এ না হলে কিসের কবি,
কিসের ছবি আঁকিয়ে?
ফুলের ছবি আঁকব আমি
গাছের দিকে তাকিয়ে।
১৯৮৭ সালে নির্মলেন্দু গুণ উপরের শিশুতোষ কবিতার লাইনগুলোর মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেছিলেন চিত্রশিল্প সম্পর্কে তার অদ্ভুত ধারণার।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বের হয়েছে নির্মলেন্দু গুণের ওই প্রদর্শনীর ছবি আঁকার প্রসঙ্গ নিয়ে বই ‘রঙের জাতক’। বইটি পাঠ করলে জানা যায় নির্মলেন্দু গুণ আসলে ছবির জগতে হঠাৎই আসেননি। ছবি আঁকার বীজ তার মধ্যে ছিল অনেক আগে থেকেই। তার বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী কিছুকাল কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন, জলরংয়ে অনেকগুলি ছবিও এঁকেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নির্মলেন্দু গুণ এই বইটিতে নিজের মধ্যের শিল্পসত্তার ব্যপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়েই ‘রবীন্দ্রনাথের ছবিতা’ শিরোনামের গদ্যে লেখেন :
‘আমার পক্ষে খুবই শোভন ও স্বাভাবিক হতো যদি কবি হওয়ার চেষ্টা না করে চিত্রশিল্পী হওয়ার চেষ্টা করতাম। চিত্রশিল্প সম্পর্কে আমার ভেতরে বংশাণুক্রমিকতা দোষে দুষ্ট আগ্রহ সুপ্তাকারে থাকার পরও, আমি এ কাজে সত্যিকার অর্থে যাকে হাত দেওয়া বলে, তা কখনো দেইনি। কেন দেইনি, তার ব্যখ্যা আমার জানা নেই। ’
১৯৭৫ সালে গুণ তার ‘ও বন্ধু আমার’ কাব্যগ্রন্থে প্রথম প্রচ্ছদ করেন। এই পর্যন্তু তিনি তার মোট ৫টি বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন। যদিও কখনও তার ছবির প্রদর্শনী হবে, এটা তিনি চিন্তাও করেননি। তার কবিসত্তার বাইরেও যে গভীর আঁকিয়ে সত্তাটি রয়েছে, তাকে জাগানোর ব্যাপারে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি নাসির আলী মামুন। কবি এই বিষয়টা এ বইতে অকপটে স্বীকার করেছেন।
আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন ১৯৭৫ সাল থেকে নির্মলেন্দু গুণের ছবি তুলছেন। নিজের তোলা ছবির মধ্যে মামুন সব সময়ই কবির অটোগ্রাফ নিতেন। অটোগ্রাফ নিয়েই খাতায় কিছু একটা এঁকে দিতে বলতেন। দীর্ঘদিন ধরে মামুন কবিকে দিয়ে এভাবে ছবি আঁকিয়েছেন। পরে তিনিই একদিন কবির হাতে তুলে দেন রঙতুলি। কবি তার বর্তমান আবাসস্থল কামরাঙ্গীর চরে বসে একের পর এক আঁকেন প্রদর্শনীর জন্য ৩১টি ছবি।
প্রদর্শনীতে কবির আঁকা ছবির পাশাপাশি, ছবির নিচে দেওয়া শিরোনামগুলোও ছিল লক্ষ করার মতো। কয়েকটি ছবির শিরোনাম হচ্ছে এরকম : অপেক্ষা, কামিনী, ধ্যানমগ্ন কবি, মোনালিসা, নর্তকী, লাল চাল, বিজয় ১৯৭১, পদ্মবনে মত্ত হস্তী (সিরিজ ছবি), কামকানন, রঙের জাতক প্রভৃতি। শিরোনামগুলোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবি ছবিগুলি একেবারে শুধু শুধু আঁকেননি, তার লেখা প্রেম ও রাজনৈতিক কবিতার মতোই ভেতরে কোনো একটা চেতনাকে লালন করেই তিনি ছবিগুলি এঁকেছেন।
বইটির মধ্যে স্থান পেয়েছে কবির ছবি আঁকা ও প্রদর্শন প্রসঙ্গে নিজের লেখা দুটি গদ্য, ছবি প্রদর্শনের আগে জব্বার হোসেনের নেওয়া চিত্রকর গুণের সাক্ষাৎকার, প্রদর্শনী নিয়ে দেশের কয়েকজন শিল্পরসিকের আলোচনা ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এই প্রদর্শনীর সংবাদ। স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে আঁকা কবির ছবির পাশাপাশি শশীকুমার হেশ, সারদা রঞ্জন রায়, হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার ও সুখেন্দু প্রকাশ গুণের আঁকা কয়েকটি ছবি।
‘রঙের জাতক’ বইটি একজন বড় মাপের কবি কীভাবে চিত্রশিল্পী হয়ে উঠলেন সে প্রসঙ্গে জানার পাশাপাশি, যারা কবির ছবির প্রদর্শনী দেখতে পারেননি তাদের কবির আঁকা ছবি দেখার তৃষ্ণা কিছুটা হলেও মেটাবে। কারণ ছবিগুলো ছাপা হয়েছে আর্ট পেপারে, রঙিন।
বইটির প্রকাশক বাংলা প্রকাশ, কবির ছবি ও পরিকল্পনা অবলম্বনে প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। দাম ১৮০ টাকা।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৬১০, জুলাই ২৪, ২০১০