১৯২৪ সালে মৃত্যুর আগে ফ্রাঞ্জ কাফকা তার দীর্ঘদিনের প্রকাশক বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে বলে গিয়েছিলেন, আমি মরে গেলে আমার অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি, চিঠিপত্র, ডায়েরি সবকিছু পুড়িয়ে ফেলো। কিন্তু তার বন্ধু তা করেননি।
১৯৮৬ সালে ব্রড মারা যাওয়ার আগে কাফকার বাঁকি সাহিত্যকর্মগুলো রেখে যান যান তার ব্যক্তিগত সহকারী এসদার হোফের কাছে। তিনি হোফকে বলেছিলেন সেগুলো কোনো শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে দান করতে।
কিন্তু ব্রডের মতো হোফও তা করেননি। কাফকার সেই অপ্রকাশিত লেখাগুলো তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে না দিয়ে নিজের সম্পদ মনে করে বরং বিক্রি করা শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাসের মূল পা-ুলিপি নিলামে ১৮ লাখ মার্কিন ডলারে বিক্রি করেন লন্ডনের একটি নিলাম হাউসের কাছে। এই নারী বেঁচে ছিলেন ১০১ বছর। ২০০৭ সালে মৃত্যুর আগে তিনি কাফকার সাহিত্যকর্মগুলো তার দুই মেয়ে ইভা হোফ ও রুথ উয়েসলারকে দিয়ে যান। এরপর থেকেই শুরু হয় কাফকার সেসব অপ্রকাশিত লেখার মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব। তারা এগুলো বিক্রি করে দিচ্ছিলেন জার্মানির সাহিত্য সংগ্রহশালার কাছে। ইসরায়েলের জাতীয় গ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে বলা হয় ব্রড কাফকার লেখাগুলো গ্রন্থাগারে দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ওগুলো ইসরায়েলের জাতীয় সম্পত্তি। অন্য দেশের কাছে এই সম্পদ কিছুতেই দেওয়া যাবে না। কিন্তু ইভা হোফ ও রুথ রুয়েসলারের বক্তব্য, এগুলো তারা মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সুতরাং ওগুলো তাদের সম্পত্তি। কিন্তু ইসরায়েলের জাতীয় গ্রন্থাগার তাতে বাধ সাধে। তাদের এ নিয়ে মামলা হয় আদালতে।
হোফ কাফকার অমূল্য অপ্রকাশিত লেখাগুলো নিরাপত্তার জন্য ১০টি বাক্সে ভরে রেখেছিলেন তেল আবিব ও সুইজারল্যান্ডের জুরিখের ব্যাংকের ভল্টে। গত ৪০ বছর ধরে সেগুলো ব্যাংকের ভল্টেই পড়ে আছে।
ইসরায়েলের দাবির মুখে দুই বোনের আইনজীবী বলেছেন, এগুলো তারা মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। হতে পারে হোফ এগুলো কোনো শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে দান করতে বলেছিলেন। তাই বলে তা যে ইসরায়েলের গ্রন্থাগারেই দান করতে হবে তার কি ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম আছে? তারা যেখানে খুশি এগুলো দান করতে পারেন। সেটা হতে পারে জার্মানির সাহিত্য সংগ্রশালা বা অন্য কোথাও।
জানা গেছে, এরই মধ্যে তারা ১১ লাখ ডলার দিয়ে অনেকটাই বিক্রি করে দিয়েছেন জার্মানির কাছে।
এদিকে ৭৫ বছর বয়সী ইভা হোফও বলেলেছেন, ইসরায়েলে কাফকার এই অমূল্য সাহিত্যকর্ম রাখার জায়গা নেই। এখানে সন্ত্রাসবাদ আছে। এখানে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে। এমন সম্পদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই তা অন্য কোথাও দিতে চাই। জার্মানিতে এগুলো অনেক নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু ইসরায়েলের বক্তব্য, কাফকা যেহেতু ইহুদি ছিলেন, তাই এই সম্পদ ইসরায়েলেরই প্রাপ্য।
তবে এবার এই দ্বন্দ্বের অবসান হতে যাচ্ছে। তেল আবিবের একটি আদালত আদেশ দিয়েছেন কাফকার অপ্রকাশিত লেখা অবশ্যই প্রকাশ উচিত, তবে তা কোনো ব্যক্তির স্বত্বাধিকারে নয়। প্রকাশনা স্থগিতাদেশের অনুরোধ করা হলেও আদালত তা নাকচ করেছেন।
গত সপ্তাহে তেল আবিব জেলা আদালত বাক্স খুলে তার মধ্যে কী আছে তা পরীক্ষা করার আদেশ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা একটি বাক্স খুলে দেখে বলছেন, সেখানে পাওয়া গেছে কাফকার একটি অসমাপ্ত উপন্যাস, এছাড়া তার অন্যান্য লেখাগুলো মধ্যে তার রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া গেছে। কাফকার হাতে লেখা গল্প পাওয়া গেছে যা কখনো প্রকাশিত হয়নি।
এর আগে তেল আবিব জেলা আদালত গত বছর এক আদেশে বলেছিলেন, বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাফকার অপ্রকাশিত ওইসব সাহিত্যকর্মের মালিক কে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে না।
ফ্রাঞ্জ কাফকা বিশ শতকে বিশ্বসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। মাত্র ৪১ বছর বয়সে মারা যান ১৯২৪ সালে। বেঁচে থাকতে ১৯১৫ সালে তিনি মাত্র একটি উপন্যাসিকা ‘মেটামোরফসিস’ প্রকাশ করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘দ্য ট্রায়াল’, ‘দ্য ক্যাসল’ এবং ‘আমেরিকা’ নামের উপন্যাস। এগুলো প্রকাশিত হবার পর বিশ্বসাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বলা যায়, মৃত্যুর পর কাফকা হয়ে ওঠেন সত্যিকারভাবে একজন মহান সাহিত্যিক।
আমরা এখনো জানি না ব্যাংকে রাখা ওই বাক্সগুলোতে কাফকার কোনো মূল্যবান পরিপূর্ণ লেখা আছে কি না। যদি থাকে তবে হয়তো আবারও আমরা খুব শিগগিরই পেয়ে যাব কাফকার নতুন কোনো বই। ইসরায়েলের আদালত অন্তত তাই বলেছে।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫৫১, জুলাই ২৪, ২০১০