ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (শেষ পর্ব) || অনুবাদ: আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (শেষ পর্ব) || অনুবাদ: আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
_________________________________

৫৬তম কিস্তির লিংক


গাছপালার মাঝে বতাসের চাবুক খেতে খেতে, বৃষ্টিতে ভিজে, আমি সময়ের নিষ্ঠুর এক অতিক্রমণ টের পেলাম। ততক্ষণ পর্যন্ত, অশ্রু আর বৃষ্টির জলে ভেসে যেতে যেতে দেখলাম, অন্য শোবারঘরেও আলো জ্বলেছে।
তারপর যা ঘটল তা এক দুঃস্বপ্ন। ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে, জানালার গ্রিল বেয়ে আমি তৃতীয় তলায় উঠে এলাম। হেঁটে চলে এলাম দোতালার টেরাসে। ভেতরে ঢুকলাম, তারপর মারিয়ার ঘরের ভেতরবাগে চোখ বোলালাম: দরজার নিচ দিয়ে আসা একটা আলোর রেখা সোজাসুজি আমাকে নিয়ে গেল ওখানে। আমি কাঁপছি, ছুরিটা শক্ত করে চেপে ধরলাম মুঠোয়, তারপর দরজা খুললাম। ‘দরজায় কেন লক করবে?’ তখনও তিক্ততা নিয়ে ভাবলাম। দরজার কাছ থেকে মারিয়ার নেশাধরা চোখদুটো নজরে এল। এগিয়ে গেলাম আমি

ওর দিকে, যখন ওর বিছানার কাছে এসেছি, নরম গলায় বলল ও:
‘তুমি কি করতে চাইছ, হুয়ান পাবলো?’
আমার বাম হাত ওর চুলে রাখলাম, উত্তর দিলাম:
‘তোমাকে খুন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই, মারিয়া। তুমি আমাকে ভীষণ একা করে দিয়েছো। ’

ফুপিয়ে ওঠেই, আমি ওর বুকের ওপর ছুরি চালিয়ে দিলাম। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ওর, তারপর চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেল; আমি যখন রক্তাক্ত ছুরিটা তুলে আনছি, ও জোর করে চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে, নম্র আর বিষন্ন। আচমকা এক ক্রোধ ধেয়ে এসে আমাকে নতুন করে শক্তি জোগাল, তারপর একের পর এক, বারবার আমি ছুরিটা ওর বুকে, পেটে চালিয়ে গেলাম।

তারপর টেরাসে ফিরে যাওয়ার পথটা ধরে এগোলাম আর মনে হল, শয়তান যেন পুরোই আমাকে অধিকার করে নিয়েছে, প্রায় হুমড়ি খাওয়ার মতো গ্রিল বেয়ে মাটিতে নামলাম আমি। বিদ্যুৎ চমকে, এক সময় আমাদের হওয়া চারপাশটা শেষবারের মতো আরেকবার আলোকিত হয়ে উঠতে দেখলাম।

বুয়েন্স আয়ার্সের উদ্দেশে গাড়ি ছুটালাম দ্রুত। ভোর চার কি পাঁচটার দিকে পৌঁছে গেলাম। কাছের একটা বার থেকে ফোন করলাম আয়েন্দের বাসায়। ওদেরকে বাধ্য করলাম তাকে ডেকে তোলার জন্য, ওকে জানালাম এখুনি এক মিনিটও দেরি না করে তার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। গাড়ি চালিয়ে কালে পোসাদায় পৌঁছুলাম। দরজার কাছে পোলিশ কাজের লোকটা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ছয় তলায় পৌঁছে দেখি এলিভেটরের সামনে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আয়েন্দে, তার অকার্যকর চোখ জোড়া বিপদাশংকায় পুরো খোলা। আমি ওর বাহু খামচে ধরে ভেতরে নিয়ে এলাম। বোকা কাজের লোকটা অনুসরণ করে এল, মুখ হাঁ হয়ে গেছে তার। ওকে বের করে দেওয়ার জন্য আমার আয়েন্দে আছে। ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ামাত্রই আমি অন্ধ লোকটাকে উদ্দেশ করে চেচিয়ে উঠলাম:

‘আমি এইমাত্র এসতানসায়া থেকে এসেছি। মারিয়া হান্তেরের প্রেমিকা!’
আয়েন্দের চেহারায় মৃত্যুর কাঠিন্য।
‘গাধা,’ দাঁতে দাঁত চেপে আর্তচিৎকারের করে উঠল সে, হিমশীতল তার ঘৃণা।
লোকটার অবিশ্বাসে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, আমি আবারও চিৎকার করে বললাম:
‘গাধা আপনি। মারিয়া আমারও প্রেমিকা ছিল, আরও অনেকেই আছে এরকম!’
এ কথা বলে আমি বেপরোয়া বিভৎস এক আনন্দ পেলাম; অন্ধটা এমনভাবে দাঁড়িয়ে রইল যেন পাথর বনে গেছে।

‘হ্যাঁ!’ আমি চেচিয়ে গেলাম। ‘আমি আপনাকে ধোকা দিয়েছি আর আমাদের দুজনকেই ধোকা দিয়েছে মারিয়া। কিন্তু এখন আর কউকে ও ধোকা দিতে পারবে না। আপনি বুঝতে পারছেন? আর কাউকে না! কাউকে না!’

‘তুমি একটা উন্মাদ গাধা!’ বুনো জন্তুর মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠল অন্ধলোকটা, তারপর দুহাত ছড়িয়ে মুঠে থাবার মতো করে, তেড়ে এল আমার দিকে!

আমি এক পাশে সরে গেলাম, আর ও গিয়ে হোচট খেল এক টেবিলের সঙ্গে, তারপর পড়ল হুমড়ি খেয়ে। হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ালের মতো ক্ষিপ্রতায় দু’পায়ে উঠে দাঁড়াল সে তারপর ঘরজুড়ে আমাকে তাড়া করতে শুরু করল, চেয়ারের ওপর গিয়ে পড়ল, হোচট খেল অন্য আসবাবপত্রের সঙ্গে, ফুঁপিয়ে কাদছে সে, কিন্তু ওর চোখ দিয়ে কোনো পানি বেরুচ্ছে না, আর এই ধাওয়া করার পুরোটা সময়টা সে চিৎকার করে একটা শব্দই বলে গেল শুধু: গাধা!

আমি দৌড়ে সিঁড়ি ধরে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম, পথে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলাম কাজের লোকটাকে, ও আমার পথরোধ করার চেষ্টা করছিল। তীব্র রাগ, ঘৃণা, আর করুণা আমাকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে।
আমি যখন থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে নিজেকে সোপর্দ করলাম, তখন প্রায় ছয়টা বাজে।

জেলের ছোট্ট জানালা দিয়ে মেঘহীন আকাশে নতুন এক দিনের জন্ম অবলোকন করলাম আমি। ভাবলাম সব নারী-পুরুষ মাত্র ঘুম থেকে জেগেছে, এরপর সকালের নাস্তা সেড়ে খবরের কাগজ পড়বে তারা, অফিসে যাবে, কিংবা বাচ্চাদের খাওয়াবে কিংবা বাড়ির পোষা বিড়ালটিকে, কিংবা গতরাতে দেখা চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলবে।
আমি টের পেলাম আমার ভেতরে অন্ধকার এক গহ্বর ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে।

আমার এই বন্দিত্বের মাসগুলোয় আমি বহুবার অন্ধলোকটার শেষ শব্দটা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করেছি, গাধা কথাটা ছিল তার শেষ শব্দ। কিন্তু সীমাহীন ক্লান্তি, কিংবা অজ্ঞাত কোনো সহজাত প্রবৃত্তি, আমাকে চিন্তাটা নিয়ে অগ্রসর হতে প্রতিবারই বাধা দিয়েছে। সামনে হয়তো কোনো দিন সফল হব, আর এই সময়ের মধ্যে আমি হয়তো আয়েন্দের আত্মহত্যার কারণও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হব।

আমি অন্তত এখন আঁকতে পারছি, যদিও আমার ধারণা ডাক্তাররা হয়তো এ নিয়ে হাসাহাসি করে পেছনে, বিচারের শুনানীতে আমি যখন ওই জানালার দৃশ্যটার কথা বলি আমার সন্দেহ, ওরা হাসে।
 
আমার ছবি বুঝত এমন মানুষ আসলে একজনই ছিল। এর মধ্যে, এই ছবি নিশ্চিতভাবেই ওদের তদন্ত কাজে সাক্ষ্যপ্রমাণ যোগাবে। আর প্রতিদিন এই নরকের দেয়াল আরও কাছে এগিয়ে এসে শক্ত করে চেপে বসবে আমার ওপর।
(শেষ)
[সাবাতোর এই বইটি পুস্তককারে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হবে। অনুবাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে: [email protected]]


বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।