ব্রাসেলস্ বিমানবন্দরের দেয়াল জোড়া আয়নায় ঝলমলিয়ে উঠছে ভোরের কুয়াশামাখা রোদ। একটু আগে আমি কাস্টমস্ ইত্যাদি সেরেছি।
ইবোলাক্রান্ত দেশে আমি মাস সাতেক কাজ করে বিভ্রান্ত। আমার প্রয়োজন রোগ সংক্রমণজনিত বাস্তবতা থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে চলে যাওয়া। তাই অনলাইনে ইউ-রেলের টিকিট কেটে ইউরোপ এসেছি। উদ্দেশ্য ট্রেনে চড়ে ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনে মাস দেড়েক ঘুরে বেড়ানো। বেলজিয়াম নিয়ে আমার আগ্রহ তেমন নেই। তাই ভাবছি ব্রাসেলস্ স্কিপ করে সরাসরি চলে যাব প্যারিসে।
আমার সাইক্রিয়াটিস্ট বলেছেন—ত্রাণ কাজে দিন-কে-দিন মৃত্যু প্রত্যক্ষ করার ফলে আমার মানসলোকে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র স্ট্রেস। চিকিৎসার আপাতত কোনো প্রয়োজন নেই তবে তার পরামর্শ—অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও যেন আমি পরিস্থিতির পরিবর্তন করি। তিনি ভ্রমণের জোর রেকমেন্ডনেশন করেছেন। ক্যাথিড্র্যাল থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে একটা বিষয়ে খুব গ্লানিবোধ করি। বিদেশি দাতা সংস্থায় কাজ করে আমার পকেটে রেস্ত আছে বলে আমি সিয়েরা লিওন থেকে সাময়িকভাবে এসকেপ করতে পেরেছি। কিন্তু সিয়েরা লিওনের মানুষজনের সে আর্থিক সঙ্গতি নেই, তাদের তো প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হচ্ছে আসন্ন মৃত্যুর। আমার এ পলায়ন কি তাদের সামান্য সেবাদানের অঙ্গীকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয়?
এয়ারপোর্টের ম্যাপ দেখে ট্রেনে চড়ার ইনফরমেশন কাউন্টারে চলে আসতে কোনো অসুবিধা হয় না। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা মারকুটে ভদ্রলোক আমাকে টিকিট রিজারভেশনের কাগজপত্র দেখাতে বলেন। আমি কনফারমেশন নম্বর দেখাই। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে যে পেমেন্ট করেছি তার রশিদের প্রিন্টআউট বের করি। তাতে কাজ হয় না। তার বক্তব্য আমাকে কাগুজে টিকিট দেখাতে হবে। এতে সমস্যা বাঁধে। ইবোলা সংক্রমণের কারণে সিয়েরা লিওন বিশ্বপরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে মাস কয়েক হলো। আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলো প্রসপন্ড করেছে তাদের তাবৎ ফ্লাইটস্। আমদানি-রফতানি স্থগিত হয়ে পড়েছে। ডাক যোগাযোগ বলা চলে বিচ্ছিন্ন। তাই আমি কাগুজে টিকিট সংগ্রহ করতে পারিনি। ব্রাসেলসে বাস করছেন আমার বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি লুকাস জানসেন। আমি তার এড্রেস ব্যবহার করেছি। ইউ-রেল তার ঠিকানায় ডাকযোগে টিকিট পাঠিয়েছে। দেন দরবার করি-কানফারমেশন নম্বর আছে যখন কাগুজে টিকিটের দরকার ই-বা কী? এ আরগুমেন্টে ফায়দা কিছু হয় না।
লুকাস জানসেনকে ব্ল্যাকবেরিতে বার্তা পাঠাই। জবাবের অপেক্ষায় এয়ারপোর্টের লবিতে বসে বসে তার কথা ভাবি। সিয়েরা লিওনে ইবোলা ছড়ানোর পয়লা দিকে লুকাস মাস খানেকের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে রাজধানী শহর ফ্রিটাউনে আসে। পেশায় ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট লুকাস হোটেলে থাকার জায়গা পাচ্ছিল না। আমি তাকে একটি এপার্টমেন্ট জোগাড় করে দিয়েছিলাম। ইবোলা কেবলমাত্র ছড়াচ্ছে নানাদিকে। পাশ্চাত্য থেকে আসা সাহায্যকারী সংস্থার মানুষজন স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে গ্রামেগঞ্জে প্রচার ক্যাম্পেন করছেন—সব সময় ক্লোরিন মিশ্রিত জল দিয়ে হাত ধোয়ার, রোগের আলামত দেখা দিলে রোগীর কাছ থেকে শতহস্ত দূরে থাকা, আর মৃতদেহ স্পর্শ করে সৎকার করা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলছেন। এসব প্রচারে সৃষ্টি হয় তীব্র ভুল বোঝাবুঝির। গ্রামের কিছু মানুষজন বিভ্রান্ত হয়ে আক্রমণ করে এইড ওয়ার্কারদের। বিশেষ করে লাশের গোছল দেয়া ও জানাজা করতে গিয়ে যে রোগের বীজাণু ছড়াচ্ছে এ সব প্রচারকে ধর্মবিরোধী আচরণ বিবেচনা করে কোনো কোনো জায়গায় বিদেশি সংস্থার ভলান্টিয়ার ও স্থানীয় হেলথ ওয়ার্কারদের হত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটে। লুকাস জানসেন ফ্রিটাউনে এসেছিল এসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে। মাস চারেক আগে আমি কাবালা বলে সিয়েরা লিওনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে গেছি। জানতাম লুকাস জানসেনও এদিকে এসেছে তথ্য সংগ্রহে। হঠাৎ করে তার টেক্সট্ ম্যাসেজ পাই। গ্রামের দিকের একটি মেঠোপথে তার গাড়ি বিকল হয়েছে। সড়কের ডিরেকশন জেনে নিয়ে ঘণ্টাখানেক ড্রাইভ করে ওখানে পৌঁছাই। যা আন্দাজ করেছিলাম বিষয় তারচেয়েও গুরুতর। একজন স্থানীয় অনুবাদক কাম ড্রাইভার ও ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে লুকাস গ্রামে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিল। কিছু মানুষজন খেপে গিয়ে তার অনুবাদককে বেদড়কভাবে পেটায়। গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখে তার প্রতিটি চাকা পাংচার করে দেয়া হয়েছে। তো বাতাসহীন চাকায় ড্রাইভ করতে গেলে বাচ্চা ছেলেরা ঢিল ছুড়ে ভেঙে দেয় উইন্ডশিল্ডের কাচ। আধলা একখানা ইট এসে লাগে লুকাস সাহেবের কপালের চন্নায়।
চোখে ভেসে ওঠে লুকাস জানসেনের কপাল থেকে গড়িয়ে নামা রক্তে তার বালুরঙের দাড়ি ভিজে যাওয়ার দৃশ্য। ঠিক তখনই ব্ল্যাকবেরিতে তার বার্তা আসে। আমার নামে পাঠানো ইউ-রেলের কাগুজে টিকিট তার ঠিকানায় পৌঁছেছে।
আমাকে বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে তার সাথে দেখা করলেই সে তা হাতে ধরিয়ে দেবে। আমাকে লুকাস ব্রাসেলস্ শহরের মাতংগি বলে একটি এলাকায় যেতে বলে। ওখানকার কিনসাসা রেস্তোরাঁয় সে অপেক্ষা করবে বেলা দুইটা নাগাদ। পরের ম্যাসেজে লুকাস মাতংগিতে পৌঁছতে কী ধরনের যানবাহন ব্যবহার করে, কোন সড়ক ধরে, কিভাবে এগুতে হবে তার বিস্তারিত ডিরেকশন দেয়।
ধীরেসুস্থে আমি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এসে সড়কে হাঁটাচলা করে সময় কাটাই। তারপর ট্রেনে চেপে চলে আসি শহরের মেইন স্কোয়ারের দিকে। পার্কে ম্যামথ সাইজের একটি ফেরোস হুইল ঘুরছে অতি ধীরে। আমি চাকাওয়ালা ব্যাগ টেনে টেনে চলে আসি ব্রাসেলসের নামজাদা একটি ক্যাথিড্রালের সামনে। প্রায় চারশো বছর আগে নির্মিত আসাধারণ এ ধর্মীয় স্থাপনার আশপাশে কিছু গাছবিরিকের পাতা অটামের ঈষদুষ্ণ হাওয়ায় ক্রমশ সোনালি হচ্ছে। বেলা তেমন একটা হয়নি, তাই ক্যাথিড্রালের সিঁড়িতে পর্যটক সমাবেশ নেই বললেই চলে। আমি বিশাল দরোওয়াজা দিয়ে ঢুকে পড়ি তার ভেতরবাগে। দুপাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা শতাধিক স্তম্ভের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলে আসি বেদির উঁচু পাটাতনের কাছে। ওখানে সমস্ত দেয়াল জুড়ে লাগানো বর্ণাঢ্য কাচের বিশাল জানালা। তার হরেক রঙের নকশায় জ্যামিতিক রেখাচিত্রগুলো চুঁয়ে আসছে তাজা সূর্যালোক। স্বয়ংক্রিয় অর্গানে বাজা কোনো সিম্ফনির সুরধ্বনি ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশাল এ অট্টালিকার থমথমে নিরিবিলি পরিবেশে। দু’চার জন পূজারি গোছের পর্যটক জ্বালিয়ে দিচ্ছে শ্বেতপাথরের চেরাগদানে মোম। জানালার কাচ-রঙিন রেখায় আলোর প্রতিসরণের দিকে তাকিয়ে আমি চুপচাপ বসে থাকি কিছুক্ষণ।
ইবোলাক্রান্ত একটি দেশে বসবাসের ফলে চেতনায় জমেছিল যে বিবর্ণতা—তা মুছে গিয়ে মনে আবার পড়তে শুরু করে রঙের নানা শেডের প্রলেপ। খুব নিঃসঙ্গ হালতে আমি ভাবি—আই রিয়েলি নিড অ্যা ব্রেক। খুব প্রত্যাশা নিয়ে ইউরোপে সপ্তাহ কয়েক ঘুরে বেড়ানোর সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখি। সিয়েরা লিওনের পরিস্থিতি থেকে আমি এসকেপ করেছি পরিকল্পিতভাবে। এ পলায়ন অনেকটা যুদ্ধক্ষেত্রে স্ট্যাটেজিকভাবে পিছিয়ে আসার মতো। ইউরোপে আমি রিট্রিট করছি যাতে মানসিকভাবে রিএনফোর্সমেন্ট নিয়ে একটু চাঙ্গা হালতে ফিরে যেতে পারি সিয়েরা লিওনে। আমার সাইক্রিয়াটিস্ট বলেছেন—ত্রাণ কাজে দিন-কে-দিন মৃত্যু প্রত্যক্ষ করার ফলে আমার মানসলোকে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র স্ট্রেস। চিকিৎসার আপাতত কোনো প্রয়োজন নেই তবে তার পরামর্শ—অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও যেন আমি পরিস্থিতির পরিবর্তন করি। তিনি ভ্রমণের জোর রেকমেন্ডনেশন করেছেন। ক্যাথিড্র্যাল থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে একটা বিষয়ে খুব গ্লানিবোধ করি। বিদেশি দাতা সংস্থায় কাজ করে আমার পকেটে রেস্ত আছে বলে আমি সিয়েরা লিওন থেকে সাময়িকভাবে এসকেপ করতে পেরেছি। কিন্তু সিয়েরা লিওনের মানুষজনের সে আর্থিক সঙ্গতি নেই, তাদের তো প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হচ্ছে আসন্ন মৃত্যুর। আমার এ পলায়ন কি তাদের সামান্য সেবাদানের অঙ্গীকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয়?
একজন পর্যটক খরগোসের মতো খাড়া কানঅলা টুপি পরে ট্রাইপডের ওপর ক্যামেরা বসাতে বসাতে ক্যাথিড্রালের দিকে ইশারা দিয়ে বলেন, ‘ইজন্ট দিস অ্যা লাভলি স্টোনওয়ার্ক?’ বিশাল এ গির্জার পাথরের কাজ যে আসাধারণ তা স্বীকার করে তার নিষ্ঠার সাথে ছবি তোলার দিকে একটু তাকাই। ভদ্রলোক ডিজিটালে ধারণ করে নিয়ে যাচ্ছেন ক্যাথিড্রালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা জনা কয়েক মানুষের ছায়াচিত্র। আগামীতে এমন কোনো যন্ত্র আবিষ্কৃত হবে কি, যা দিয়ে শুধু মানুষের মুখাবয়ব নয়, বরং তাতে ধরা পড়বে মনের গভীর গোপনে গুঞ্জরিত হওয়া গ্লানি, অপরাধবোধ ও বিশুদ্ধ আনন্দ? আমি তার কাছে ট্রাম স্টপেজের খোঁজ জানতে চাইলে তিনি ট্রাইপড গোছাতে গোছাতে বলেন, ‘আমিও যাচ্ছি ওদিকে, কাম-অন জেন্টোলম্যান, লেটস্ গো টুগেদার। ’
তো আমরা ট্রামের তালাশে অতিক্রম করি আরেকটি ব্লক। পর্যটক বাবাজি কাঁধে ট্রাইপড ফেলে হাঁড়িতে মুখ দিয়ে শব্দ করার মতো গমগমে গলায় গেয়ে ওঠেন, ‘এভরি টাইম দ্যাট ইউ গট আনড্রেসড্ / আই হিয়ার সিম্ফনি ইন মাই হেড। ’ তিনি চুটকি বাজিয়ে ধুয়া ধরলে জানতে কৌতূহল হয়—কে কখন কী কারণে নিরাবরণ হয়েছিল, আর তার করোটিতে বেজেছিল কোন কম্পোজারের কী ধরনের সিম্ফনি? কিন্তু আলাপ জমানোর ঠিক মওকা পাওয়া যায় না। তার ভেতরে যেন ইমোশন তাইরে নাইরে করে বলকাচ্ছে, আর তিনি সুরেতালে দুলতে দুলতে ল্যাম্পপোস্টের সাথে ট্রাইপডের বাড়ি লাগানো থেকে অল্পের জন্য রেহাই পান।
আমরা চলে আসি গুম্ভুজঅলা আরেকটি চার্চের সামনে। দেখতে দেখতে হালকা হলুদ রঙের দুই ডাব্বার একটি ট্রাম এসে দাঁড়ায় রাজপথের মাঝামাঝি। আমরা উঠে পড়তেই ঘণ্টা বাজিয়ে ট্রাম রওয়ানা হয়, আরেকটি সড়ক ধরে তা পথ চলে গ্র্যান্ড প্লেস বলে পরিচিত শহরের মেইন স্কোয়ারের গা ঘেঁষে। একটু সময়ের জন্য থামেও। আমি ট্রামের জানালা দিয়ে চারপাশে ধ্রুপদী কেতার স্থাপত্যে তৈরি মস্ত মস্ত দালানকোটা দিয়ে ঘেরা স্কোয়ারের দিকে তাকাই। দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু পর্যটক অলস ভঙ্গিতে। এ স্কোয়ারের দুনিয়াজোড়া নাম আছে খুব রিলাক্সড্ জায়গা হিসাবে। কিছুদিন আগে ইউনেস্কো গ্র্যান্ড প্লেসকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইটের মর্যাদা দিয়েছে। এখানকার কিছু অট্টালিকার বয়স সাড়ে তিন থেকে চারশো বছরের মতো। এ জায়গায় সৌন্দর্যে একবার মেতেছিলেন ফরাসি কবি বদলেয়ার। শোনা যায় ভিক্টর হুগোও এখানে সন্ধ্যাবেলা ঘুরপাক করতে ভালোবাসতেন। ইচ্ছা হয় আমিও নেমে পড়ি এখানে। কিন্তু ইউ-রেলের কাগুজে টিকিটটি হাতে না আসা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না। ট্রাম বেশ খানিকটা সময় এখানে দাঁড়ায়। মৃদু হুইসেল বাজিয়ে নীল সবুজ ফ্লাশবাতি ঝলকিয়ে স্কোয়ারে এসে দাঁড়ায় কয়েকটি পুলিশের মোটরবাইক। মেগাফোনে ফরাসি ভাষায় কোনো কিছুর ঘোষণা দেয়া হয়। কিছু লোকজন ছুটে এসে ট্রামে ওঠে। বিষয় কী বুঝতে না পেরে আমি সহযাত্রী ট্রাইপডওয়ালা পর্যটকের দিকে তাকাই। তিনি বলেন—মেগাফোনে ঘোষণা দেয়া হয়েছে এখনই স্কোয়ারে ফ্লোরাল কার্পেট তৈরির কাজ শুরু হবে। পুলিশ সকলকে স্কোয়ার খালি করতে বলেছে। ঘণ্টা পাঁচেক পর আবার স্কোয়ার খুলে দেয়া হবে—যাতে আমআদমীরা পর্যবেক্ষণ করতে পারে কার্পেটের রঙদার নকশা। তা ফ্লোরাল কার্পেট বস্তুটি কী—জানতে চাইলে পর্যটক কাঁধ দুলিয়ে দিব্যি ভাঁজতে শুরু করেন সুপার সেক্সি গানের কলিটি। ট্রাম আবার ঘণ্টা বাজিয়ে রওয়ানা হয়। গানের তোড়ে তার টুপিতে লাগানো খরগোশর কান দুটিও যেন সতর্ক হয়ে তালমান বজায় রেখে নড়েচড়ে ওঠে।
ট্রাম চলে আসে ব্রাসেলস্ পার্কের সামনে। সড়ক পেরিয়ে ওপারে বেলজিয়ামের রাজা-রানির আবাসিক আখড়া প্যালেস রয়েল। আমি ট্রামের জানালা দিয়ে অত্যন্ত ইমপোজিংয়ে ইমারতের দিকে তাকিয়ে থাকি। জনা কয়েক যাত্রী নেমে যায় এখানে। ঠিক বুঝতে পারি না প্যালেসে পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ আছে কিনা। আমি যে বিপুল আকারের রাজকীয় অট্টালিকার দিকে তাকিয়ে আছি তার বয়স কিন্তু খুব বেশি না। ১৯০০ সালে আঠারো শতকের একটি প্রাসাদের ক্ষয়িষ্ণু দরদালান ভেঙেচুরে নতুন করে প্যালেস রয়েল নির্মাণ করান রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড। তিনি আফ্রিকার কঙ্গোতে গড়ে তুলেছিলেন তার ব্যক্তিগত উপনিবেশ। কলোনি গড়তে গিয়ে কঙ্গোলিজ কালো মানুষদের সাথে তিনি যে ধরনের নির্মম ব্যবহার করেছিলেন তার তুলনা পাওয়া কঠিন। আন্দাজ করি—এ প্রাসাদটি তৈরি হয়েছে কঙ্গো থেকে আহরিত সম্পদ দিয়ে। এর নির্মাণ কাজে কোন কঙ্গোলিজ ক্রিতদাসকে ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা—এ বাবদে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে আগ্রহ হয়।
প্রাসাদের চত্বর ছাড়িয়ে ট্রাম এখন চলে এসেছে শহরের বেশ ভেতরে। কাবোল স্টোনে মোড়া গলিপথে ঘণ্টা বাজিয়ে গাড়িটি খুব ধীরে আগ বাড়লে আমি ফুটপাতের রোয়াকে বসে থাকা দাড়িওয়ালা একজন গৃহহীন মানুষকে দেখে চমকে উঠি। তার পায়ের কাছে বসে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে একটি পোষা কুকুর। ঠিক এমনিভাবে বৃদ্ধ বকর মানসারাই বসে থাকতেন—সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে আমি যে পাড়ায় বাস করি তার কাছাকাছি ফুটপাতে, একটি বিশাল কটন ট্রি’র তলায় পেতে রাখা কাঠের বেঞ্চে। আমি ড্রাইভ করে আফিসে যাওয়ার পথে দেখতাম তার পোষা কুকুরটি কখনো-বা দাঁড়িয়ে অকারণে তার দিকে চেয়ে চেয়ে লেজ নাড়ছে। এ মুহূর্তে আমি ইউরোপে ঘুরে বেড়ানোর মুডে নিমজ্জিত হতে চাচ্ছি। সিয়েরা লিওনের কারো কথা ভাবতে চাই না একেবারে। কিন্তু ট্রাম অন্য একটি ব্লকে এসে পড়তেই দেখি—কাবোল স্টোনের চাতালে দাঁড়িয়ে পাথরে তৈরি কুকুরের একটি ভাস্কর্য। বকর মানসারাইয়ের মৃত্যুর পর তার উজাড় হয়ে যাওয়া কুটিরের আঙিনায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকত তার পোষা কুকুরটি।
ফ্রিটাউনের হিল স্টেশন বলে যে আবাসিক এলাকায় আমি বাস করছি, ওখানে ঔপনিবেশিক যুগের ইংরেজ সাহেবদের বাগানে মালির কাজ করতেন বকর মানসারাই। বয়সের নিরিখে তিনি রীতিমতো বয়োবৃদ্ধ। দু’হাত বাতে পঙ্গু বলে বাগানের কাজ করতে পারেন না। তিনি আমার কাছে এসেছিলেন তার পুত্র আলীর জন্য চাকুরির উমেদারি করতে। পেছন পেছন লেজ নেড়ে নেড়ে এসেছিল তার পোষা কুকুরটি। আমাদের বাগানের জন্য মালি অলরেডি রাখা হয়ে গেছে, কিন্তু মাথায় টাসেল ঝোলানো টুপি পরা ফোকলামুখো বকর মানসারাইকে খাজুল করতে কষ্ট হচ্ছিল। কথা হয় যে—সামান্য মাইনার বিনিময়ে তার পুত্র আলী লন্ড্রি থেকে নিয়ে আসবে আমার ধোয়া কাপড়চোপড়। আর প্রতিদিন বুকস্টোর থেকে স্থানীয় পত্রিকা কিনে আনা ও গাড়ি ধোয়া পাকলা করার দায়িত্বও দেয়া হয় তাকে। সপ্তাহখানেক পর অফিস থেকে ফিরে এসে গেটের দরোয়ানদের কাছে শুনি যে—আলী মানসারাই ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছে। গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখি—বিমর্ষ সুরে সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স যাচ্ছে তাদের বস্তির দিকে। দুই দিন পর আলীর মৃত্যু সংবাদ পাই। বিপত্নীক বকর মানসারাইয়ের খোঁজ নেয়ার জন্য তার কুটিরের দিকে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। ইবোলা সংক্রমণের কারণে তাদের পাড়াকে করিনটিন ঘোষণা দিয়ে পুলিশ ওদিকে সকলের যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে।
আমার কটেজের ঝুলন্ত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আমি মানসারাইদের বস্তির দিকে তাকাই। বকর মানসারাই এর সাথে এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। বৃদ্ধ আমার বাগানের জন্য নিয়ে এসেছিলেন এরোমেটিক জুঁই ফুলের চারা। কথা দিয়েছিলেন কামিনির কলমও জোগাড় করে দেবেন। দিন চারেক পর অফিস থেকে ফিরে দারোয়ানদের কাছে শুনতে পাই ইবোলায় আক্রান্ত বকর মানসারাই কিভাবে যেন পাহারারত পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে, করিনটিন করা তার কুটির থেকে বেরিয়ে এসে, লাঠি ভর দিয়ে দিয়ে আমার খোঁজে চলে এসেছিলেন আমাদের রেসিডেনসিয়াল কমপাউন্ডের গেট অব্দি। দারোয়ানরা তাকে গেটের কাছে আসতে দেয়নি। আমি সিকিউরিটির সিসি টিভিতে ফুটেজ দেখি। লাঠি ভর দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় তিনি গেটের সামনে সড়কে মুখ থুবড়ে পড়েন। পোষা কুকুরটিও তার সামনে বসে পড়ে। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ফেনা। কিছুক্ষণ পর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আবার গেটের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে কী যেন বলেন। তারপর নীরবে হেঁটে ফিরে যান গলিপথে। আমি দরোয়ানদের দিয়ে খোঁজখবর করাই। জানতে পারি—ফেরার পথে বকর মানসারাই তার বস্তিতে ফিরে না গিয়ে ঢুকে পড়েন পাড়ার মসজিদে। মিম্বরের সামনে তার মৃত্যু হয়। কুকুরটি নাকি মসজিদের গেটে সিঁড়িতে বসে কুঁই কুঁই করে কাঁদছিল।
সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে—এ জন্য ইবোলা প্রতিরোধ টিমের স্বাস্থ্যকর্মীরা তার লাশ সরিয়ে পুরো মসজিদ সিল করে দেয়। বেশ কিছুদিন পর তাদের বস্তি থেকে করিনটিনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে আমি ড্রাইভ করে তার কুটির অব্দি যাই। আমার কাছে তার ছেলের কাজের মাইনা পাওনা আছে। শুনতে পাই—তার পরিবারের সকলের মৃত্যু হওয়ায় কুটিরটি উজাড় হয়ে আছে। ওখানে একাকি বাস করছে পোষা কুকুরটি। আমাকে দেখতে পেয়ে সে লেজ নেড়ে কুঁই কুঁই করে কাঁদে।
ট্রাম সরাসরি মাতংগিতে যাচ্ছে না শুনে আমি সড়কের মোড়ের একটি স্টপেজে নেমে পড়ি। চাকাওয়ালা ডাফোল ব্যাগ টানতে টানতে কিছুতেই মাথা থেকে বকর ও তার ছেলে আলী মানসারাইয়ের স্মৃতি মুছতে পারি না। জুঁই ফুলের চারার জন্য বড় ধরনের বকশিশের ওয়াদা করেছিলাম। তার ছেলের মাইনার টাকা দেয়ারও আর কোনো সুযোগ হবে না। অসুস্থ হালতে বকর মানসারাই গেটে এসে আমার খোঁজ করছিলেন কেন? ইবোলার আলামত দেখা দিলে পুলিশ এসে ঘরবাড়ি করিনটিন করে দেয়। করিনটিন হলে কিন্তু বাড়ি থেকে বেরুনো একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তখন কোনো কোনো রোগী বা তার আত্মীয়স্বজন পুলিশের নজর এগিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে খাবারের সন্ধানে। তবে কি বকর মানসারাই ক্ষুধার্ত ছিলেন? আমার কটেজের ডিপ ফ্রিজ বোঝাই মাছ, মাংস ও চিজ, এবং পেনট্রিতে অঢেল বিন, চাল ও অলিভ ওয়েল; এ সব মজুদের জন্য, আর ইবোলা প্রাদুর্ভাব তীব্র হতেই ফ্লাই করে ব্রাসেলস্ অব্দি এসে পড়ার আর্থিক সঙ্গতির জন্য—আমি তীব্রভাবে গিল্টি ফিল করি।
গলিপথে আরো দুটি ব্লক পেরিয়ে আসতেই বড় ক্লান্ত লাগে। দেখি—একটি বাড়ির লাগোয়া রোয়াকে বসে একজন গৃহহীন মানুষ কবুতরকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে রুটির টুকরা খাওয়াচ্ছেন। আমি তার দিকে তাকাচ্ছি দেখে ফোকলা দাঁতে হেসে বলেন, ‘আর ইউ টায়ার্ড?’ রোয়াকে বসতে গিয়ে তার মুখের অনাবিল হাসি দেখে বড় ঈর্ষা হয়। মনে হয় ক্যারিয়ারের উচ্চাশা না থাকলে, সম্পদের প্রলোভন না থাকলে, কিংবা নানা দেশে ঘুরে বেড়ানোর মোহ কাটাতে পারলে হয়তো তার মতো হাসতে পারতাম। আমি তার দিকে ইউরোর কয়েকটি কয়েন বাড়িয়ে দিলে তিনি তা নিয়ে পকেটে পুরতে পুরতে বলেন, ‘মোট পঁচিশটি কবুতর থাকার কথা, আজকে গুনে দেখলাম ঝাঁকে আছে মাত্র চব্বিশটি, বুঝতে পারছি না একটি পায়রা গেল কোথায়?’ আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে তিনি আবার বলেন, ‘প্রতিদিন এদের আমি রুটির টুকরা খাওয়াই। পায়রাগুলোর সাথে আমার এক ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠছে। এদের একটি যদি সত্যিই খোঁয়া যায় তাহলে তো বড় দুশ্চিন্তার কথা। ’ তার কথা শুনতে শুনতে আমি সিগারেটের প্যাকেট বের করলে তিনি হাত বাড়ান। লাইটার দিয়ে তার সিগ্রেট ধরিয়ে দিলে তিনি ফোকলা দাঁতে মোলায়েম হেসে বলেন থ্যাংক্যু।
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৭ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০১৬
এমজেএফ/টিকে