনতে পেয়েছিলেন বলেই কিনা তজবির লাগানো সুতোর লেজটায় শক্ত করে চুমু খেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। খাঁ সাহেব চোখে জল নিয়ে মসজিদের বারান্দায় এসে দক্ষিণে তাকালেন আর হুড়মুড় করে তাঁর দুজন কাজের লোক, তাস খেলোয়াড়েরা, কিছু ছেলেছোকরা দক্ষিণে লাগালো দৌড়। খাঁ সাহেবের দাড়ি ভিজে যাচ্ছে জলে। তিনি দ্রুত ইমাম সাহেবের কামরার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বিছানায় অর্ধেকটা পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়লেন। তজবি হাতে অপলক টিনের চালে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল করলেন, তাঁর শরীর জ্যৈষ্ঠ মাসের ঘাম দিচ্ছে। সে ঘাম গেঞ্জি ভিজিয়ে পাঞ্জাবি আর তার উপর চাপানো শালটাকেও না ভিজিয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারছেন, এই প্রায় সন্ধ্যাতেও তাঁর প্রভাতকালীন গতিময়  পিশাব ধরেছে আর আমাশয় নয় তবু ও রকম একটা ব্যথা পেটটায় দিচ্ছে মোচড়। ইমাম সাহেব খাঁ সাহেবের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

এদিকে গ্রাম থেকে এতএত লোক দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখে লোকটা, হ্যাঁ, আইনুদ্দি, প্রচণ্ড ভয় আর আশঙ্কায় আবার শহরের দিকে হাঁটতে লাগলো। সে উল্টো পথে হাঁটে আর খাঁ সাহেবের রাখাল কালা মিয়া গলা ছাড়ে, আইনুদ্দি, যাইস না, তোর কাম আছে। আইনুদ্দি, আইনুদ্দি যাইস না।

আইনুদ্দি তখন দৌড় শুরু করে আর সাথে সাথে তারাও, ওই দিকেই এগিয়ে যায়। দক্ষিণের এই হলুদ সরিষার মাঠে তখন কুয়াশায় বসে যাওয়া ধুলোবালি জেগে ওঠে। একটা ভয়ার্ত শিয়াল লেজ নামিয়ে পালাতে গিয়েও একটু কি অবাক হয়, এই লোকসকল তাকে দেখেও তাড়া না করে, পিটিয়ে মেরে ভূতুড়ে বটগাছটার মরা ডালে ঝুলিয়ে না রেখে কোথায় যায়! সন্ধ্যার শূন্যতা তখন একটি শব্দেই খানখান করে ভেঙে পড়ে, আইনুদ্দি, ও আইনুদ্দি। গ্রামের কিছু মেয়েছেলেও দাঁড়িয়ে গেছে বাড়িঘরের ফাঁকফোকরে। তাদের মুখে কেন এক অদ্ভুত ঠোঁটটেপা হাসি!

আইনুদ্দির দমশক্তি অন্যদের তুলনায় এত কম যে, দুই মাইল পথ হেঁটে আসতেই সে একবার বসে, একবার দাঁড়ায় আর কী ভেবে দুহাত মাথায় চেপে হাঁটে। যেন হাতের ভর সে সইতে পারে না। আর এ কারণে সে খুব সহজেই ধরা পড়ে যায়। কালা মিয়া তার একটা হাত একবার যে চেপে ধরেছে, আর ছাড়েনি। ছাড়িয়ে নেবে সে শক্তিও নেই। ছোটছোট ছেলেরা লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়ে এদের আগেপিছে আসে। আইনুদ্দি হাঁপায়। কালা মিয়ার সাথে কিছুতেই হেঁটে পারে না। সে আরেকটা হাত কালা মিয়ার দিকে পেতে বললো, আমারে একটু বইতে দে।

আইনুদ্দি একটু বসার সুযোগ পায় আর মসজিদের পাশে, স্কুলের সামনে মানুষের কৌতূহল বাড়তে থাকে। খাঁ সাহেব পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ধীরে ধীরে পুকুরঘাটে আসেন। পুকুরের জল নেমে গেছে তলানীতে। বদনাভর্তি পানি নিয়ে তিনি ওজু করতে বসেন আর আচমকা হাঁক ছাড়েন, ওই মিয়া, আজানের টাইম অইছে, আজান দিবা না?

২.
এ গ্রামে আইনুদ্দির ইতিহাসটা ছয় বছরের। শ্বেতি রোগে সারা শরীর ঝলসে যাওয়া শরাফত আলীর মেয়ে শামসুন বেগম ওরফে শামসির নিম্নাংশও তখন ছিল পুরোপুরি অবশ। বৃদ্ধ শরাফত এক রাতে তাহাজ্জুত পড়তে এসে মসজিদের সামনে, ঘাসের উপর ঘুমন্ত আর ভীষণ ক্ষুধার্ত আইনুদ্দিকে আবিষ্কার করে। সেই থেকে আগন্তুক আইনুদ্দি এই গ্রামে থেকে যায়। শ্বেতি শামসির সাথে একদিন তার বিয়েও হয়। শামসির বাবা জানতো, কোনো পুরুষ গ্রহণ করার ক্ষমতা ওর নেই। আর আইনুদ্দিনের ছিল বেখেয়াল, কোন মেয়ে মানুষকেই তার ছুঁতে নেই। আর যেহেতু শামসি অর্ধাঙ্গরোগে আক্রান্ত, সেও কোনোদিন আইনুদ্দিনকে পুরুষ ‍হিসেবে পেতে চাইবে না। আইনুদ্দির ভাবনায় এক হিসাবে এইটা একটা ভালো ঘটনা অথবা তার কোনো ভাবনাই হয়তো ছিল না।

শামসির অবস্থা তো সবার জানাই ছিল। রাত শেষে দিন আসে। দিনের আলোর সাথে ধীরে ধীরে এটাও পরিষ্কার হয়ে ওঠে, আইনুদ্দিরও কিছুই নাই! সে খবর পকুরঘাটের মজমায় উষ্ণতা ছড়ায়। আইনুদ্দিকে কাছে পেলে সবাই টিপ্পনী কাটে আর সে মুখের ভেতর থেকে দুপাটি হলুদ দাঁত আর মাপে ছোট জিবটা সরলমনে বের করে একটু হাসি দেয়। এরপর থেকেই আইনুদ্দি এ গ্রামের একটি করুণার চরিত্র।

কাজ করার সামর্থ তার ছিল না। ছ’ফুট লম্বা এক লিকলিকে সুপারি গাছ আইনুদ্দিন পাটখেতে ঘাস বাছতে গিয়ে মাটিতে ছেনি ঢুকিয়ে দুহাত মাথায় তুলে রোদের তেজ গিলে খায়। আর ধানখেতে বা বিলের কাদায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে সে পানির কামড় আর জোঁকের খাদ্য হয়।   একবার পুকুরে মাছ ধরতে জাল ফেলা হলো। এজমালি এ পুকুরে সবাই উৎসব করে নামে। নামে আইনুদ্দিও। কিন্তু সবাই যখন জাল টানা নিয়ে ব্যস্ত তখন পুকুরের এক কোণা থেকে একটি ছেলে চিৎকার করে ওঠে, আইনুদ্দি এমন করতেছে ক্যান?

সবাই দেখে, আইনুদ্দি ডুব যাচ্ছে। পুকুরে নামতে হলে সাঁতারজ্ঞান লাগে, এটি তার জানা ছিল না। এইসব অদ্ভুত খেয়াল বা সারল্যে এখানকার মানুষ আইনুদ্দিকে করুণার পাশাপাশি এক সময় ভালোবাসতেও শুরু করে। বছর দুয়েক এভাবে কাটানোর পর এক ঝড়ের রাতে শামসির মৃত্যু হলে আইনুদ্দির ভেতরে এক গভীর পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়। তাকে তখন ভীষণ বিষণ্নতা আর উদভ্রান্তিতে ধরে। এমন না যে, শামসির সাথে তার যৌনজীবনের শোক ছিল বা একের অপরের প্রতি নির্ভরশীলতার শক্ত সুতোটাই ছিঁড়ে গিয়েছিল, তথাপিও তার ভেতরে দেখা গেল এক কঠিন শোক। সে মানুষের বাড়িবাড়ি গিয়ে পেলে খেয়েছে না হয় ঝিম ধরে দু’হাত মাথায় বসে বা শুয়ে থেকেছে। তার কোনো ব্যক্তিগত দুঃখ বা সুখের গল্প কেউ শুনেছে, এ কথা কেউই মনে করতে পারে না। দিন তবু তার কেটেই যেত আর মানুষও তাকে খেতে দিত। অবশ্য এই সমাদরের পিছনে একটা বড় কারণ ছিল ‘এ গ্রামের মাথাগরম পুরুষ’। তাদের উত্তপ্ত মাথার এক ভীষণ ভরসার জায়গা ছিল আইনুদ্দি। যদি কেউ কোনোদিন একবার ঘর কাঁপিয়ে ‘বাইন তালাক’ উচ্চারণ করেছে তখনই ডাক পড়েছে আইনুদ্দির। তার ঘরে এক রাত মহিলাদের ঠেলে পাঠিয়ে পরদিনই মাথাগরম পুরুষের বউদের তারা অক্ষত ফেরত পেত। আইনুদ্দি একটা ঢোঁড়া সাপ। তার দংশনক্ষমতা নেই আর তার এই অক্ষমতাই তাকে এই গ্রামে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। এই যেমন এখন, খাঁ সাহেব পড়েছেন সেই বিপদে যেখানে একমাত্র আইনুদ্দিই পারে তাঁর উদ্ধারের সাঁকোটা বনতে।

নিঃসন্তান খাঁ সাহেব শেস বয়সে এক অষ্টাদশী বিয়ে করে ভেবেছিলেন, এইবার বুঝি কিছু একটা হয়। কিন্তু কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছিল না আর তরুণী স্ত্রীটিও যখনতখন বিচিত্র সব আবদারে তাঁকে প্রায় কাহিল করে দিচ্ছিল তখনই এক সন্ধ্যায় তিনি ক্ষেপলেন। কিন্তু তাঁর অষ্টাদশী স্ত্রীটি সেটি বুঝলে তো! সেও পাল্টাবিতর্কে জড়িয়ে গেলে তাঁর মনে হলো, মেয়েমানুষ উল্টো ক্ষেপে যাবে আর তা সইবার মতো খাঁ সাহেব তো তিনি নন। খাঁ পরিবারের পূর্বপুরুষদের কথা নিজেকে মনে করিয়ে দিয়ে তিনি মেজাজ প্রচণ্ড গরম করলেন। আর পানের ছিটা হয়ে মুখ থেকে ফসকে সে মেজাজ ‘বাইন তালাক’ বলে বেরিয়ে আসে।

খাঁ সাহেব এটি হয়তো সামাল দিতে পারতেন কিন্তু মুশকিল হলো, কাজের মহিলাটি কাছেই কোথাও ছিল আর সে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলে সে সন্ধ্যাতেই খবরটি খাঁবাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে পুরো গ্রামে মুখে মুখে বিচরণ করতে লাগলো। তরুণী স্ত্রী কোনো কথা না বলে কয়েকটা কাপড় নিয়ে খাঁ সাহেবের ছোট ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। সেই রাত থেকে খাঁ সাহেব খাওয়াহীন, নির্ঘুম। না খেয়ে না খেয়ে তিনি প্রায় রোজা রেখে দিনগুলো পার করছেন। যে খাঁ সাহেব হাঁক দিলে পঞ্চাশটা লাঠি দাঁড়িয়ে যায়, যিনি সড়কে দাঁড়ালে মানুষ সড়ক ছেড়ে আইলে গিয়ে কাঁপে, সেই খাঁ সাহেব, যিনি কৌশল-কায়দায় জমি হাতিয়ে নেন, নিয়েছেন এমন কি অর্ধাঙ্গী-শ্বেতি শামসির ঘরটাও, সেই খাঁ সাহেব তাঁর অষ্টাদশী স্ত্রী বিহনে প্লেগে ধরা হাঁসের মতো তজবি হাতে মসজিদের কোণায় কোণায় নিঃসঙ্গ পড়ে রইলেন।

এই দিনগুলি আর রাতগুলি তিনি কেবল ভাবছেন। আর যতই ভাবছেন ততই বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন, হায়! এ গ্রামে কোন দুর্বল পুরুষ নেই! সবগুলো পুরুষেরই তক্তার মতো লোমশ বুক। তাঁর মনে হয়, প্রতিটি পুরুষের হাতেই মোটামোটা পেশি, কাঁপা কাঁপা মাংসল রান। হায়! তাঁর এমন একটা কচি বউ! দুঃসময়ে দুর্বল প্রতিপক্ষকেও ভীষণ ভীতিকর সবল লাগে আর তখন খাঁ সাহেবের মতো দাপটশালীগণ স্রোতে পড়া চাঙরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েন। তবে শেষ চাঙরটি ভেঙে পড়ার আগেই মানে খাঁ সাহেবের এই ঘোরতর সংকট তাঁকে চূড়ান্ত দুর্বল করে দেয়ার আগেই দীর্ঘ বিরতির পর এই গ্রামে আইনুদ্দির পুনঃপ্রবেশ ঘটে।

৩.
আইনুদ্দির গ্রামে ফেরা যতটা না খবর তার থেকেও বড় খবর রটে গেল রাতে, যখন খাঁ সাহেবের কানে পৌঁছালো যে, আইনুদ্দি খাঁ সাহেবের তরুণী স্ত্রীকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। খাঁ সাহেব আইনুদ্দির ফেরার খবরে খুবই নিশ্চিন্তে মাগরিবের পর দু’রাকাত নফল নামাজ পড়েছেন কিন্তু হঠাৎ তার কী হলো যে, স্বয়ং খাঁ সাহেবের প্রেস্টিজ রক্ষায় সে অরাজি থাকতে পারে?

রাতেই ডেকে পাঠানো হলো আইনুদ্দিনকে।   দেখা গেল, পান খেয়ে মুখে জাবর কাটতে কাটতে আইনুদ্দি নিচের ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে খাঁ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ভয় জিনিসটা যেটা পাওয়ার কথা, পায়নি। বৈঠক ঘরে কালা মিয়া একটা মোড়া পেতে দিলেও আইনুদ্দি সেটিতে না বসে খাঁ সাহেবের হাতে ধরা রুপালি পাইপটার দিকে নতমুখে তাকিয়ে রইলো। খাঁ সাহেব বললেন, কেমন আছস আইনুদ্দি?
জবাবে আইনুদ্দির হলুদ দাঁত বেরিয়ে আসে আর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে পানের রস চুঁইয়ে পড়ার মুখে হাত দিয়ে সে আটকায়। খাঁ সাহেব আবার বললেন, কিরে তুই দেহি মোচও রাখছস? বিষয় কী? কথা কস না ক্যান? তোর তো দেহি চেহারাও ফুটছে, কোনো সালসা-টালসা খাসনি?
প্রশ্ন শুনে আইনুদ্দির মাথা আরো নিচু হয়। সে কথা বলে না, বলাটা তার স্বভাবের সাথে যায়ও না। তাই খাঁ সাহেব তার থেকে উত্তর আশা না করেই তাঁর যা বলার বলে নিবেন ঠিক করলেন, কিরে আমার উপ্রে রাগ করছস নি?
খাঁ সাহেব এতক্ষণে লক্ষ্য করলেন, আইনুদ্দি একটা চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চাদর কিংবা নিচে পরা লুঙ্গি দুটোই চোখে পড়ার মতো। দামি এবং পুরনো মনে হলো না। পায়ে তার স্যান্ডেলও! তিনি প্রশ্ন করেন, তোরে এই চাদ্দর কে দিছে? কিরে কথা কস না ক্যান?
তিনি বুঝলেন, আইনুদ্দিকে ঘেঁটে লাভ বিশেষ নেই তবু বললেন, শোন, শামসির বাড়িটা আমি তোরে ফেরত দিয়া দিমু। তুই এখন থিকা এইখানেই থাকবি। ঠিকাছে তো? আর ইমাম সাব যা যা কয় শুনবি। এখন যা।
এবার আইনুদ্দি খাঁ সাহেবের মুখের দিকে চাইলে তিনি বললেন, কিছু কইবি?
আইনুদ্দি চলে যেতে যেতে বৈঠকঘরের চৌকাঠের বাইরে যেখানে আলোর যথেষ্ট আড়াল সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় আর আস্তে করে বলে, আমি বিয়া করতাম না।
এ কথায় খাঁ সাহেব উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। আর কালা মিয়া তখনই আইনুদ্দির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে, তোর কিছু করতে অইবো না। আগে আমার লগে চল।

বৈঠকঘরের হারিকেনের আলোয় খাঁ সাহেবের অগ্নিমূর্তি কেউ দেখেনি। কালা মিয়া তো দেখেছে। সে জানে, আইনুদ্দির এই অনাপত্তি খাঁ সাহেবের হুংকারের সাথে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। এই গ্রামে খাঁ সাহেবের মতের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা একজনেরই আছে, সে তাঁর তরুণী ছোটবউ। কিন্তু ছোটবউকে শাস্তি দিতে গিয়ে তিনি নিজেই এখন শাস্তি পাচ্ছেন, এটিই সমস্যা। এই জীবনে, তাঁর ভাষায়, তিনি কালহাশরের ময়দানে পড়ে গেছেন, তাঁকে কেউ সাহায্য করার নেই। ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি। এই আত্মসমর্পণের অর্থ এই নয় যে, আইনুদ্দিকে শাস্তি দিতে তাঁর হাতে কাঁপুনি আসবে। সে খবর আইনুদ্দি না রাখলেও কালা মিয়া তা ভালো করেই জানে আর সে কারণেই, আইনুদ্দির ভালোর জন্যই হোক বা ছোটমার প্রতি তার মমতার জন্যই হোক, আইনুদ্দিকে সে রাজি করাবেই।

৪.
তখন পৌষের দাপট অন্ধকারে প্যারাসুট ছেড়ে নামে। তখন রাত আর সে রাতে একটি পাখিও ডেকে উঠবার নেই, চিৎকার করার একটিও শিশু নেই। পুকুরঘাটের জটলায় চেপে বসেছে সুস্থির নিদ্রা। শুধু একটি ঘর, ঘর ঠিক নয়, মক্তবের এক কোণায় ইমাম সাহেবের থাকার চালাটায় বাতি জ্বলছে। ইমাম সাহেব লেপ মুড়ি দিয়ে ঘরের খুঁটিতে ঠেস দেন আর আইনুদ্দিকে বলেন, আরে বেকুব, তুই তুই বইলাই সুযোগটা পাইছস। আর কাউরে তো এই সুযোগ খাঁ সাব দিত না। এই জিনিস সবার ভাইগ্যে জোটে? ঝামেলা না কইরা রাজি হইয়া যা। রাজি হইয়া এইহানে শুইয়া পড়, অসুবিধা নাই।

আইনুদ্দি তখন ইমাম সাহেবের দিকে তাকায়। ইমাম সাহেবের লাগানো জানালার ফাঁক দিয়ে তাকালে শামসির ঘরটা দিনের আলোয় দেখা যায়। এই ঘরটা খাঁ সাহেব তাকে ফিরিয়ে দেবে, দিলে এখানে সে আবার থাকবার সুযোগটা পায়। এটি একটি বিরাট সুযোগ, আইনুদ্দির মাথা খোলে তবু ইমাম সাহেবকে সে বলে, হুজুর, আমি বিয়া করতে পারতাম না।

ইমাম সাহেব রেগে ওঠেন, আরে বেটা, বিয়া তুই জীবনে কম করছস? নতুন কইরা তোর তো কিছু করা লাগতো না। একটা টিপ দিয়া কবুল কইয়া লা।
ইমাম সাহেব বলেন আর অলক্ষে তাঁর কণ্ঠ থেকে এক ধরনের মায়া ঝরে পড়ে। সে মায়া সামনে বসা আইনুদ্দি না একলা খাঁ সাহেবের অষ্টাদশী তরুণীর মুখ ভেবে, বোঝা গেল না। আইনুদ্দিকে বোঝাতে গিয়েও তার কোথাও যেন লাগে। তিনি বলেন, আর যদি রাজি না হোস তয় যা, খাঁ সাবের লাঠি খা গিয়া। বেকুব কোথাকার।
আইনুদ্দি তার হাঁটুতে হাত ঘষে আর মাথাটা ধীরে ধীরে নীচু করে বলে, আমি টাউনে বিয়া করছি হুজুর।
ইমাম সাহেব একটু কোঁতান দিয়ে শরীরে শক্ত করে লেপ জড়িয়ে নেন আর বলেন, বিয়া তো তুই ছয় বছর ধইরাই করতাছস। অসুবিধা কী?
নত মাথায় আইনুদ্দি বলে, আমি বিয়া করছি। হাছা হাছা বিয়া করছি। আমার একটা পোলা হইবো হুজুর।
এবার ইমাম সাহেব লেপ ছেড়ে আইনুদ্দির কাছে এসে বসে তাকে ঝাঁকি দিয়ে বলেন, আসল কথাটা কী ক তো।
আইনুদ্দি বলে, হ্যারা আমারে চিকিস্যা করাইছে। আমি এহন ভালো হইয়া গেছি। আমার শইল্যে রোগ নাই।
ইমাম সাহেব তখন দ্রুত দরজা দিয়ে তাকিয়ে কালা মিয়ার অবস্থান দেখে আইনুদ্দির মুখ চেপে ধরে বলেন, চুপ চুপ। চুপ কর। কেউ শুনবো।
অর্ধেকটা ভেজানো দরজা দিয়ে ঢুকতে থাকা কুয়াশা ঠেলে বাইরে বেরোবার মুখে আইনুদ্দি তখন একটা অচেনা হাসি দেয়। সে হাসির অর্থ ইমাম সাহেব আর পড়তে পারেন না।



বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।