ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

দিনের শেষ আলো | রোকসানা হাবিব লুবনা

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫
দিনের শেষ আলো | রোকসানা হাবিব লুবনা

সন্ধ্যার সময় শুধু মানুষেরই মন খারাপ হয় না, মনে হয় আকাশেরও অনেক মন খারাপ হয়ে যায়। তা-না হলে আকাশটা এত দ্রুত কেন কালো হয়ে যায়? ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে, মনে হয় দিনকে খুব আয়েশ করে বিদায় দেবার সাহস আকাশেরও নেই।

মানুষের অবচেতন মন এটা মনে হয় অনুভব করতে পারে, তাইতো আকাশের সাথে তারও মন খারাপ হয়ে যায়। চা টা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে কিন্ত তারপরও মগটাকে হাতে ধরে দাড়িয়ে আছি আর আকাশের সাথে তার দিনকে বিদায় জানাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। এ যেন শেষ সময়ে তার সাথী হবার ক্ষুদ্র প্রয়াস। যেন চুপ করে তাকে বলা আমি আছি, আমি আছি তোমারই পাশে। ভয় পেয়ো না, দিনের এই শেষ বেলায় তোমাকে একা ছেড়ে যাব না। চারিদিকে মাগরিবের আজান শুরু হয়ে গেল। একটা মসজিদে আজান শেষ হলেই আবার অন্য মসজিদে শুরু হয়। এই সময়টায় একই সাথে ভালোলাগা আর বিষণ্নতা দুটোই কাজ করে। একটা কথা ভেবে খুবই অবাক লাগল, দিনের অন্য সময়ের আজান শুনলে কেন এমন অনুভূতি হয় না? একটা দিন জীবন থেকে চলে গেল এ কারণেই কি সন্ধ্যার আজানের সাথে বিষণ্নতা এসে ভর করে? আমি জানি না, কত কিছুই যে মনে হয়!

ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে বাসায় ঢুকতেই দেখি আমার খালা বসে আছেন সোফায়। আমাকে দেখেই তিনি জড়িয়ে ধরলেন। এখনই কান্না শুরু করবেন, কতদিন তোকে দেখি না, কেমন যেন শুকিয়ে গেছিস—এইসব বলবেন, এই কথাগুলি আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। খালা যে এটা শুধু আমাকে বলেন তা নয়, যাকে দেখেন তাকেই বলেন। কোনও মানুষের মন এত নরম হয় কী করে? আমি খালাকে দেখলেই সেটা ভাবতে শুরু করি।

ছাদে বসে বই পড়তে সৌমিকের খুব ভালো লাগে। চারিদিকে পাখির ডাক আর সেই সাথে মানুষের নানা রকম কথা। বিভিন্ন শব্দ অন্যরকম একটা সঙ্গীত মনে হতে থাকে। আজ দুই দিন সে বিকালে ছাদে এসে বই পড়ে আর দেখে সন্ধ্যার ঠিক আগে একটা মেয়ে চায়ের মগ হাতে নিয়ে ছাদে আসে। আপন মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে যে এখানে চিলেকুঠির পাশে বসে বই পড়ছে এবং ছাদে সে ছাড়া অন্য কেউ আছে, সেটা সে এখনও টের পায়নি। নিজের মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা আর তখন সে বই থেকে চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এত বিষণ্নতা কেন ওর চোখে, কত দূর সে দেখতে পায়? নাকি দিনের আলো চলে যাওয়ায় আকাশের বিষণ্নতার সাথে সেও সাথী হয়। আজও সে সৌমিককে দেখেনি, তার উপস্থিতি সে উপলব্ধি করেনি। কী অনায়াসে অন্যমনস্কভাবে নিচে নেমে গেল।

আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে, আকাশে জুড়ে কালো মেঘের সমারোহ এবং চারিদিক থেকে আরও কালো মেঘেদের মনে হয় কেউ আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। মেঘের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন আকৃতির খেলা করতে খুব ভালো লাগে, কখনও মাথা, কখনও কোনও মানুষের মুখ আরও কত কিছু যে আঁকি। এই খেলাটা আমাকে বাবা শিখিয়েছেন। আমি আর বাবা, কে কত রকমের আকৃতি বানাতে পারি এটার একটা প্রতিযোগিতা হতো। আমি সব সময় জিতে যেতাম কিন্ত আমি বুঝতে পারতাম বাবা ইচ্ছা করেই আমাকে জিতিয়ে দিতেন। কেন জানি না সেটা জেনে জিতে যাওয়ার পরও আমার খুব আনন্দ হতো। কতগুলি কাক এত হৈ চৈ করছে কেন বুঝতে পারছি না। মানুষ কত কিছু পারে কিন্ত পাখির ভাষা কেন বুঝতে পারে না? আমার খুব ইচ্ছা করে পাখির ভাষা বুঝতে। ওরা কি আড্ডা দেয়? কী ওদের বিষয়? হঠাৎ করে পিছন থেকে কে জানি আমাকে জোরে টান দিয়ে পিছনে নিয়ে গেল।

- আরে পড়ে যাবে তো? এত ঝুঁকে কেউ নিচে দেখে?

আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি খুব সুন্দর একটা ছেলে। মাথা ভরা তার ঘন কালো চুল। এত বাতাসেও তার চুলগুলি বেশ পরিপাটি হয়ে আছে। বললাম ‘মানে? আপনি কে? আমাকে এইভাবে পিছনে টেনে আনলেন কেন? মেয়ে দেখলেই গায়ে হাত দিয়ে কথা বলতে হবে? এটা হলো ছেলেদের একটা সমস্যা। ’

ছেলেটি বলল ‘তোমার কি বলা শেষ হয়েছে নাকি আরও কিছু বলা বাকি আছে? থাকলে সেটা বলে নাও, তারপর আমি একটা একটা করে তার উওর দেব। ’

আমি বললাম ‘বাহ! আপনি তো দারুণ! মনে হয়, আমি খুব মজার কোনও কথা বলেছি!

উনি বললেন, মজার কথাই তো! তুমি যে একটা মেয়ে এটা তো আমার মাথায় আসেনি। কারণ আমি সবাইকে মানুষ মনে করি। তারপর আমার কাছে মানুষ দুই রকম, ভালো মানুষ আর খারাপ মানুষ। এইবার সেই মানুষদের আবার দুই শ্রেণীতে ভাগ করি—এক শ্রেণীতে ছেলে আর অন্যটিতে মেয়ে। তাই আমি যখন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম তখন মনে হয়েছিল, এই মানুষটা এত ঝুঁকে কী দেখছে? যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, সেটা মনে করেই পিছন থেকে তোমার হাত ধরে সরিয়ে এনেছিলাম। তোমার ভাষ্য অনুযায়ী আমি যদি তোমাকে মেয়ে মনে করতাম তাহলে হয়ত অনেক দ্বিধা কাজ করত মনে, আর সেই দ্বিধা হয়ত তোমাকে ছাদের কিনারা থেকে সরিয়ে আনতে দিত না। যাই হোক এনে যখন ফেলেছি, তাহলে এখন আমরা কি একটু পরিচিত হতে পারি?

আমি সৌমিক। চারতলায় আমার খালার বাসায় এসেছি। ঠিক বেড়াতে না, বলতে পারো কিছু দিনের জন্য এটাই আমার ঘাঁটি। আর তুমি?

আমি শিউলী। আমরা দুইতলায় থাকি। কিছুদিন না, অনেক বছর ধরেই আছি—বলে হেসে দিলাম। সৌমিক আমার দিকে অবাক হয়ে তাঁকিয়ে থাকল! আমি বললাম কী দেখছেন? আমার মাথায় কোনও চুল নেই, তাই হাসলে খুব পঁচা লাগে?

সৌমিক মাথা নাড়ল। তারপর বলল, না, তুমি একদমই ভুল। তোমার কি মনে হয় চুল থাকলেই মেয়ে আর চুল না থাকলে মেয়ে না? আমি  দেখছিলাম, চুল ছাড়াও তুমি কত সুন্দর এবং নিষ্পাপ। কি সুন্দর ভুবন ভোলানো তোমার হাসি। তোমাকে কেউ বলেনি?

আমি খুব আগ্রহ করে জানতে চাইলাম, কী বলেনি?

সৌমিক বলল, তুমি হাসলে তোমার সাথে সারা পৃথিবী হাসে। অপূর্ব সেই হাসি, তুমি আর তোমার পৃথিবী। নিচের থেকে আম্মা ডাক দিলেন, তাই বললাম, আমি এখন যাই আম্মা ডাকছেন। বলেই আমি নিচের সিঁড়িতে পা দিলাম। আমি অনুভব করতে পারছিলাম সৌমিক আমার চলে আসার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ সময়টা খুব তাড়াতাড়ি চলে গেল। কখন যে দিনের আলো চলে গেল, দুই-তিনটা মসজিদে আজানও হয়ে গেল কিছুই টের পেলাম না। আমি কেন এত মুগ্ধ হয়ে সৌমিকের কথা শুনছিলাম?

সৌমিক নিচে নেমে দেখে খালা টেবিলে নাস্তা দিচ্ছেন। নিম্মিটা তার পুতুল নিয়ে খেলা করছে, তাকে দেখে বলল, ভাইয়া বল তো কোন পুতুলটা বেশি সুন্দর? আমি ওর গাল টিপে দিয়ে বললাম, এই পুতুলটা।

খালা হেসে বললেন তুই তো প্রতিদিন ছাদে যাস, শিউলীর সাথে তোর দেখা হয়েছে?

সৌমিক মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ দেখা হয়েছে।

খালা বললেন, ও খুব ভালো মেয়ে জানিস। আমি আজ ১০ বছর ধরে ওকে দেখছি। বলতে পারিস আমাদের সামনেই ও স্কুল শেষ করে কলেজ শেষ করল। তারপর মেয়েটার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। কেন যে এমন হয়, কেন আমরা কিছু করতে পারি না?

এরই মধ্যে খালু এসে টেবিলে বসলেন, বললেন কার আবার কী হলো? খালা কিছু না বলে আমাকেও টেবিলে বসতে বলে প্লেটে গরম সব্জির বড়া দিলেন আর সাথে টমেটো কেচাপ। সৌমিক একটা খেয়ে উঠে পড়ল। খালা-খালু দুইজনেই বললেন, কী হলো খাও? কিন্ত সৌমিকের খুব অস্থির লাগছিল। কিছুই খেতে মন চাইছিল না তার। সৌমিক তার রুমে গিয়ে সিডি প্লেয়ারে গান ছেড়ে দিল।

Katie Melua তখন তার আবেশী গলায় গেয়ে চলছে

You are beautiful, so silently it lies
Beneath the shade of blue
It struck me, so violently
When I looked at you !!!

বাসায় এলেই আম্মা সামনে কিছু আপেল দিয়ে বললেন সবটা শেষ করো, আমি নামাজ পড়ে আসি। আমি আপেলের প্লেট নিয়ে ভাবছিলাম সৌমিক ছেলেটার কথা। এখন আর কোনও মানুষকে নিয়ে ভাবতে মন চায় না। কোনও কিছুই ভালো লাগে না। ভুল বললাম ভালো লাগানোর ইচ্ছা হয় না। মনে হয় নতুন করে মায়ায় জড়িয়ে লাভ কী? মায়া যত কম হবে চলে যাওয়াটা তত সহজ হবে। পাশ থেকে হঠাৎ বাবা বললেন, কী ভাবছে আমার মা? আমি বুঝতেই পারিনি বাবা অফিস থেকে এসে কাপড় বদলে খাবার টেবিলে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন।

আমি হাসি দিয়ে বললাম, আমাকে একটু সাহায্য করবে বাবা? তুমি আমার সোনা, পাখি বাবা। বাবা হেসে বললেন আরও বলতে হবে তারপর চিন্তা করব সাহায্য করা যাবে কিনা। আমি হেসে বললাম, তুমি আমার জান, কলিজা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা।

বাবা বললেন থাক থাক আর না। এর বেশি বললে আমার তো হজমে সমস্যা হবে রে আমার সোনা মা। তোমার আপেল খেয়ে কিছু কমিয়ে দিতে হবে? আমি হাসি দিয়ে বললাম, আমার সোনা বাবা ঠিক ধরেছো। এতগুলি আমি খেতে পারব না বাবা। এর মধ্যেই আম্মা এসে হাজির, বললেন আমি সব শুনেছি। না, তুমি এক টুকরাও খাবে না, আজ দুপুরেও অনেক কম খেয়েছে। এই রকম কম খেলে ও তো দুর্বল হয়ে যাবে।

আমি বললাম, আম্মা চিন্তা করো না। আমি আপেলের সবগুলো টুকরা শেষ করব। তারপর আমি বাবার সাথে গল্প করতে করতে আম্মাকে খুশি করার জন্য কষ্ট করে শেষ করলাম। নিজের ঘরে গিয়ে আমার গল্পের বইগুলির সামনে দাঁড়িয়ে ওদের হাত বুলিয়ে দেখছিলাম। ইস! কতদিন বই পড়ি না! বইগুলির কাছে আসলেই মনে হয় ওরা আমায় ডাকছে। হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা সৌমিক কি বই পড়ছিল সেটা তো দেখা হলো না। সৌমিকের কথা মনে হওয়াতেই মন কেমন একটা ভালো লাগায় ভরে গেল। কেন যে এমন হলো নিজেরই খুব অবাক লাগল।

আজ সৌমিক বিকাল চারটা বাজার সাথে সাথে ছাদে চলে এসেছে। কেন জানি ঘরে মন বসছিল না। শিউলীর সাথে খুব কথা বলতে মন চাইছে। শিউলীকে প্রথম যেদিন দেখেছিল, ওই দিনই ওর মনে হয়েছিল এই আমার সাথী, বন্ধু। এই মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই সে তার পুরো জীবন পার করে দিতে পারবে। কী জানি একটা জাদু আছে, তারপর কথা হওয়ার পর সেই তীব্রতা আরও বেড়ে গিয়েছে। কী এক অদৃশ্য আকর্ষণ যেন মেয়েটির দিকে ওকে টেনে নিয়ে যায়। এই আকর্ষণ ওকে বিরক্ত করছে না বরং খুবই ভালো লাগছে এই অনুভূতি, এই আকর্ষণ সবকিছু। ভাবতেই ভাবতেই পায়ের শব্দ কানে এলো, মুহূর্তেই বুঝতে পারল শিউলী আসছে।

শিউলী এসেই ওকে দেখে খুব অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল, আপনি বিকালে বাইরে যান না?

সৌমিক হাসতে হাসতে বলল, যাই তো! এই যে আমি এখন বাইরে!

দূর! আপনি কি সব কথাই এই রকম মজা করে বলেন? কখনও কি সিরিয়াস হতে পারেন না?

সৌমিক হেসে বলল, সবাই অনেক সিরিয়াস সব কিছু নিয়ে। এই জন্য আমি সিরিয়াস না। একজন মজা করে কথা বললে কারও কি কোনও ক্ষতি হবে, বলো? ও ভালো কথা, গতকাল তুমি কি কাকগুলি কী বিষয়ে আড্ডা দিচ্ছিল এটা বোঝার চেষ্টা করছিলে?

আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ও জানল কিভাবে?

সৌমিক বলে চলেছে, ওরা আড্ডা দিচ্ছিল না। ওই পাশের ডাস্টবিনে কিছুক্ষণ আগে যে ময়লা ফেলে গিয়েছিল সেইগুলি কিভাবে সবাই নিয়ে যাবে তার পরিকল্পনা করছিল।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি জানলেন কিভাবে? ওরা কি আপনাকে বলে গেছে?

সৌমিক হাসতে হাসতে বলল, মেয়ে! আমি বড় হয়েছি জঙ্গলে। তাই অনেক কিছু প্রকৃতির কাছ থেকে শিখেছি। কি, বুঝেছো মেয়ে?

আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ বুঝছি। এইবার বলুন কী বই পড়ছেন আপনি?

সৌমিক আমাকে হাতের পিছন থেকে একটা ঠাকুমার ঝুলি বের করে দেখাল।

আমি তো অবাক। নিজের অবাক হওয়াটা কোনওভাবেই লুকাতে পারলাম না। আমি কিছু বলার আগেই ও বলতে থাকল, অবাক হবারই কথা, হ্যাঁ এটা ঠাকুমার ঝুলি। আমি ছোট বেলায় কোনও ঠাকুমার ঝুলি পড়িনি। এখানে আসার পর নিম্মি শুধু গল্প শুনতে চায়, কিন্ত আমি ওকে বলার মতো কোনও গল্প জানি না। সব সময় বোনটা আমার মন খারাপ করে। ওই দিন নীলক্ষেতের পাশ দিয়ে আসার সময় বইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম, তখন ফুটপাতে একটা ছোট ছেলের কাছে কিছু পুরানো বই পেলাম। ছেলেটা সারাদিন বসে আছে কিন্ত কেউ এই ছোট বাচ্চাদের বই কিনছে না। ও আমাকে বারবার করে বলল, স্যার! আপনার ছোট ভাই-বোন নেই? থাকলে তাদের জন্য নিয়ে যান। আজ সারাদিন একটা বইও বিক্রি হয়নি। কী নিয়ে বাড়ি যাব? আমার মনটা খুব খারাপ হলো। তাই ওর কাছ থেকে বাচ্চাদের সব বই আমি কিনে নিলাম। ছেলেটার চোখে মুখে তখন যে আনন্দ ছিল, তার কাছে এই বইয়ের মূল্য আরও অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বাসায় ওই বইগুলি নিয়ে আসলে নিম্মি মনে করেছিল আমি ওর জন্য এইসব বই কিনেছি। আমার ছোট বোনটা অনেক খুশি হলো। কী করবে কোনটা তাকে আগে পড়ে শোনাব এটাই সে বুঝতে পারছিল না। এমনকি রাতে ওইসব বইগুলি তার মাথার কাছে রেখে তারপর সে ঘুমাল। সেই দিন থেকে আমি দিনে এই বইগুলি পড়ি আর রাতে ওকে খুব মজা করে একটু একটু করে গল্প বলি।

হঠাৎ নিম্মি ছাদে এসে বলল, ভাইয়া তোমার ফোন। সৌমিক তাড়াতাড়ি নিচে চলে গেল। নিম্মি আমার সাথে কুটুস কাটুস করে গল্প করতে থাকল। নিম্মি খুবই মিষ্টি একটা বাচ্চা, দেখলেই গালটা টিপে দিতে মন চায়। কিন্ত ব্যথা পাবে, তাই কোনও দিন গাল টেপা হয়নি। আমি একমনে নিম্মির গল্প শুনছি কিন্ত মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। আজান দিলে আমি নিম্মিকে নিয়ে নিচে নেমে গেলাম। চারতলা দিয়ে যাওয়ার সময় নিম্মিকে বাসার ভিতরে দিতে গেলেও সৌমিককে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমি চলে এলাম, কেন জানি কেমন কান্না পেতে থাকল। আর ঠিক সেই সময় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হলো। আমার কান্না আর আকাশের কান্না মিলেমিশে এক হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম, আমি মায়ায় বাঁধা পড়ছি। আমার মন সৌমিকের কথা শুনতে চাইছে। কিন্ত আমার মাথা বলছে এটা ঠিক হবে না। সম্পর্ক থেকে যত দূরে থাকবে ততই তোমার চলে যাওয়াটা সহজ হবে, কষ্ট কম হবে। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম নিজেই টের পেলাম না। দশটা বাজলে আম্মা ঘুম থেকে উঠিয়ে খাওয়ালেন, তারপর ঔষধ খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

আজ বিকালে আর ছাদে যাওয়া হবে না কারণ চপলা এসেছে ওর বিয়ের দাওয়াত দিতে। হঠাৎ করেই ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে সুইডেনে থাকে, খুব ভালো একটা চাকরি করে। চপলা খুব খুশি। ওর সাথে মুন, সাথী এরাও এসেছে আমাকে দেখতে। ওদের সাথে গল্প করতে করতে হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দ পেলাম।

আম্মা দরজা খুলে দিলেন, বললেন আসো সৌমিক। শিউলীর বন্ধুরা এসেছে, তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই। আমার বন্ধুরা সবাই দাঁড়িয়ে ওকে সালাম দিল। তারপর বললেন, চপলার বিয়ে তাই দাওয়াত দিতে এসেছে ওরা। আম্মা বললেন, কিন্ত শিউলীকে একা কিভাবে পাঠাব মা? আমিও তো যেতে পারব না।

হঠাৎ করে মুন দুষ্টুমি করে বলে বসল, আরে সৌমিক ভাই, আপনারও দাওয়াত। প্লিজ আপনি শিউলীকে নিয়ে আসেন। কতদিন শিউলী বাইরে বের হয় না। আন্টি দয়া করে না বলবেন না। শিউলী না গেলে আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে যাবে।

সৌমিক আমতা আমতা করতে থাকল, বলল, আমি তো কাউকে চিনি না। সবাই কী বলবে?

চপলা বলল, ভাইয়া আমাদের তো আপনি চিনলেন। শিউলীকে আপনি চেনেন। এরপর তো আর কাউকে চেনা লাগে না! আমাদের মধ্যে মুন সব থেকে বেশি দুষ্টু কিন্ত ওর মনটা খুবই ভালো। ও বলল, আমি আপনার সাথে সাথে থাকব ভাইয়া, এইবার দয়া করে রাজি হয়ে যান।

সৌমিক আম্মার দিকে তাকাল। আম্মা বললেন, ঠিক আছে। সৌমিক সাথে গেলে আমি শিউলীকে পাঠাব। সবাই ইয়াহু বলে জোরে চিৎকার করে উঠল।

আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল, মাথাটাও ঝিম ঝিম করছিল। ওরা বিদায় নিয়ে চলে গেল। সৌমিকও ওদের সাথে চলে গেল। আমি আজ আর ওর সাথে কথা বলতে পারলাম না। আমি শুয়ে পড়লাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলাম।

পরের দিন বিকালে আম্মা আমাকে একটা লাল জামদানি দিয়ে বললেন এটা পরে রেডি হয়ে নাও। তাহলে সৌমিকের আর অপেক্ষা করতে হবে না। আম্মা ডাক দিলেন, কই শিউলী? সৌমিক অপেক্ষা করছে, তোমার এখনও হয়নি?

আমি ঘর থেকে বের হয়ে আসলে আম্মা আমাকে দেখে কেঁদে বললেন, কারও নজর যেন না লাগে আমার মেয়েটার ওপর। আমি খুবই লজ্জা পেলাম সৌমিকের সামনে। কারণ আমি জানি আমাকে মোটেই সুন্দর লাগছে না, যার মাথায় কোনও চুল নেই তাকে কেমন লাগতে পারে? কিন্ত আম্মাকে কিছু বলতে মন চাইল না। মনে হলো এইটুকু খুশি যে আম্মাকে করতে পেরেছি এটাই আমার জন্য অনেক। এই স্মৃতি নিয়েই হয়ত আম্মা বাকি জীবন বেঁচে থাকতে পারবেন। আমি যখন সৌমিকের সাথে নিচে নামলাম তখন হঠাৎ করে দেখি ও আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। আমি জানতে চাইলাম, কী দেখছেন?

ও চারিদিকে তাকিয়ে কিছু খোঁজার ভান করল। তাই দেখে আমিও চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম কী দেখছে সে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কই কোথাও তো কিছু নেই তুমি ছাড়া, বলেই হেসে দিল।

আমি বললাম, মানে?

বাকি অংশ পড়তে ক্লিক করুন



বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।