___________________________________
‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য।
___________________________________
আমি কিছুই নই। কিছুই নই কিন্তু তখন আমি হয়ে উঠেছিলাম মলিন অনুজ্জ্বল এক ছায়ামূর্তি। সেই সন্ধ্যায়, কাফে টেরাসের বিপরীতে, বৃষ্টি কখন থামবে, সেই অপেক্ষায় আছি। হুতি আমার সঙ্গ ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পরই মুশলধারে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো।
এরও কয়েক ঘণ্টা আগে এজেন্সি অফিসের চত্বরে শেষবারের মতো আবার আমরা দেখা করি। হুতি, বরাবরের মতোই, তার বিশাল ডেস্কের সামনে বসে আছে। গায়ে কোট চড়ানো। ভাবটা এমন যে একটু ফাঁক পেলেই চটজলদি উঠে যাবে। আমি বসে আছি তার উল্টো দিকে। বসে আছি হাতলঅলা চামড়ার একটা চেয়ারে, যেখানে সাধারণত আমাদের ক্লায়েন্টরা এসে বসে। বহুবর্ণিল ল্যাম্পের শেডটা এমন ঝলমল করছে যে আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
“ঠিক আছে, এই তো এখানে আছি আমরা, গাই ... এই তো ...,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হুতি কথাগুলো বললো।
টেবিলের ওপর একটা নিরুদ্দিষ্ট ফাইল পড়ে আছে। হয়তো এটা সেই ছোটখাট লোকটির ফাইল, যার ভয়ার্ত সূঁচালো চোখে-মুখে দেখেছিলাম ভীত, সন্ত্রস্ত অভিব্যক্তি, যে তার স্ত্রীকে অনুসরণ করবার জন্য আমাদের ভাড়া করেছে। ওই বিকেলেই সেই মহিলা পল দুমের এভিন্যুর কাছাকাছি রু ভিতালের একটা হোটেলে আরেক কালো তোবড়ামুখো লোকের সঙ্গে দেখা করে।
ভাবনায় ডুবে যাওয়া হুতি তার দাঁড়িতে মাঝে মাঝে ঠোনা মারছে। দাঁড়িটাও দশাসই ধরনের, ভালুকমুখো লোমে ভরা, ছোট ছোট করে ছাটা, চিবুক পযর্ন্ত ছড়ানো। তার বড় বড় বিস্ফারিত চোখ যেন স্বপ্নে বিভোর। ডেস্কের বাম দিকে একটা বেতের চেয়ার। আমি কাজের সময় ওটাতে বসেই কাজ করি। হুতির পেছনে দেয়ালের অর্ধেকটা জুড়ে একটা কালো কাঠের শেলফ। ওই শেলফেই সারি সারি করে রাখা আছে গত পঞ্চাশ বছর ধরে প্রকাশিত বিভিন্ন সড়ক আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরি, নানা ধরনের ইয়ারবুক। হুতি আমাকে প্রায়ই বলে এগুলো হচ্ছে ব্যবসা চালানোর প্রয়োজনীয় উপকরণ আর এসব থেকে সে কখনোই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবে না। এও ভাবা যেতে পারে, এসব ডিরেক্টরি আর ইয়ারবুক সবচেয়ে দামি জিনিস আর ঠিক চলমান একটা লাইব্রেরির মতো। এর পৃষ্ঠাগুলো, মানুষজন, নানা জিনিসপত্তর, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া পৃথিবীর একমাত্র সাক্ষী হয়ে আছে।
“এইসব ডিরেক্টরি দিয়ে তুমি কী করবে?” শেলফের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে হুতিকে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আমি এসব এখানেই রেখে যাচ্ছি, গাই। আমি অ্যাপার্টমেন্টটা ছাড়ছি না, ভাড়া দিয়ে যাব। ”
চারদিকটা সে একবার দ্রুত দেখে নিল। পাশের ছোট্ট ঘরের সঙ্গে যুক্ত ডাবল ডোরটা খোলা। যে কেউ তাকালেই দেখতে পাবে, ভেলভেট কভারে সোফাটা মোড়ানো। আছে ফায়ারপ্লেস, আয়না, যাতে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে সারি সারি ইয়ারবুক আর ডিরেক্টরিগুলো। হুতির মুখটাও প্রতিবিম্বিত হচ্ছে ওই আয়নায়। আমাদের ক্লায়েন্টরা এসে প্রায়ই ওই ঘরে অপেক্ষা করে। পারস্যের একটা কার্পেট ঘরের কাঠের মেঝেটাকে রক্ষা করছে। জানালার কাছে ঝুলছে একটা ধাতুমূর্তি।
“কী ভাবছো, গাই?”
“কিছু না। ইজারাটা দিয়ে ঘরটাকে তাহলে তুমি দখলে রাখবে?”
“হ্যাঁ। মাঝে মাঝে আমি প্যারি আর এজেন্সির অফিসে আসবো। এজেন্সির এই ঘরটি হবে আমার দ্বিতীয় আবাসস্থল।
সে এবার সিগারেট কেসটা বের করলো।
“আমার চিন্তা হচ্ছে, আমি যদি এই বাড়িটা রেখে দিই তাহলে সেটা হবে কম কষ্টের। ”
আমরা একসঙ্গে আট বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছি। ১৯৪৭ সালে সে তার নিজের প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কাজ শুরু করে। আমার আগে সে আরও অনেকের সঙ্গে কাজ করেছে। আমাদের ব্যবসাটা হচ্ছে ক্লায়েন্টদেরকে, হুতি যেমন বলে, ‘সমাজ-তথ্য’ সরবরাহ করা। এই তার সব কথা, বারবার যা সে বলতে ভালোবাসে, ‘সমাজগোষ্ঠী’র মধ্যে কাজ করা।
“তোমার কি মনে হয় তুমি নিসে থাকতে পারবে?”
“অবশ্যই। ”
“তুমি বোর হবে না?”
শূন্যে ধোঁয়া ছাড়লো সে।
“গাই, একজন মানুষকে শেষ অব্দি রিটায়ার করতে হয়। ”
ভারী শরীরটা নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। হুতি নিঃসন্দেহে ছ’ফুটেরও বেশি লম্বা হবে আর তার ওজন হবে ২০০ পাউন্ডেরও বেশি।
“আমার ট্রেন ছাড়বে ১০:৫৫-তে। চলো, মদ খাওয়ার কিছুটা সময় পাওয়া যাবে।
বেরুনোর হলের দিকে চলে গেছে যে করিডোর সেই দিকে সে হাঁটতে থাকলো। ডিম্বাকৃতির একটা বিশ্রী ঘর, ঈষৎ হলুদ রঙের বিবর্ণ দেয়াল। একটা কালো রঙের পোর্টফোলিও। তাতে এমনভাবে জিনিসপত্তর ঠাঁসা যে বন্ধ করা যায় না। মেঝের ওপর খাঁড়া করে রাখা। হুতি সেটা হাতে তুলে নিল। এক হাত দিয়ে বগলে চেপে চলতে থাকলো।
“তোমার কোনো লাগেজ নাই?”
“আমি সবকিছু আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি। ”
হুতি সামনের দরোজাটা খুললো আর হলের আলোটা নিভিয়ে দিল। ল্যান্ডিংয়ের কাছে এসে দরোজা বন্ধ করার আগে একমুহূর্ত সে থামলো। দরোজার ধাতব শব্দ যেন আমাকে তাড়াতাড়ি জায়গাটা থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার ইশারা দিল। আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় শেষ হওয়ার সংকেত বুঝি বেজে উঠলো।
“কান্না পাওয়ার মতো লজ্জাজনক একটা ব্যাপার হয়ে গেল, তাই না গাই?” হুতি বললো। তার কোটের পকেট থেকে লম্বা একটা রুমাল বের করে ভ্রুর কাছটা মুছলো।
কালো আয়তকার মার্বেল ফলক, এতে গিলটি আর খোঁদাই করা লেটারিং দিয়ে তৈরি নামটি এখনও আছে :
C. M. HUTTE প্রাইভেট গোয়েন্দা
হুতি বললো, “আমি এটা ছেড়ে যাচ্ছি। ”
এরপর তালার মধ্যে চাবি দিয়ে সে ঘোরালো।
এভিন্যু নিযেলের সঙ্গে সঙ্গে পেরিয়ে গেল প্লাস প্যরের। চারিদিক অন্ধকারময়, শীত আসতেও বেশি দেরি নেই। বাতাস তখনও অনেকটাই মৃদু মন্থর। প্লাস প্যরেরের অর্তেনসিয়াসে গিয়ে আমরা বসলাম। বেতের চেয়ার আছে বলে এই কাফেটা হুতি অনেক পছন্দ করে— “ঠিক পুরনো দিনের মতো। ”
কিছুটা ব্রান্ডি আর সোডা পেটে চালান দেওয়ার পর সে জিজ্ঞেস করলো, “কিন্তু তোমার কী হবে, তুমি এখন কী করবে, গাই?”
“আমি? আগের কিছু অনুসন্ধান করে যাব। ”
“আগের কিছু অনুসন্ধান করবে মানে?”
“হ্যাঁ, আমার অতীতকে খুঁজে দেখবো। ”
আগের আলামত খোঁজাখুঁজি করা হবে বলে সে একটু হাসলো।
“আমি সবসময় ভাবি, একদিন তুমি তোমার অতীতকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করবে। ”
এখন সে অনেক সিরিয়াস এবং এই সিরিয়াস ব্যাপারটা আমাকে অভিভূত করলো।
“কিন্তু দেখ গাই, এটা তোমার কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না। ”
নীরবতার গভীরে ডুবে গেল সে। কী ভাবছেন তিনি? তার নিজের অতীতের কথা?
“আমি তোমাকে এজেন্সির একটা চাবি দেব। তুমি যখন মনে হবে সেখানে যেতে পারবে। তুমি এটা করলে আমার ভালো লাগবে। ”
একটা চাবি সে বের করলো। ঝপ করে আমি সেটা আমার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম।
“আমি যখন নিসে থাকবো, ফোন কোরো। কী ঘটছে, আমাকে জানিও ... কতদূর তুমি যেতে পারলে ... তোমার অতীতে ...”
উঠে দাঁড়ালো সে, জড়িয়ে ধরলো আমার হাত।
“আমি কি আপনার সঙ্গে স্টেশন অব্দি আসবো?”
“না, না … ব্যাপারটা সত্যি দুঃখজনক ...”
একটা লম্বা পা ফেলে কাফে থেকে সে বেরিয়ে গেল, কোনো দিকে তাকালো না, আর হঠাৎ আমার ভেতরটা হু-হু করে উঠলো, আমি শূন্যতার গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হলাম। এই লোকটি ছিল আমার কাছে অনেক কিছু। সে ছাড়া, তার সাহায্য ছাড়া, আমি যে কিছু হতে পারতাম না, সেই দশ বছর আগেকার কথা বলছি, যখন আমি স্মৃতিভ্রষ্ট একজন মানুষ, অন্ধের মতো কুয়াশার মধ্যে কত কী যে হাতড়ে ফিরছি। তিনিই আমার কেসটা নিয়ে লড়েছেন, যদিও তখন তার হাতে অনেক কনটাক্ট, তারপরও তিনি আমার একটা বৈধ আইনি পরিচয়পত্র জোগাড় করতে পেরেছিলেন।
“এই নেন” বলে আমার হাতে বড় একটা খাম তুলে দিলেন তিনি। ওই খামের মধ্যে ছিল একটা আইডেনটিটি কার্ড এবং একটা পাসপোর্ট। “এখন থেকে আপনার নাম হলো ‘গাই রোলান্ড’। ”
আর এই প্রাইভেট গোয়েন্দা, যতটা বুঝেছি, তার পেশাগত কাজ ছিল সাক্ষীসাবুদ আর প্রামাণ্য কাগজপত্রের মাধ্যমে আমার অতীতকে উন্মোচিত করা, আরও বললেন :
“হে আমার প্রিয় ‘গাই রোলান্ড,’ এখন থেকে আপনি আর পেছনে ফিরে তাকাবেন না। শুধু ভাববেন বর্তমান আর ভবিষ্যতের কথা। আমার সঙ্গে কাজ করবেন? …”
তিনি যদি আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকেন, সে তার নিজের জন্যেই— পরে আমি জেনেছি— নিজের অতীতকেই তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার জীবনের একটা সম্পূর্ণ অংশ কোনো চিহ্ন ছাড়াই অতীতের গর্ভে অন্ধকারে ডুবে আছে। শুধু সামান্য কিছু চিহ্নের সাহায্যে অতীতের সঙ্গে তিনি নিজের সংযোগ রাখতে পেরেছেন। এই লোকটার মধ্যে সাধারণভাবে যা দেখা যায়, যাকে আমি জীর্ণ ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া কোট গায়ে রাতের অন্ধকার মিলিয়ে যেতে দেখছি, যিনি বহন করছেন একটা ফোলিও ব্যাগ, যিনি এই সময়ের একজন সুদর্শন টেনিস খেলোয়াড়, তিনি হচ্ছেন উস্কোখুস্কো চুলের সেই বাল্টিক ব্যারন কনস্টানটিন ভন হুতি। ”
(চলবে)
২য় কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ২০০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৪
শিল্প-সাহিত্য
নোবেলজয়ী লেখকের উপন্যাস
নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (১) || অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।