ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ২৩)

ধারাবাহিক রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৫
ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা | আদনান সৈয়দ (পর্ব ২৩)

পর্ব ২২ পড়তে ক্লিক করুন

সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু |

বিলাতি নারীর কপালে সুখ বুঝি আর সয় না। এক রত্তি ভালোবাসা আর স্বচ্ছলতার আশায় জীবন বিপন্ন করে ভারত এলেও সত্যিকারের সুখের ছোঁয়া পাওয়া যেন এক ভাগ্যের ব্যাপার।

এদের কেউ কেউ অর্থনৈতিক কষ্টে গোটা জীবন পার করে দিয়েছেন, কেউ আবার স্বামী সন্তান নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ঝামেলায় ছিলেন। বিশেষ করে ভারতে অবস্থানরত অজানা অচেনা কোনো সামরিক কর্মকর্তা বা ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে অনেক সময়ই বিলাতি নারীদের ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। স্বামী ভারতের দুর্গম এলাকায় চাকরি করায় অনেক বিলাতি নারীকে সেই কঠিনতম জীবনও মেনে নিতে হয়েছিল।

১৮৪৫ সালে মার্গারেট স্মিথ যখন ভারতে এলেন তখন তার মাত্র ঊনিশ বছর বয়স। স্বামী আসামের চা বাগানের এক বড় কর্মকর্তা। মার্গারেটের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। আসামের ছোট একটা বাংলোতে যখন তিনি তার সুখের সংসার পাততে যাবেন ঠিকই তখনই আবিষ্কার করলেন তার স্বামীর চরিত্র বিশেষ সুবিধার নয়। ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলেন চা বাগানের অনেক নারীর সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ফলে তিনি ভারতে খুব একা এবং নির্মোহ জীবন যাপন শুরু করেন। চা বাগানের কারো সাথেই তেমন মিশতেন না।



অবশ্য সব বিলাতি মেমদের কপালই খারাপ ছিল তা বলা যায় না। রসামুন্ড লরেন্স বিলেত থেকে বোম্বেতে আসায় তার স্বামী যে জাঁকজমক অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, তৎকালীন বিলাতি সমাজে তা রীতিমত ঈর্ষণীয় ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চলুন রসামুন্ড লরেন্সের মুখ থেকে গল্পটা শুনি: “বোম্বের রেলস্টেশনে পা ফেলার সাথে সাথেই অগনিত মানুষের দেখা পেলাম যারা সবাই আমাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দিতে এসেছে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। কালো, সাদা, গোলাপিসহ বিভিন্ন বর্ণের পাগড়ি পরিহিত ভারতীয় কর্মকর্তা। ধূলা-বালি-গরম আর সবকিছুকে উপেক্ষা করে হেনরির উপস্থিতি আর সেইসাথে রয়েছে অগনিত হাসিমুখো ‘কুলি’ দল। আমি তাদের সবার সাথে করমর্দন করে স্বামীর সাথে ঘোড়ার গাড়িতে উঠলাম



এক রোজনামচায় মার্গারেট লিখছেন, “চারদিকে নিস্তব্ধ শূন্যতা। আমি এই ছোট্ট ঘরে খুব একা। কানের কাছে মাছির ভন ভন আর রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির শব্দ ছাড়া আমি আর কিছুই শুনি না। মাঝে মাঝে রাস্তা থেকে কিছু হিন্দুস্তানি শব্দ কানে আসে, কিন্তু আমি কিছুই বুঝি না। আমি নিশ্চুপ হয়ে শুধু বসে থাকি। মাঝে মাঝে বারন্দায় এসে দাঁড়াই। বারান্দা থেকে দূরের পাহাড়ের দিকে চোখ আটকে থাকে। হায়! এ কোন আনন্দের জীবন আমার!”

জুলিয়া কার্টিসের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে? ভালোবেসে তিনি প্রতারিত হয়েছিলেন। মনে মনে প্রতীজ্ঞা করেছিলেন, ভালোবাসা আর নয়। পরবর্তীতে দেখে শুনে মাঝ বয়সে তিনি একজন ইংরেজ সেনা কর্মকর্তাকে বিয়ে করেন। কিন্তু ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয়। জীবনের সেই দ্বিতীয় পুরুষটিও তার সাথে প্রতারণা করেছিল। দুঃখের সাথে তিনি লিখলেন, “হায় ঈশ্বর! এ কোন ধরনের পুরুষ তুমি সৃষ্টি করেছো!” ১৮৮১ সালে প্রকাশিত ‘দি পাইয়োনিয়ার’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনের দিকে চোখ রাখা যাক। পত্রিকাটি লিখছে, “ভারতে অবস্থিত বিলাতি নারীরা সেখানকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে, সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে আছে, ফুল হাতে হাসি মুখে হাসপাতালে রোগী দেখতে যাচ্ছে এবং বিলাতি সমাজকে বিভিন্নভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও তাদের জীবনের অনেক কথা না বলাই থেকে যাচ্ছে। ”

এদিকে বিলাতি মেম ইথেল সেভিরও মন ভালো নেই। তার সব আশা, স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে ভারতে এসেছিলেন ইথেল। দেখে শুনে বিয়ে করেছিলেন এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে। কিন্তু হায়! কিছুদিন পরই ইথেল তার স্বামীর সব দুষ্কর্ম আবিষ্কার করেন। তার স্বামী শুধু মদ্যপ, চরিত্রহীনই ছিল না, তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতনও করত। শেষ পর্যন্ত ইথেল বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্যে আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালত ইথেলকে দু’জন ইউরোপিয়ান সাক্ষী জোগাড় করতে পরামর্শ দেয়। শেষ পর্যন্ত ইথেল স্বামীকে ছেড়ে অন্যত্র বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়। বিবাহ-বিচ্ছেদের পর ইথেল তার সুযোগ্য আরেকজন সঙ্গী খুঁজে পায় এবং বিয়ে করে বাকি জীবন সুখেই কাটায়।

একথা আগেই উল্লেখ করেছি যে, ভারতে অবস্থানরত বিলাতি সমাজ তাদের ছেলে-মেয়েদের বিলাতি কায়দায় শিক্ষিত করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করত। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সামর্থ্যবান বিলাতি পরিবার তাদের ছেলেমেয়ে এবং সেইসাথে স্ত্রীদেরও বিলেতে উন্নত শিক্ষার জন্যে পাঠিয়ে দিত। সমস্যার শুরু হতো সেখান থেকেও। বিশেষ করে স্ত্রী সন্তান বিলেতে পাঠিয়ে ভারতে ‘ব্যাচেলর’ জীবন শুরু করার পর। দীর্ঘ এই বিচ্ছেদের কারণে অনেক সময় তাদের অন্য নারীর প্রতি ঝুঁকে পড়তেও দেখা যেত। বৈকালিক ক্লাবের আড্ডায়, খেলাধূলাসহ বিভিন্ন রকম সামাজিক অনুষ্ঠানে অনেক বিলাতি স্বামীরাই পরকীয়ায় আসক্ত হবার মতো সুযোগ পেয়ে যেতেন। ‘দি পাইয়োনিয়ার’ পত্রিকা ভারতে অবস্থানরত বিলাতি স্বামীদের সম্পর্কে বলছে, “ভারতে অবস্থানরত ইংরেজ পুরুষের জীবন মানেই তারা তাদের স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য কঠিন পরিশ্রম করে জীবন উৎসর্গ করবে। ”

কিন্তু বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদের কারণে অনেক সংসারই তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ত। মিনির কথাই ধরুন না। দীর্ঘদিন বিলেতে থেকে তিনি যখন ভারতে এলেন, আবিষ্কার করলেন ভারতে রেখে যাওয়া চা বাগানের কমকর্তা স্বামীটি ঠিক আগের মতো নেই। শুধু তাই নয়, তিনি তার স্বামীর ব্যক্তিগত হিসাব রক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠি পড়ে জানতে পারলেন—তার স্বামী বিয়ের আগেই মোটা অঙ্কের দেনায় আক্রান্ত। মিনির ভাষায়, “আমি মনের দুঃখে চুপচাপ শুধু গোপন কান্নাকাটি করেছি। তার কাছ থেকে এটা আমি কখনোই আশা করিনি। ” মিনির সাথে শেষ পর্যন্ত তার স্বামীর বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পরবর্তীতে দু’জনেই আবার বিয়ে করেন এবং সুখে জীবন যাপন করেন।

বিলাতি মেম মেকেনজির অবস্থা ছিল আরো শোচনীয়। সন্তানদের বিলেত পাঠিয়ে তিনি নিজেও স্বামীকে ভারতে রেখে বিলেত চলে গেলেন। পরিকল্পনা ছিল বছর খানেক পর ভারতে এসে আবার স্বামীর সাথে সুখের সংসার পাতবেন। কিন্তু হলো না। ভারতে এসে তিনি আবিষ্কার করেন তার স্বামী অন্য নারীর প্রতি আসক্ত। মেকেনজি তার চোখের জল ফেলে ভারত ত্যাগ করলেন।

অবশ্য সব বিলাতি মেমদের কপালই খারাপ ছিল তা বলা যায় না। রসামুন্ড লরেন্স বিলেত থেকে বোম্বেতে আসায় তার স্বামী যে জাঁকজমক অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, তৎকালীন বিলাতি সমাজে তা রীতিমত ঈর্ষণীয় ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চলুন রসামুন্ড লরেন্সের মুখ থেকে গল্পটা শুনি: “বোম্বের রেলস্টেশনে পা ফেলার সাথে সাথেই অগনিত মানুষের দেখা পেলাম যারা সবাই আমাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দিতে এসেছে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। কালো, সাদা, গোলাপিসহ বিভিন্ন বর্ণের পাগড়ি পরিহিত ভারতীয় কর্মকর্তা। ধূলা-বালি-গরম আর সবকিছুকে উপেক্ষা করে হেনরির উপস্থিতি আর সেইসাথে রয়েছে অগনিত হাসিমুখো ‘কুলি’ দল। আমি তাদের সবার সাথে করমর্দন করে স্বামীর সাথে ঘোড়ার গাড়িতে উঠলাম। ”

ইথেল সেবির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই?  কলকাতায় বড় হওয়া একজন বিলাতি মেম। ভারতের আলো হাওয়ায় তিনি বড় হয়েছেন। কলকাতায় তার ছেলেবেলার পুরোটা সময় কেটেছে। স্বাভাবিকভাবেই ভারত তার নিজের দেশের মতোই। নিজের বিয়ে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “বাংলোতে আমাকে রীতিমতো লাল গালিচায় অভ্যর্থনা জানানো হলো। একেবারেই ছোট একটা পুকুরের সাথে লাগোয়া ছোট্ট বাংলোটিতে প্রবেশ করতে যেয়ে আমার পায়ে কাদা লেগে একাকার হয়ে গেল। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা! কিন্তু চারপাশে সাধারণ মানুষের উষ্ণতা খুঁজে পেলাম। বাড়ির সামনে আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কে যেন কাঁচা হাতে ভুল বানানে লিখে রাখল ‘welcum!’

মিসেস এনি লি’র স্বামী কর্পোরাল লি লাহোরের এসিস্টেন্ট ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার। বিয়ের পর তিনি যখন লাহরের বিশাল বাংলোতে ওঠেন, নিজেকে তখন তার ‘রাজরাণী’র মতোই মনে হয়েছিল। চলুন এনির কথা তার মুখ থেকেই শুনি: “বিশাল একটা বাংলো। বিয়ের পর স্বামীর সাথে বসবাস করতে এসে দেখি সেখানে আমার জন্য এক উষ্ণ অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ দেখি আমার স্বামী একটি রুপোর ক্রেস্ট নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ক্রেস্টটিতে স্বামীর কর্মক্ষেত্রের অনেক সহকর্মীদের নামও বেশ সুন্দর করে খোঁদাই করে লেখা রয়েছে। তারা তাদের ভালোবাসা এবং অভিনন্দন বার্তা আমাকে জানিয়েছেন। সত্যি জীবনটা কতই না সুন্দর!”

১৮৮২ সালে ‘দি পায়োনিয়ার’ পত্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন ছাপা হলো। “ভারতে বিলাতি সমাজ এখন কোনো অংশেই মূল ভুখণ্ড বিলেত থেকে পিছিয়ে নেই। বিলাতিরা ভারতে বসবাস করতে এসে এখানকার অনেক কিছুই রপ্ত করে নিয়েছে। যদিও মাঝে মাঝে অনেক বিলাতি নারী বিভিন্ন রকমভাবে পুরুষদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছেন, তারপরও তারা এখানে বেশ সুখেই আছেন। ”

তবে শুধু বিলাতি পুরুষদের দায়ী করলেই চলবে না। অনেক বিলাতি নারীও নিজেদের নিঃস্ব জীবনের জন্যে দায়ী ছিলেন। ফ্রাংক রিচার্ড যিনি একজন সাধারণ বিলাতি সেনা কর্মকর্তার পদ নিয়ে ভারতে এসেছিলেন—তিনি এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। তার মতে, “স্ত্রী যদি খুব সুন্দরী আর কম বয়সী হয় তাহলে তাকে বাড়িতে একা রেখে চাকরির উদ্দেশ্যে বের হওয়া বিলাতি পুরুষদের জন্যে ‘হাই রিস্ক’ আর চরম বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। ”



বাংলাদেশ সময়: ১১৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৫

পর্ব ২৪ পড়তে ক্লিক করুন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।