নিজের দাদিমাকে খুঁজতে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি ঘর ছেড়ে হেঁটেছিলেন পৃথিবীর পথে। বিশ্ব প্রকৃতিকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন নিজের একমাত্র পাঠশালা হিসেবে।
রাশিয়া শহরের নিঞ্জি নভগরদ এলাকা ছেড়েছিলেন তিনি। আর তাতেই তাকে হতে হয়েছিলো তিক্ত। ১৬ বছর বয়সে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর পায়ে হেঁটে রাশিয়া ভ্রমণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। ম্যাক্সিম গোর্কি ছদ্মনামে পরিচিত হলেন একজন পরিপূর্ণ লেখক হিসেবে। ‘গোর্কি’ শব্দের অর্থ তিক্ত। আক্ষরিক অর্থেও ম্যাক্সিম গোর্কির জীবনের স্বাদটাও তেমনই ছিলো। তার লেখনীতে তাই সবসময় ফুটে উঠেছে তিক্ত সত্য। রুশ জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে সঞ্চিত রাগের প্রকাশভঙ্গি প্রখর হয়ে দেখা দিয়েছিলো তার লেখায়। ১৮৯২ সাল নাগাদ গোর্কি ছদ্মনামে লেখা শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হয় গোর্কির প্রথম বই ‘এসেজ অ্যান্ড স্টোরিজ’। বইটি সাড়া জাগিয়েছিলো সারা দেশে।
রাশিয়ার জনজীবনের নিঠুর বাস্তবতাকে নিজ কলমে তুলে ধরেছিলেন বিশ্ববাসীর সামনে। সমাজের তৃণমূল মানুষগুলোর জীবনের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন গোর্কি। রাশিয়ার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বাঁকগুলো নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছিলেন তিনি। অকুতোভয় বীরের মতো জার সাম্রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন তার লেখনীর মধ্য দিয়ে। জারের শাসনামলে বেশ কয়েকবার কারান্তরীণও হয়েছিলেন। শ্রমিকদের সঙ্গে গোর্কির ছিলো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে সোশ্যালিস্ট রিয়ালিস্ট ধারার সাহিত্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই তিনি পরিচিত। প্রথম দিকের গল্পগুলোতে নিটোল রোমান্টিকতা থাকলেও পরবর্তীতে গল্পের বিষবস্ত ও উপস্থাপনা শৈলী ভিন্ন রূপ নিতে থাকে। সমকালীন বাস্তবতা, সমাজের নিচুতলার মানুষই তার গল্পের উপজীব্য বিষয়। মূলত প্রথম দিকে তিনি লিখতেন প্রথাগত নিয়মে। পরবর্তীতে তার পরিচয় হলো এক বিখ্যাত তরুণ লেখক ভ্লাদিমির করোলেঙ্কার সঙ্গে। করোলেঙ্কার কথায় চেতনা ফিরে পেলেন গোর্কি। প্রথাবদ্ধ চেতনার ধারাকে বাদ দিয়ে শুরু হলো তার নতুন পথে যাত্রা। সমাজের নিচুতলার মানুষ- চোর, লম্পট, ভবঘুরে, মাতাল, গণিকা, চাষী, মজুর, জেলে উঠে আসতে থাকে তার রচনায়। এই পর্বের কয়েকটি বিখ্যাত গল্প হলো- মালভা, বুড়ো ইজরেগিল, চেলকাশ, একটি মানুষের জন্ম। গল্পগুলোতে একদিকে যেমন ফুটে ওঠেছে নিচু তলার মানুষের প্রতি গভীর মমতা, অন্যদিকে অসাধারণ বর্ণনা, কল্পনা আর তার সৃজনশক্তি।
বৈচিত্র্যতায় ভরপুর তার জীবন ও সাহিত্যকর্ম। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এক পেশা থেকে আরেক পেশায় ঘুরতে ঘুরতে বড় হয়ে উঠতে থাকেন গোর্কি। সববিছুর মধ্যেও বই পড়ার নেশা বেড়ে চলে। বইয়ের কোনো বাছবিচার ছিলো না। সর্বভূকের মতো যা পেতেন তাই পড়তেন। একদিন হাতে এলো মহান রুশ কবি পুশকিনের একটি কবিতার বই। একনিষ্ঠভাবে পড়লেন। পড়তে পড়তে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন।
গোটাবিশ্ব যখন অস্থির সময় পার করছিলো ঠিক তখন রাশিয়ায় চলছিলো জারের রাজত্বকাল। রাশিয়া জুড়ে চলছিলো শাসনের নামে শোষণ, অত্যাচার। বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েই গোর্কি পরিচিত হলেন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের রচনাবলীর সঙ্গে। অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি, দর্শন… আরও নানা বিষয়ের বই পড়তে আরম্ভ করলেন। দারিদ্র্যতা ছিলো তার নিত্যসঙ্গী। শুরু হয় তার কঠিন জীবন। প্রথমেই একটি সৌখিন জুতার দোকানে কাজ আরম্ভ করেন তিনি। সেখানে সারাদিন শ্রম দিতেন। দারিদ্র্যতার কষাঘাতে পিষ্ঠ হয়ে তিনি নিজেকে মেলে ধরেছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রমী হিসেবে। কিছুদিন পর একটি রুটির দোকানে কাজ পেলেন। সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর অবধি একটানা কাজ করতে হতো। এরই ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন বই পড়তেন। ১৯০৬ সালে দেশে দেখা দিলো দুর্ভিক্ষ। গোর্কিকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা করা হলো। এ খবরে বলশেভিকরা তাকে আইভান নরোদনির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে দলের তহবিল গঠনের জন্য পাঠান। তারা জার্মানি হয়ে ফ্রান্স ও অমেরিকায় যান। সেখানেই লেখেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য মাদার’। জারের ভয়ে এই বই প্রথম প্রকাশিত হয় ইংরেজি অনুবাদে। পৃথিবীজুড়ে এ উপন্যাস ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশ্বখ্যাত এই উপন্যাসটি পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত হয় যা বাংলা ভাষায় ‘মা’ নামে প্রকাশিত হয়। মা উপন্যাস লিখে গোর্কি উঠে আসেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। নাম লেখান অমরত্বের খাতায়। এই উপন্যাসের কারণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কয়েকজন কথাশিল্পীর তালিকা করলে তার নাম প্রথম সারিতেই থাকবে। মা ছাড়াও গোর্কি অসংখ্য জনপ্রিয় গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, কবিতা ও আত্মজীবনী লিখে গেছেন। ‘আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পাঠশালায়, পৃথিবীর পথে’ তার জীবনের আরেক অমর কীর্তি, যা তার বিপ্লবী জীবনগাথার যথাক্রমে প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড।
‘মা’ উপন্যাসের জন্যেই গোর্কি জগদ্বিখ্যাত হবার পথে পা বাড়িয়েছিলেন। যদিও মা-ছেলের সম্পর্কই সেখানে মূল উপজীব্য। একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সৃষ্ট রাশিয়ার রাজনীতির পরিস্থিতি বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সেখানে। যার নিরপেক্ষ প্রশংসা তিনি ন্যায্যভাবেই পেয়েছিলেন। উপন্যাসটি ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছিল জাতির বিবেককে। তুমুলভাবে আলোড়িত করেছিলো বিশ্বসাহিত্যকে। পেলাগেয়া নিলভনা নামে অতিসাধারণ এক ‘মেয়ে মানুষ’ কীভাবে সময়ের প্রয়োজনে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হন একজন রাজনীতিসচেতন ‘ব্যক্তি’তে। কী করে বুঝতে শেখেন, সারাজীবন শ্রেণি শোষণের শিকার হওয়ার বিষয়টি। তার চমৎকার বর্ণনাই গোর্কি করেছেন তার দুর্দান্ত ভাষারীতিতে লেখা এই উপন্যাসটিতে।
তার কালজয়ী উপন্যাস মা সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত আরেক ঔপন্যাসিক লিও তলস্তয় মন্তব্য করেছিলেন, ‘গোর্কিকে আমি ভালোবাসি সমাদৃত লেখক হিসেবেই নয়, তিনি যে লেখক হিসেবে উদার ও সহানুভূতিশীল মানুষ তার জন্যও’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গোর্কির বাড়ি বলশেভিকদের অফিস ঘর হয়ে উঠেছিলো। রুশ বিপ্লবের পর গোর্কি ছিলেন ইতালিতে। ১৯৩২ সালে কমরেড স্ট্যালিনের আহ্বানে গোর্কি রাশিয়ায় ফিরে আসেন। তাকে ‘অর্ডার অব লেনিন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
তার রচনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রখ্যাত লেখক গেয়র্ক লুকাচ বলেন, ‘লেখক হিসেবে গোর্কি সর্বদাই তার সমকালীন ঘটনাবলীর প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন এবং নিজের রচনার মধ্যে এমন ভেদরেখা টেনে দেননি, যাতে কতোটুকু একজন সাহিত্যিকের লেখা আর কতোটুকু এক বিপ্লবী সাংবাদিক ও প্রচারকর্মীর তা ধরা যায়। সত্য এর বিপরীতটাই। তার মহত্তম সাহিত্যকীর্তি সর্বদা সাংবাদিকতাকে আশ্রয় করে উত্থিত হয়েছে’।
তিনি তৃণমূল মানুষের দুঃখগাথা নিয়ে লিখেছেন। মানুষের মনুষ্যত্ববোধের জাগরণে বিবেকের সচেতেনতায় নিজের জীবনকে তিনি ব্যপ্ত করে গেছেন জগতের প্রথাগত নিয়মের বিরুদ্ধে অন্যায়কারী শাসকের শোষন-বঞ্চনার প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে। রুশ সাহিত্যকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের সর্বোচ্চ সোপানে। এই মহান কথাশিল্পীর সমগ্র সাহিত্যকর্মের অনুসন্ধিৎসু বিশ্লেষণে জীবনভিত্তিক সত্য ও সুন্দরের জয়গানই সুনিপুণভাবে আমৃত্যু প্রকাশ করে গেছেন। বিশেষত, মধ্যযুগের বর্ণনাময় রুশ সাহিত্যের চিরায়ত গণ্ডির বাইরে বের করে নিয়ে এসেছেন স্বরচিত সাহিত্যকে। ফলে রুশ সাহিত্য পেয়েছে এক অনন্য সাহিত্য মাত্রা। ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন জীবনাবসান ঘটে বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনের অব্যয় কথাশিল্পী মাক্সিম গোর্কির। তবুও গোর্কি আজও তার লেখনীর মাধ্যমে চির-অম্লান হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়ে, পাঠকের মণিকোঠায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৬
এসএস