গল্পটা অ্যালান কোয়াটারমেইনের মুখ থেকে শোনা। দক্ষিণ আফ্রিকায় সবাই তাকে শিকারী কোয়াটারমেইন বলেই চেনে।
সেটাই ছিল কোয়াটারমেইনের বাসায় আমার শেষ দিন। ডিনারের পর আমাকে আর ক্যাপ্টেন গুডকে গল্পটা শোনালেন। মাঝে দু’তিন গ্লাস পুরনো পর্তুগিজ মদও গিলেছেন। সেটা অবশ্য গুড আর আমাকে দ্বিতীয় বোতলটা শেষ করতে সাহায্য করার জন্যই। হয়ত মদের কারণেই গল্পটা শুনতে পেরেছিলাম আমরা। নইলে তার অভিযান, শিকার এসব নিয়ে কথা বলতে খুব একটা পছন্দ করেন না তিনি।
সামনে তাকের উপর রাখা একটা সিংহের খুলির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কোয়াটারমেইন বললেন, ‘আহ! জাঁদরেল জানোয়ার! গত বারো বছর ধরে ভালোই ভোগাচ্ছ। মরার আগ পর্যন্ত আর থামবে বলে তো মনে হয় না। ’
‘তুমি কথা দিয়েছিলে ওই সিংহের গল্পটা বলবে। আজ বলেই ফেল। ’ বললেন গুড।
‘আরে ওসব শুনতে চেও না। বিরাট কাহিনী। ’ উত্তর দিলেন কোয়াটারমেইন।
‘আরে, অসুবিধা কী রাত তো এখনও অনেক বাকি। আর পর্তুগিজ বোতলটাও অনেকটা খালি। ’ আমি বললাম।
কাজ হলো। পাইপে তামাক ভরে নিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন।
যতদূর মনে পড়ছে ঘটনাটা ’৬৯ এর মার্চে। সেকুয়াতির পর সিকুকুনি কেবল ক্ষমতায় এসেছে। আমি তখন ওখানেই ছিলাম। কানে আসলো বাপেডিরা আফ্রিকার গহীন থেকে অনেক হাতির দাঁত সঙ্গে এনেছে। তাই ওয়াগন ভর্তি করে জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হাতির দাঁত কেনার জন্য। ওই এলাকার জন্য সময়টা মোটেই ভালো না, কারণ বছরের এসময়টায় বিশ্রী রকম জ্বর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমি ছাড়াও আরও দুয়েকজন আছে যাদের ওই আইভরিগুলো দরকার। তাই একটু ঝুঁকি নিয়ে হলেও বেরিয়ে পড়লাম।
যাই হোক কিছুদূর গিয়ে একটা ক্রাল পেলাম। প্রায় সন্ধ্যা। ভাবলাম ক্রালে কিছু দুধ আর ভুট্টা পাব। কাছে যেতেই দেখি, ক্রালটা অস্বাভাবিকরকম নীরব। কোনও সাড়া শব্দ নেই। কিন্তু দেখে বোঝা যাচ্ছে ক্রালটাতে মানুষ থাকে।
একটু আজব লাগলেও এগিয়ে গেলাম ক্রালের বড় ঘরটার দিকে। কাছে যেতেই দেখি ভেড়ার চামড়া দিয়ে কিছু একটা ঢাকা। চামড়াটা একটু তুলতেই চমকে উঠলাম। একটা কম বয়সী মহিলার লাশ। আর যাই হোক অন্তত এটা আশা করিনি। একবার ভাবলাম ফিরে যাই কিন্তু কৌতূহল আমাকে বড় ঘরটার দিকে টেনে নিয়ে গেল। লাশটা পার হয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে দেখি ঘর পুরো অন্ধকার। পকেট থেকে ম্যাচটা বের করে জ্বালালাম। প্রথমে দেখলাম একটা পরিবার ঘুমিয়ে আছে। নারী, পুরুষ, বাচ্চা-কাচ্চা মিলে পাঁচ জন। কিন্তু ম্যাচের কাঠিটা ভালো করে জ্বলতেই বুঝলাম, সবাই মৃত। হঠাৎ বিশ্রী একটা অনুভূতি আমাকে ঘিরে ধরল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সামনেই দেখি ঘরের এক কোণে এক জোড়া উজ্জ্বল চোখ। আমি ভেবেছিলাম বনবিড়াল বা সেরকম কিছু। প্রায় সাথে সাথেই কেউ চিৎকার করে উঠল।
তাড়াতাড়ি আরেকটা দিয়াশলাই জ্বালাতেই দেখি, এক বুড়ি। পরে জানলাম আমাকে দেখে তার মনে হয়েছিল, আমি আজরাইল তার জান কবজ করতে এসেছি। সেজন্য ভয়ে চিৎকার দিয়েছে। কোলে তুলে বুড়িকে ওখান থেকে বের করে আনলাম। কারণ বের হওয়ার শক্তি বা ইচ্ছা বা দুটোর কোনওটাই তার ছিল না। বুড়ির হাড় জিরজিরে শরীর দেখে মনে হলো, কেউ শুধু হাড়ের উপর একটা চামড়া পরিয়ে দিয়েছে। ওয়াগনে এনে হালকা খাবার দিলাম। খেয়ে কথা বলতে শুরু করল বুড়ি। জানাল যে ক্রালের সবাই জ্বরে মারা গেছে। আর সবাই মারা যাওয়ার পর আশপাশের ক্রালের লোকজন তাদের গবাদি পশু নিয়ে গেছে।
বুড়িকে আমি কাছের আরেকটা ক্রালে নিয়ে গেলাম। আর ক্রালের প্রধানকে একটা কম্বল দিয়ে বুড়ির দেখাশোনা করতে বললাম। আর এও কথা দিলাম যে, ফিরে এসে যদি দেখি বুড়ি ভালো আছে তাহলে আরেকটা কম্বল দেব। ক্রালের প্রধান বেশ অবাক হয়ে বলল, ‘এই অকর্মা বুড়ির জন্য আপনি অযথাই দুটো কম্বল নষ্ট করছেন। ’ তোমরা তো জানোই আদিবাসীদের বিশ্বাস কেমন। যার লড়াই করে বেঁচে থাকার ক্ষমতা আছে সে বেঁচে থাকবে, আর যার নেই তার বাঁচার অধিকারও নেই।
বুড়ির হিল্লে করে পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম। এগারটা পর্যন্ত অনেক খারাপ রাস্তা পাড়ি দিলাম। তারপর থামলাম বিশ্রামের জন্য। ইচ্ছা ছিল ষাঁড়গুলোকে একটু চড়িয়ে আবার সন্ধ্যা নাগাদ রওনা হব। চাঁদের আলোয় আরামে এগোতে চাই আর কি। তো সেজন্যই রাখালটাকে দিয়ে ষাঁড়গুলো চরাতে পাঠালাম আর নিজে ঢুকলাম ওয়াগনে। একটু আরাম করতে গিয়ে ঘুমিয়েই পড়লাম। ভালো একটা ঘুমও হলো। আড়াইটায় ঘুম ভাঙল। উঠে খেয়ে নিলাম। খাওয়া হলে ড্রাইভার টম বাসনপত্র ধুতে নিয়ে গেল। তখনই দেখি হারামজাদা রাখাল একটা একটা ষাঁড় নিয়ে ফিরছে।
‘বাকি ষাঁড়গুলো কই?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘বুঝতে পারছি না, মাকুমাজন(স্থানীয়রা আমাকে মাকুমাজন বলে ডাকে)। আমি শুধু একবার এক মিনিটের জন্য ওগুলোকে চোখের আড়াল করেছিলাম। তারপর দেখি এই এটা ছাড়া আর একটা ষাঁড়ও নেই। ’ ভয়ে ভয়ে বলল সে।
‘মিথ্যুক কোথাকার, মিথ্যা বলার আর জায়গা পাস না, তুই ওগুলোকে ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলি আর এ সুযোগে ওগুলো পালিয়েছে, তাই না?’ আমার মেজাজ সত্যিই অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল কারণ ওই জ্বরের এলাকায় এসময় আটকে পড়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না, ‘এখনই যা নিয়ে আয় ওগুলোকে। আর টম, তুমিও ওর সাথে যাও। ষাঁড়গুলো মনে হয় মিডেলবার্গের দিকেই গেছে। আমি এখানেই আছি। ষাঁড়গুলো না নিয়ে ফিরবে না, মনে থাকে যেন। ’
টম ছেলেটার পাছায় কষে একটা লাত্থি মারল, অবশ্য লাত্থি খাওয়ার মতোই কাজ করেছে সে। তারপর ফিরিয়ে আনা ষাঁড়টাকে বেঁধে রেখে এসেগাই হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আমিও যেতাম কিন্তু ওয়াগনের কাছে কাউকে না কাউকে তো থাকতেই হবে। একা একা বিরক্ত লাগছিল তাই রাইফেলটা হাতে নিলাম আশেপাশে কিছু শিকার পাওয়া যায় কিনা এই ভেবে। তারপর দুই ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করেও শিকার করার মতো কোনও প্রাণী চোখে পড়ল না। তারপর ওয়াগনের কাছে আসতেই ওয়াগন থেকে ষাট-সত্তুর গজ দূরে একটা ইম্পালা দেখলাম। আরামসে ওটাকে শিকারও করলাম। তারপর ওটার একটা গতি করতে করতেই সূর্য ডুবে চাঁদ উঠে গেল। সে রাতে চাঁদটা মনে হয় একটু বেশিই সুন্দর ছিল। কিন্তু অসম্ভব নীরব রাত। চারদিকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। একেবারে প্রাণীশূন্য এলাকা, পাখির ডাকও নেই। এমনকি বাতাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে না। এমন নিঃসঙ্গ অবস্থায় বেঁধে রাখা ষাঁড়টাকে ধন্যবাদ দিলাম এই ভেবে যে, আমি ছাড়াও এ তল্লাটে আরেকটা জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব আছে।
কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম ষাঁড়টা যেন একটু অস্থির অস্থির। আমি খুব একটা আমল না দিয়ে ওয়াগনে ঢুকলাম।
ভুলটা ভাঙতে বেশি সময় লাগল না। একটা গর্জন শুনলাম। তারপর মুহূর্তেই একটা কিছু লাফিয়ে গেল ষাঁড়টার দিকে। বুঝে ফেললাম কী হয়েছে। কয়েক মুহূর্ত পর ষাঁড়টার গলার ঘরঘর আওয়াজ আমার কানে এলো। রাইফেলটা ওয়াগনের ভেতরেই ছিল। গুলি ভরে কেবল লাফিয়ে ওয়াগন থেকে নেমেছি, সাথে সাথে পেছনে কারও অস্তিত্ব অনুভব করে পাথর হয়ে গেলাম। বুঝলাম সিংহটা আমার পেছনেই। বলতে কোনও দ্বিধা নেই, সেদিন আমি সত্যিই বুঝেছিলাম ভয় কাকে বলে।
এরকম ভয় আমি আর কোনদিন পাইনি। জানের ভয়ে প্রথমে নড়লাম না। পরে দেখি আমি চাইলেও নড়তে পারছি না। সিংহটা শুঁকতে শুঁকতে আমার উরু পর্যন্ত উঠে এলো। ভাবলাম এবার মরণ কামড় বসাবে। কিন্তু তা না করে, মরা ষাঁড়টার কাছে ফিরে গেল। তখন ওটার পুরো দেহটা দেখতে পেলাম। ওইটা ছিল আমার দেখা সবচেয়ে বড় সিংহ। বড় সিংহ আমি অনেক দেখেছি কিন্তু ওইটা ছিল সেগুলোর চেয়েও অনেক বড়। কালো কেশরওয়ালা একটা পুরুষ। তোমরা ওর দাঁতগুলো দেখেই তো বুঝতে পারছো কত বড় ছিল প্রাণীটা। সিংহটা আমার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই ষাঁড়টার রক্ত চাটতে শুরু করল। তারপর এত জোরে গর্জন করে উঠল যে, বাড়িয়ে বলছি না, মনে হলো পুরো ওয়াগনটা কেঁপে উঠল। সাথে সাথে গর্জনের উত্তরে আরেকটা গর্জন শোনা গেল।
বুঝলাম ওর সঙ্গিনী।
প্রায় সাথে সাথেই ঘাসের বাইরে বের হয়ে এলো সিংহী। তার সাথে ম্যাস্টিফ কুকুর সাইজের দুটো বাচ্চা। সিংহী একবার আমার দিকে তাকাল তারপর বাচ্চাদের নিয়ে ষাঁড়টার দিকে মনোযোগ দিল।
তখন আমার থেকে মাত্র আট দশ ফুট দূরে চারটে সিংহ খাচ্ছে, গরগর করছে, শিকারের মাংস ছিঁড়ছে, কটর মটর শব্দে হাড় ভাঙছে। ভয়ে আমার অবস্থা কাহিল। একসময় বাচ্চাগুলোর খাওয়া শেষ হলো। তারা ছোটাছুটি শুরু করল। প্রথমে ওয়াগনের পেছনে গিয়ে ইম্পালাটার ছেলা দেহটা নিয়ে টানাটানি করল দুজন। ইম্পালার সাথে খেলা শেষ হলে চোখ পড়ল আমার দিকে। এসে আমাকে শুঁকতে শুরু করল। তারপর একটার কী যেন হলো, আমার পা চাটতে শুরু করল। প্যান্ট তুলে পায়ের চামড়া চাটতে শুরু করল। ওদের খরখরে জিহ্বা প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি খরখরে হচ্ছে বলে মনে হলো আমার। প্রমোদ গুনলাম। কখন যেন পায়ের চামড়া ছিলে যায়! আর রক্তের স্বাদ একবার পেলেই আর রক্ষা নাই। ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইলাম জীবনের সব পাপের জন্য। ছোটবেলার ভালো ভালো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল।
তখনই মানুষের শব্দ শুনলাম। টম আর ছেলেটা ষাঁড়গুলো নিয়ে ফিরে এসেছে। ওদের আসার ব্যাপারটা সিংহগুলোও বুঝে ফেলেছে। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে মানুষের আওয়াজ শুনে ওরা নিঃশব্দে আবার ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে গেল।
সে রাতে সিংহগুলো আর ফিরল না। সকাল হতে হতে আমার নার্ভ স্বাভাবিক হয়ে এলো। সাথে মেজাজও খারাপ হলো। তাছাড়া সিংহগুলো যে ষাঁড়টাকে মেরেছে সে ষাঁড়টা আমার খুব পছন্দের ছিল। তাই সব মিলে আমার মধ্যে প্রতিশোধের নেশা চেপে বসল। ঠিক করলাম পুরো সিংহ পরিবারটাকে, বেঁধে রাখা জন্তু শিকার করার উচিত শিক্ষা দেব। তুলে নিলাম একটা নাম্বার ১২ স্মুথবোর, ওটা আমার প্রথম ব্রিচলোডারগুলোর মধ্যে একটা। সিংহ শিকারের জন্য রাইফেলটা আমার বিশেষ পছন্দের। সাথে নিলাম টমকে। টম অবশ্য আমার এ সিদ্ধান্তে খুব একটা খুশি হলো না।
প্রথমে সিংহগুলোর দিনের বেলায় শুয়ে থাকার জায়গাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। ওয়াগন থেকে একশ’ মিটার দূরে ছোট্ট একটা প্যানের (পানি শুকিয়ে তৈরি একরকম চারণভূমি, বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকে) মতো জায়গা দেখলাম। যার পেছনের দিকটা বেশ খনিকটা উঁচু। ওটার মাঝে একটা মিমোসা গাছ পুরো জায়গাটা সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে। আশেপাশে আরও অনেক ঝোঁপ জাতীয় গাছ ছিল, যেগুলোর নাম এখন আর মনে করতে পারছি না।
বুঝলাম যাদের খুঁজছি তাদের দিনাতিপাতের জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আশেপাশে নেই। টিলাটার মাঝমাঝি উঠতেই একটা ভিল্ডারবিস্টের মৃতদেহ পেলাম। যেটা তিন চারদিন আগে কোনও সিংহ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। বুঝলাম ঠিক জায়গাতেই এসেছি। আজ যদি সিংহগুলো এখানে নাও থাকে, তাহলেও তাদের নিয়মিত যাতায়াত আছে জায়গাটাতে। একটু পরে এও বুঝলাম যে, সিংহগুলো দিনের একটা বড় সময় ওই জায়গায় কাটায়। এখন ব্যাপার হলো ওগুলোকে খুঁজে বের করব কিভাবে। ওগুলোকে খুঁজতে ওদের আস্তানায় যাওয়া আর আত্মহত্যা করা একই কথা। চারপাশে সুন্দর বাতাস বইছিল। বাতাসটা আমাকে একটা আইডিয়া দিল। ভাবলাম ঘাসে আগুন দিলে কাজ হবে। আমাকে আর রাস্তা বয়ে ওদের খুঁজতে হবে না, ওরা নিজেই বের হয়ে আসবে। আমার কথা মতো টম আগুন জ্বালানোর কাজ শুরু করল বাম দিক থেকে। আমি ডান দিক থেকে। অবশ্য প্রথম আগুন জ্বালাতে বেশ বেগ পেতে হলো। আধাঘণ্টা চেষ্টা চরিত্র করে আগুন জ্বালাতে পারলাম আমরা।
কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। পেছনের দিকটা উঁচু হওয়ায় কোনও প্রাণী ওদিকটা দিয়ে বের হতে পারবে না সহজে। বের হতে হলে আমাদের এপাশ দিয়েই বের হতে হবে। এবার শ্যুট করার জন্য ভালো একটা জায়গা খোঁজার পালা। আমি শ্যুট করার জন্য যে জায়গাটা নিয়েছিলাম, সেটা আগুনের বেশ খানিক সামনে খোলা জায়গায়। এমনিতে খোলা জায়গায় এভাবে দাঁড়ানো খুবই রিস্কি। কিন্তু তখন আমার রাইফেলের হাত এত ভালো ছিল যে রিস্কটা নিয়ে খুব একটা বিচলিত হলাম না। ‘এবার আসল কাজ। ’ নিজেকে বললাম আমি। তখনই ঝোঁপের মধ্যে হলুদ একটা কিছুর নড়াচড়া খেয়াল করলাম। কিন্তু যখন ওটা বেরিয়ে এলো তখন বুঝলাম যাদের জন্য অপেক্ষা তাদের কেউ নয় প্রাণীটা। একটা সুন্দর রিট বক।
যাই হোক, রিট বকটাকে যেতে দিলাম। প্যানের পুরো জায়গাটার ওপর থেকে চোখ একবারের জন্যও সরালাম না। আগুন ততক্ষণে ফার্নেসের মতো জ্বলতে শুরু করেছে। আগুনের শিখা আকাশের দিকে প্রায় বিশ ফুট। কোনও কোনও ঝোঁপ তখনও সবুজ ছিল তাই ধোঁয়াও তৈরি হলো অনেক। আর বাতাস ধোঁয়া আমাদের দিকে নিয়ে এসে আমার দৃষ্টি পথে একটু বাধার সৃষ্টি করল। তাই শুয়ে পড়লাম। ঠিক সেই সময় একটা ভয়ার্ত গর্জন শুনতে পেলাম, তারপর আরেকটা, তারপর আবার আরেকটা। এতক্ষণে নিশ্চিত হওয়া গেল মিয়া ভায়েরা বাড়িতেই আছেন।
স্নায়ুতে উত্তেজনা অনুভব করলাম। কিছুক্ষণ পর সিংহ পরিবার বেরিয়ে আসতে শুরু করল। বের হয়েই আমাকে দেখতে পেল। কালো কেশরওয়ালা পুরুষটা এবার সামনে এগিয়ে আসলো। আমি আমার সমস্ত শিকারী জীবনে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর দেখিনি। একটা বিশাল পুরুষ সিংহের পেছনে তার পরিবার। আর তাদের পেছনে আগুনের লেলিহান শিখা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। চারপাশ ধোঁয়া ধোঁয়া। কিন্তু এই বিপদেও সিংহের পরিবার বাঁচানোর সংকল্প সহজেই চোখে পড়ছে।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করলাম। কিন্তু ওদের না মারলে আমার মরণ নিশ্চিত। হয় শিকার করো নইলে শিকার হয়ে যাও। তাই শিকারের সিদ্ধান্ত থেকে সরতে পারলাম না। খুব সহজ নিশানা বানালাম পরিবারের প্রধানকে। নিশানা কালো কেশরওয়ালার হৃৎপিণ্ড বরাবর। আমি প্রস্তুত। ট্রিগার টানতেও শুরু করেছি। এমন সময় উড়ন্ত ছাই এসে পড়ল চোখে। গরম ছাই চোখে পড়ায় মনে হলো কেউ আমার চোখে গরম লাভা ঢেলে দিয়েছে। তারপর যখন চোখ খুললাম তখন শেষ সিংহের লেজটা আরেকটা ঝোঁপের জঙ্গলের আড়ালে ঢুকে গেল।
এরকম একটা শট মিস করে মেজাজ পুরাই খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র আমি না। তাই পেছন পেছন আমিও গেলাম। টম যেতে নিষেধ করল। কিন্তু ওর নিষেধ শোনার মতো মন মানসিকতা তখন ছিল না। আমি যে খুব সাহসী তা বলব না (আমি আসলেই সাহসী নই), কিন্তু ততক্ষণে ওই সিংহগুলোকে মারার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এখন হয় আমি ওগুলোকে মারব না হয় ওগুলো আমাকে মারবে। আমার জেদের ব্যাপারটা তো তুমি জানোই। টমের নিষেধ শুনে বললাম, ‘তোমার যদি ভয় লাগে তাহলে যাওয়ার দরকার নেই, আমি একাই যাব। ’ আমার কথা শুনে টমও আমার পিছু পিছু আসতে শুরু করল। আর ফিসফিস করে বলল, হয় আমি পাগল হয়ে গেছি নইলে আমাকে জাদু করা হয়েছে।
আমরাও ঝোঁপের জঙ্গলটার কাছে পৌঁছলাম। ঝোঁপটা প্রায় একশ’ গজ লম্বা আর ঘন। প্রতিটা ঝোঁপের পেছনেই সিংহ অনায়াসে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা জানি না আমাদের সিংহ চারটা কোন কোন ঝোঁপের পেছনে আছে।
আমি বিভিন্নভাবে জঙ্গলের ভেতরে দেখার চেষ্টা করলাম। একসময় একটা ঝোঁপের পেছনে হলুদ কিছু নড়তে দেখলাম। সেই সময় আমার ঠিক অপজিটের আরেকটা ঝোঁপের পেছন থেকে একটা বাচ্চা বেরিয়ে এসে আবার প্যানের দিকে দৌড়াতে শুরু করল। ওটাকে গুলি করলাম। গুলি লাগল মেরুদণ্ডে। লেজের দু’ ইঞ্চি উপরে। পরে টম এসেগাই দিয়ে ওটার ওটার ইহলীলা সাঙ্গ করল।
আমি সাথে সাথে রাইফেলের ব্রিচ খুললাম। আরেকটা কার্টিজ কেবল ঢোকাতে শুরু করেছি, সেই মুহূর্তে দেখি সিংহী বেরিয়ে আসলো। অবশ্যই বাচ্চার চিৎকার শুনে। সে আমার থেকে বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ধীরে পেছাতে শুরু করলাম। সিংহীও ধীর গতিতে দৌড়ে এগোতে শুরু করল। প্রতি মুহূর্তে দূরত্ব কমছে। বিপদ আগে থেকেই ছিল কিন্তু সেই বিপদ তখন আরও বড় আকার ধারণ করল যখন দেখলাম আমার নতুন কার্টিজটা অর্ধেক ঢুকে আর ঢুকছে না। কার্টিজ কোম্পানির বাপ তুলে গালি দিয়ে ওই কার্টিজটা বের করতে চাইলাম। এবার দেখি কার্টিজটা বেরও হচ্ছে না। মাঝামাঝি অবস্থায় আটকে গেছে। উত্তেজনায় আর রাগে কার্টিজের গায়ে এত জোরে বাড়ি মারলাম যে হাতই কেটে গেল। রক্ত দিয়ে রাইফেল মাখামাখি। ”
এই বলে কোয়াটারমেইন তার হাতে শুকিয়ে যাওয়া কয়েকটা ক্ষত চিহ্ন দেখাল। আবার বলতে শুরু করল।
“এতজোরে মারার পর ভেবেছিলাম কার্টিজ খুলে গেছে কিন্তু টানাটানি করে দেখলাম খোলে নি। একসময় সিংহী আক্রমণের জন্য রেডি হলো। আমি প্রার্থনা করতে শুরু করেছি। সেই সময় পেছন থেকে টম চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলল, ‘আপনি ওর বাচ্চার দিকে যাচ্ছেন। ডানে সরে যান। ’
আমার মাথা তখনও পরিষ্কার ছিল, তাই সিংহীর ওপর চোখ রেখে ডানে ঘুরে পেছাতে থাকলাম।
আমাকে বাচ্চার থেকে সরে আসতে দেখে সিংহী আবার ঝোঁপের দিকে ফিরে গেল।
‘ইনকুসি, অনেক হয়েছে, এবার চলুন ওয়াগনে ফিরে যাই। ’ টম বলল।
‘যাব, টম। তবে তার আগে বাকি তিনটাকে মারব। ’ ততক্ষণে আমার গো চেপে বসেছে।
‘তোমার যদি ভয় লাগে তাহলে ফিরে যেতে পারো, আবার গাছে উঠেও বসে থাকতে পারো। ’
টম বুদ্ধিমানের মতো গাছে উঠতে শুরু করল। এখন আমার মনে হয়, ইশ! আমিও যদি সেদিন ওর মতো গাছে উঠে বসে থাকতাম!
তারপর চাকু বের করে, গুঁতাগুঁতি করে কার্টিজটা বের করতে পারলাম। সাধারণ কার্টিজের চেয়ে একটা কাগজের সমান পুরুত্বের সমান বেশি পুরু কার্টিজটা আরেকটু হলে আমার জীবনটাই নিয়ে নিত! তারপর আরেকটা কার্টিজ ভরে নিলাম রাইফেলে।
সিংহী আবার আরেকটা সবুজ ঝোঁপের পেছনে ঢুকে গেল দেখলাম। একটু এগিয়ে মনে হলো আর এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। একটা বড় সাইজের পাথর কুড়িয়ে নিয়ে সিংহীর ঝোঁপের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। পাথরটা মনে হয় আরেকটা বাচ্চার গায়ে লাগল। বাচ্চাটা লাফিয়ে বের হলো। খুব সহজেই আমার সহজ নিশানায় পরিণত হলো। এক গুলিতেই কাজ হলো।
প্রায় সাথে সাথেই সিংহী লাফিয়ে বের হয়ে বিদ্যুৎ বেগে আমার দিকে দৌড়াতে শুরু করল। আমি খুব তাড়াতাড়ি একটা বুলেট হানতে পারলাম ওর পাঁজরে। গুলি খাওয়া খরগোশের মতো তিন চারবার পল্টি খেল ওটা। তারপর আবার উঠে চরম আক্রোশে সর্বশক্তি দিয়ে এগোতে শুরু করল আমার দিকে। এমন আক্রোশ যে আত্মা কেঁপে উঠল আমার। আমি ওর বুকে আরেকটা গুলি করতেই পড়ে গেল ও। চিরদিনের মতো নিঃস্তব্ধ।
নিজের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে আমি আবার রাইফেল রিলোড করলাম এবং কালোকেশরকে খুঁজতে শুরু করলাম। খুব সাবধানে ঝোঁপের জঙ্গলটার ভেতর ঢুকলাম। ধীরে ধীরে একটার পর একটা ঝোঁপ দেখে খুব সাবধানে এগোচ্ছিলাম। একসময় হঠাৎ মনে হলো একটু দূরে লম্বা টাম্বউকি ঘাসে একটু নড়াচড়া দেখলাম। যদিও নড়াচড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না তবুও ওদিকে গেলাম। কিন্তু দেখা পেলাম না পশুটার।
দেখতে দেখতে ঝোঁপের জঙ্গলটার শেষ মাথায় পৌঁছে গেলাম। ওই জায়গা থেকে সোজাসুজি একটা পাথরে দেয়াল উঠে গেছে পুরো পঞ্চাশ ফুট। সিংহের পক্ষে এ দেয়াল বেয়ে ওঠা সম্ভব না। তারমানে আমি হয় সিংহটাকে কোথাও মিস করেছি অথবা ওটা পালিয়ে গেছে আমার অজান্তে। আর সিংহ যেহেতু বিপদে না পড়লে বা আঘাত না পেলে আক্রমণ করে না। আর সিংহটা তখন ক্ষুধার্তও ছিল না, তাই ওর তরফ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা করলাম না। আর ততক্ষণে প্রায় একঘণ্টা হয়ে গেছে সিংহগুলোর পিছে পিছে ঘুরছি। বেশ ক্লান্ত। আর একবারে তিনটা সিংহ শিকার করা, শিকারের অভিজ্ঞতা হিসেবে মন্দ নয়। তাই ভাবলাম যে তিনটা মেরেছি সেগুলোর ছাল ছিলে নিয়েই ফিরে যাই। এসব ভাবতে ভাবতেই আমার চোখ ঝট করে ঘুরে গেল একটা পাথরের দিকে, আমার চোখ খুব সেনসিটিভ, কিন্তু সেখানেও কিছু দেখলাম না।
তারপর হঠাৎ দেখি আমার ঠিক অপজিটে একটা পাথরের বোল্ডারের উপর দাঁড়িয়ে আছে বিরাট সুন্দর প্রাণীটা। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, এমনকি রাইফেলটা তোলারও সময় পেলাম না, সিংহ লাফ দিল। সরাসরি আমার দিকে।
সে যে কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। আমার কাছে সিংহের লাফ দেয়া শরীরটাকে মূর্তিমান আজরাইল বলে মনে হলো। ও যখন লাফের সর্বোচ্চ উচ্চতায় তখন আমি ভয়ে গুলি চালিয়ে দিলাম কোনও নিশানা ছাড়াই। আমি এত চমকে গিয়েছিলাম যে নিশানা করার চিন্তা মাথাতেই আসেনি। মনে হলো গুলি গিয়ে বিঁধল মেরুদণ্ডে। শব্দ শুনে মনে হয়েছিল, এই আর কি। এরমধ্যেই আমি প্রকৃতিগতভাবে এক দু’ পা পিছিয়ে গেছি। আর একটা ঝোঁপে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। সিংহ লাফিয়ে পড়ল আমার পায়ের সামনে। পড়েই কামড়ে ধরল উরু। আমি পায়ের হাড়ে ওর দাঁত ঘষা খাওয়ার শব্দ শুনলাম। তারপর হঠাৎ ওর কামড় ঢিলা হলো। আমার দিকে এক পলক তাকিয়েই আকাশের দিকে মুখ করে অসম্ভব জোরে গর্জন করে উঠল। দুনিয়াটা কেঁপে উঠল। সাথেসাথেই আমার শরীরের সব শ্বাস বের করে দিতেই যেন ওর বিশাল মাথাটা পড়ল আমার গায়ে। মারা গেছে বিশাল সুন্দর জানোয়ারটা। বুলেট বুক দিয়ে ঢুকে মেরুদণ্ডে অর্ধেক ঢুকে আটকে ছিল।
ব্যথার জন্যই হয়ত ওই বিরাট শরীর গায়ের ওপর পড়ার পরও অজ্ঞান হলাম না। অনেক কষ্টে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সিংহের শরীরের নিচে আবিষ্কার করলাম। বুঝলাম ওই বিরাট দাঁত আমার পায়ের হাড় শেষ পর্যন্ত ভাঙেনি ঠিকই কিন্তু এভাবে রক্ত বের হতে থাকলে মরতে বেশি সময় লাগবে না।
পরে টমের সাহায্যে সিংহের নিচ থেকে বেরিয়ে রুমাল দিয়ে ক্ষতটা শক্ত করে বেঁধে নিলাম।
আমার সেই একরোখা জেদের কারণে আজ আমি প্রায় খোঁড়া হয়ে গেছি। প্রায় মরতেও বসেছিলাম। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর জীবন বাঁচল ঠিকই কিন্তু প্রতি মার্চে ক্ষতের জায়গাটায় ভীষণ ব্যথা হয়। আর প্রতি তিন বছর পরপর জায়গাটা ফেটে গিয়ে একহাতে একবারে পুরা সিংহ পরিবারকে খুন করার মজা টের পাইয়ে দেয়।
আর যে আইভরির জন্য গিয়েছিলাম সেটা পায় এক জার্মান। আর সেবার সব খরচ বাদ দিয়ে তার লাভ হয়েছিল ৫০০ পাউন্ড। এদিকে আমি একমাস বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি আর ছয়মাসের জন্য সম্পূর্ন পঙ্গু ছিলাম।
তো কাহিনী তো শুনলে। এবার চল, ঘুমিয়ে পড়ি। শুভ রাত্রি।
___________________________________
লেখক পরিচিতি : হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড একজন বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক। ১৮৫৬ সালে জন্ম নেয়া এই লেখক ইতিহাসআশ্রিত এমনসব অঞ্চল নিয়ে লিখেছেন যেগুলো ইংরেজদের কাছেও ছিল অনেকটাই অপরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে—কিং সলোমনস মাইনস, অ্যালান কোয়াটারমেইন, পিপল অভ দ্য মিস্ট ইত্যাদি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৫