লোকটির ওড়াউড়ির ভাবনা নিয়ে ম্যারী রীতিমতো সমালোচনায় মুখর। একসময় সে মন্তব্যের সুরে বলল, ‘এ নিয়ে তুমি সত্যি ভীষণ পেরেশানিতে আছো ।
‘আমার মনে হয় না, আমি বেকায়দায় আছি’—লোকটি বলল।
‘এটা নিছক একধরনের আচ্ছন্নতা’—মহিলা বলল, ‘সব কথাবার্তার মূল বিষয় শুধু ওড়াউড়ি এবং পাখি। আমার মনে হয়, তুমি কোনও কিছুতে মোটেও খুশি নও এবং কোথাও পালাতে চাও। ’
লোকটি বেঞ্চের উপর পিঠে ভর করে চিৎ হয়ে শোয় এবং উপরের দিকে তাকায়। খোলা আকাশে একটা শঙ্খচিল পাখি শরীরের দু’দিকে ডানা মেলে আপনমনে ভেসে বেড়াচ্ছে। কখনও পাখিটি ডিগবাজি খাচ্ছে, আবার কখনও শাঁ করে উপর থেকে নিচে নেমে এসে পুনরায় উপরে উঠে যাচ্ছে।
‘আমার মনে হয়, বিষয়টা ভালোই হবে’—লোকটি বলল, ‘শঙ্খচিলের দিকে তাকিয়ে দেখো। ’
ম্যারী চোখ বন্ধ করে আছে। ‘শঙ্খচিল আমি দেখেছি’—চোখ বন্ধ করেই সে বলল। ‘ওদের পালক সাদা এবং ঠোঁট কমলা রঙের। ’ বলেই সে এক মুহূর্তের জন্য থেমে পুনরায় বলল, ‘এবং কমলা রঙের পা। ’
কয়েক পলকের জন্য তাদের চারপাশ আবারও মৌনতার অদৃশ্য চাদরে ঢাকা পড়ে। একসময় আলতো হাতে মৌনতার সেই অদৃশ্য চাদর সরিয়ে ম্যারী বলল, ‘তুমি যদি উড়তে পারো, তাহলে তোমার অন্য কিছু, যেমন ধরো সাঁতার, করার ইচ্ছে হবে। ’
‘শঙ্খচিল কিন্তু সাঁতারও জানে’—হেঁয়ালীর সুরে লোকটি বলল।
‘পানির নিচে ডুব-সাঁতার নয়। ’
‘তবে ওরা পানির নিচে ডুব দিতে পারে’—সে বলল, ‘কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ’
‘আসলে আমি তাই বলতে চেয়েছি’—ম্যারী বলল, ‘পানিতে ডুব দিয়ে ওরা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না, এমনকি পানির নিচে মাছের মতো সাঁতরাতেও পারে না। ’
‘না’—লোকটি সায় দিয়ে বলল, ‘তা সত্যি । ওরা মাছের মতো সাঁতরাতে পারে না। ’
‘এ জন্যই কি তোমার মন খারাপ?’
‘না’—লোকটি বলল, ‘আমি উড়তে বেশি আগ্রহী। ’
ম্যারী আঙুলের ডগা দিয়ে বালি নাড়াচাড়া করে। ‘তুমি রেগে গিয়েছ’—মাথা আনত করে সে বলল, ‘আমি জানি, তুমি কখনওই খুশি হবে না। ’
‘উড়তে পারলেই আমি খুশি হব। ’
‘সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। ’
‘অসম্ভবেরও কিছু নেই। ’
‘না’—বলেই ম্যারী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের গরম বাতাস চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে পুনরায় বলল, ‘আমার মনে হয় এটা অসম্ভব না। ’
দুই |
‘তুমি কাঁদছো’—ম্যারী বলল।
‘না, ঠিক কান্না নয়। ’
‘আমি জানি, তুমি কেন কাঁদছো। তুমি বউয়ের জন্য কাঁদছো। ’
‘না, আমার মনে হয় কথাটা সত্যি না। ’
‘আমি নিশ্চিত। কারণটা তাই। ’
‘মোটেও না। ’
‘তাহলে তুমি উড়তে পারো না, কারণটা কি তাই?’
‘না। ’
‘তবে কী কারণ?’
‘কিৎস্যু না’—লোকটি বলল, ‘আমি মোটেও কাঁদছিলাম না। ’
তিন |
ভালোবাসার নীল যমুনায় ডুব-সাঁতার খেলা শেষ হবার পরও ম্যারী অস্থির ছিল। ‘এটা কী?’—সে জিজ্ঞেস করে।
‘কিসের কী?’
‘তুমি জানো। ’
‘না। সত্যি, আমি জানি না। আমার ভালো লাগছে। তোমার কি ভালো লাগছে?’
‘হ্যাঁ, আমার ভালো লাগছে। কিন্তু তোমার? এটা কী?’
‘আমি ভালো। ’
‘তুমি সিলিংয়ের দিকে হাস্যকর দৃষ্টিতে পলকহীন তাকিয়ে আছো। ’
‘আমি পিঠের ওপর ভর করে শুয়ে আছি। আমি সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছি, তার কারণ আমি চিৎ হয়ে আছি। ’
‘ওড়াউড়ি নিয়ে তুমি ভাবছো’—ম্যারী অনুযোগের সুরে বলল।
‘আমি ভাবছি না। ’
‘তুমি ভাবছো। অনায়াসে আমি বলতে পারি, তুমি ভাবছো। কখন তুমি ওড়াউড়ি নিয়ে ভাবো, তা আমি খুব সহজেই বলে দিতে পারি। দয়া করে তুমি যাহোককি থামবে?’
‘ঠিক আছে’—লোকটি বলল।
একটু পরে ম্যারী বলল, ‘তুমি এ নিয়ে ভাবছিলে। কি, ভাবছিলে না? সত্যি কথাটা আমাকে বলো?’
‘না’—সে বলল, ‘আমার মনে হয় না, আমি আদৌ এ নিয়ে ভাবছিলাম। ’
‘যাহোক, ওড়াওড়ি নিয়ে তোমার ভাবনা আমাকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। প্রতীজ্ঞা করো, তুমি কোনদিনই আমাকে আর ভয় দেখাবে না। ’
‘প্রতীজ্ঞা করছি’—হালকা স্বরে লোকটি বলল।
চার |
লোকটির ঘাড়ের ওপর দিয়ে দৃষ্টি মেলে ম্যারী জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কী?’
‘এটা একটা পানির পাম্প’—জবাবে লোকটি বলল।
‘এর পাখা আছে। ’
‘না, ওগুলো পাখা নয়। ওগুলো চাকার ব্লেড, যা উপরে পানি তুলতে সাহায্য করে। এটা একটা পানির পাম্প। ’
‘আমার মনে হয়, এগুলো উপরে ওঠার কাজে লাগে’—ম্যারী বলল। ‘তুমি কিন্তু প্রতীজ্ঞা করেছ, আমার সঙ্গে ভণিতা করবে না। ’
‘এগুলো পানির পাম্পের ব্লেড’—লোকটি জোর গলায় বলল, ‘সত্যি। ’
‘ঠিক আছে’—ম্যারী বলল, ‘যাই হোক না কেন, আমি এসেছি তোমাকে বলার জন্য যে, বাঁধাকপির ভেতর অনেক ছোট ছোট পোকা আছে। ’
পাঁচ |
অনেক দিন কেউ ওড়াউড়ি নিয়ে আর কোনও কথা বলেনি।
এক রাতে তারা ময়লা থালাবাসন ধুয়ে মুছে রাখছিল। সেই সময় ম্যারী প্রসঙ্গটা আবার তোলে, ‘ওড়ার জন্য তুমি যদি সত্যি কিছু বানিয়ে থাকো, তাহলে সরাসরি বলে দিলেই পারো’ ম্যারী বলল, ‘শুধু বলো, তুমি করেছো...’
‘হ্যাঁ’—একসময় লোকটি মিনমিনে গলায় বলল।
‘ঠিক আছে, তুমি যদি তাই বানাও, তাহলে সেটা ক’জন মানুষ বহন করতে পারবে?’
‘আমরা দুজন। ’
‘আমাদের দুজনকে বহন করতে পারবে?’
‘অবশ্যই। ’
মুহূর্তেই ম্যরীর চোখেমুখে একধরনের উজ্জ্বল রোশনাই ছড়িয়ে পড়ে। আচমকা সে দু’হাত বাড়িয়ে লোকটিকে জড়িয়ে ধরে এবং আলতো চুমু খায়। তার হাতের সাবানের ফেনা লোকটির চুলে ছড়িয়ে পড়ে। পরমুহূর্তে ম্যারীর সম্বিত ফিরে আসে এবং তার কপালে চিন্তার সূক্ষ ভাঁজ দেখা যায়।
‘ইতোমধ্যে তুমি যদি বানিয়ে থাকো’—ম্যারী বলল, ‘তাহলে ওখানে কি আমার কুকুরের জন্য একটু জায়গা হবে?’
‘হ্যাঁ’—লোকটি বলল, ‘সেটা করা যাবে। এ বিষয়ে আমি ভেবে দেখিনি। তবে আশাকরি ওটা করা যাবে। ’
‘অসুবিধা হবে?’
‘না, কোনও অসুবিধা হবে না। ’
‘উৎকৃষ্ট প্রস্তাব। তাহলে খুবই ভালো হয়’—স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ম্যারী বলল।
ছয় |
‘বেশ তো’—লোকটি বলল, ‘তাহলে কোথায় যেতে চাও?’
ম্যারী মাথায় হেলমেটের ফিতা বাঁধে এবং কুকুরকে সঙ্গে নেয়। ‘আমি জানি না’—সে বলল, ‘তুমি কোথায় যেতে চাও?’
‘তুমি যেখানে যাবে, সেখানেই যাব’—হেঁয়ালীর সুরে লোকটি বলল।
‘তাহলে’—ম্যারী বললো, ‘আমি মনে কিছু করব না যদি...’ কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে সে হঠাৎ থেমে যায়। তারপর কী ভেবে যেন পুনরায় সে সংকুচিত গলায় বলল, ‘আমি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছিলাম । যাহোক, তুমি কোথায় যেতে চাও?’
‘তুমি যেখানে যেতে চাও। ’
‘ঠিক আছে’—ম্যারী বলল, ‘ফ্লোরেন্সে যাওয়ার জন্য আমি সব সময় আগ্রহী। ’
‘তাই হবে’—লোকটি বলল।
বলেই সে মাথা তুলে খোলা আকাশের দিকে তাকায়। তার মনে হলো, ওড়ার জন্য আজ রাতটা সত্যি অপূর্ব, মনোমুগ্ধকর।
___________________________________
পিটার ক্যারি: অস্ট্রেলিয়ার স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্প লেখক। ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের ব্যাকাস মার্শ শহরে ১৯৪৩ সালের ৭ মে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সালে ‘অস্কার এন্ড লুসিন্ডা’ এবং ২০০১ সালে ‘ট্রু হিস্টরি অফ দ্য কেলি গ্যাং’ উপন্যাসের জন্য দুবার ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার পান। এছাড়া ১৯৮৫ সালে ‘ইলিওয়েকার’ এবং ২০১০ সালে ‘প্যারোট এন্ড অলিভিয়্যার ইন আমেরিকা’ উপন্যাসের জন্য ‘ম্যানবুকার’ পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় তার নাম উঠে আসে। ২০০৬ সালে ‘থেপ্ট: এ লাভ স্টোরি’, ২০০৮ সালে ‘বেস্ট অফ দ্য বুকার প্রাইজ’ এবং ২০০৭ ও ২০০৯ সালে ‘ম্যানবুকার ইন্টারন্যাশনাল’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।
‘ব্লিস’ (১৯৮১), ‘অস্কার এন্ড লুসিন্ডা’ (১৯৮৯) এবং ‘জ্যাক ম্যাগস্’ (১৯৯৮) উপন্যাসের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সম্মানিত সাহিত্য পুরস্কার ‘মাইলস্ ফ্রাঙ্কলিন অ্যাওয়ার্ড’ লাভ। এছাড়া ‘জ্যাক ম্যাগস্’ এবং ‘ট্রু হিস্টরি অফ দ্য কেলি গ্যাং’ উপন্যাসের জন্য ‘কমনওয়েলথ্ রাইটার্স’ পুরস্কার পান। মোট তেরটি উপন্যাস তার। এছাড়া চারটি ছোটগল্প সংকলন এবং অগ্রন্থিত অসংখ্য ছোটগল্প রয়েছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের হান্টার কলেজের ‘মাস্টার অফ ফাইন আর্টস্ ইন ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ প্রোগ্রামের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত।
‘সুখী হৃদয়ের গল্প’টি পিটার ক্যারির ‘হ্যাপি স্টোরি’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি লেখকের ‘কালেক্টেড স্টোরিজ’ সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৫