ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বিশ্ব নাট্য দিবসের বার্তা | আনাতোলি ভাসিলিয়েভ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫১ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৬
বিশ্ব নাট্য দিবসের বার্তা | আনাতোলি ভাসিলিয়েভ

বিশ্ব নাট্য দিবস ২৭ মার্চ। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আইটআই) ১৯৬১ সাল থেকে এ দিবসটি উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।

পরবর্তী বছর প্যারিসে অনুষ্ঠিত থিয়েটার অব নেশনস উৎসবের সূচনা দিনটিকেই অর্থাৎ ২৭ মার্চ এ দিবসটি উদযাপনের রীতি প্রবর্তিত হয়। ১৯৮২ সাল থেকে বাংলাদেশেও এ দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। এবছর পৃথিবীর প্রায় ১শটি দেশে দিবসটি নানা আয়োজনে পালিত হয়েছে।

প্রতিবছর স্বনামধন্য কোনো নাট্য ব্যক্তিত্বকে এ দিবসে তার অনুভূতি, বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ বছর বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন ড্রামাটিক আর্টস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা রাশিয়ান নাট্যব্যক্তিত্ব আনাতোলি ভাসিলিয়েভ। তার বক্তব্যের ইংরেজি রূপ থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন হুমায়ূন আজম রেওয়াজ ।  

থিয়েটার কি আমাদের প্রয়োজন?
এই প্রশ্নটিই হাজার হাজার পেশাদারকে থিয়েটারের প্রতি হতাশ করে তুলেছে ও লাখো মানুষ নিজেদের প্রতি এই জিজ্ঞাসায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

কীসের জন্য এটা আমাদের প্রয়োজন?
যে সময়টিতে নান্দনিক দৃশ্যপট ক্রমশ গৌণ হয়ে পড়ছে, নগরে কোনো চৌরঙ্গি ও সমগ্র দেশজুড়ে ঘটতে থাকা বাস্তব জীবনের একান্ত সত্য বিষাদগাথার তুলনায়।

আমরা এটাকে কীভাবে দেখছি?
নাট্য মিলনায়তনের ঝকঝকে চকচকে গ্যালারি, ব্যালকনি, ভেলভেট মোড়ানো আসন, মঞ্চের নোংরা পার্শ্ব পর্দা,  অভিনেতার সুললিত কণ্ঠ কিংবা বিপরীতক্রমে এমনকিছু যা একবারেই ভিন্নরূপে উপস্থাপিত- কালো বাক্সের ভিতর রক্ত ও কাদায় বিবর্ণ বিক্ষুব্ধ উলঙ্গ মানুষ।

এটা আমাদেরকে কোনো বার্তা দেয়?
সবকিছুই!

থিয়েটার আমাদের বলতে পারে সবকিছুই।
কেমন করে স্বর্গীয় উদ্যানে দেবতারা বিচরণ করেন, কীভাবে কয়েদীরা অজ্ঞাত গুহায় তীব্র যন্ত্রণায় পঁচতে থাকে, কীভাবে আবেগ আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করে, কীভাবে ভালোবাসা ব্যর্থ হয়, কীভাবে এ পৃথিবী একজন ভালোমানুষকে প্রত্যাখ্যান করে, কীভাবে প্রতারণার শাসনব্যবস্থা জারি থাকে, কীভাবে মানুষ বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করে যখন উদ্বাস্তু শিবিরে শিশুরা ধুঁকছে, কীভাবে তাদেরকে মরুভূমিতে ফেরত পাঠানো হয় এবং কেমন করে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের প্রিয়জনের সান্নিধ্য বঞ্চিত হতে বাধ্য হই- থিয়েটার বলতে পারে এর সবই।  
সবকালেই থিয়েটার ছিলো আর থাকবে চিরকাল।
এই বর্তমানে, বিগত পঞ্চাশ বা সত্তর বছরে, এটা বিশেষভাবেই অপরিহার্য। এর কারণ হলো, আপনি যদি  সব প্রকারের গণশিল্প চর্চার দিকে তাকান, তাহলে আপনি প্রথমেই প্রত্যক্ষ করবেন, শুধুমাত্র থিয়েটারই আমাদেরকে এই অবস্থান তৈরি করে দিচ্ছে- মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়া স্লোগান, সবার দৃষ্টিতে একই বীক্ষণ, হাতে হাতে একই ইঙ্গিত এবং সবার শরীরে একই স্পন্দন। মানুষের মধ্যে কাজ করবার জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন নেই-  এটা আলোর স্বচ্ছতম অংশটির বিক্ষেপ ঘটায়, এটা শুধু উত্তর বা দক্ষিণ কিংবা পূর্ব বা পশ্চিমে সীমাবদ্ধ নয়, এটা আসলে নিজেই আলোর বিভা, পৃথিবীর প্রতিটি কোণ থেকে যার উৎসারণ, তাৎক্ষণিকভাবেই যা যেকোনো মানুষ শনাক্ত করতে পারে এর শত্রুময়তা কিংবা বন্ধুতা।

এবং আমাদের প্রয়োজন সেই থিয়েটার যা সতত ভিন্নতর, আমাদের প্রয়োজন বিচিত্রতর থিয়েটার।
এখনও আমি মনে করি, থিয়েটারের প্রাচীনতম রূপ-কৌশলই এই সময়ের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠবে। আচার-কৃত্যকেন্দ্রিক থিয়েটারকে মোকাবিলা করতে হবে না সভ্য জাতিদের কৃত্রিমতার। বস্তুবাদী সংস্কৃতি ক্রমশ ম্লান হয়ে পড়বে, তথাকথিত ‘সাংস্কৃতিক মতবাদ’ ক্রমশ স্বতন্ত্র জাতিসত্তাগুলোর বিনাশ ও বিতাড়ন নিশ্চিত করছে এবং কোনো একসময় তাদের সঙ্গে আমাদের মেলবন্ধনের আশাকেও বিতাড়িত করছে।
 
কিন্তু আমি সুষ্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করছি, থিয়েটার তার দ্বার উন্মোচন করে দিচ্ছে। প্রতিটি মানুষের ও সব মানুষের অবারিত অংশগ্রহণের দ্বার।
 
যন্ত্র আর কম্পিউটারের নরক থেকে থিয়েটারের দিকে ধাবিত হোন, টিকেটের বুথের সারিতে আর গ্যালারির প্রতিটি সারিতে যুক্ত হোন, কান পাতুন বিশ্বের দিকে এবং চোখ রাখুন জীবন্ত দৃশ্যকলায়! আপনার সামনে এটা থিয়েটার, এটাকে অবহেলাভরে পাশ কাটাবেন না এবং এতে অংশ নেওয়ার সুযোগটিও হারাবেন না। যথাসম্ভব এটি আমাদের ধমনীর রক্তস্পন্দন ও ত্রস্ত জীবনের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনার সবচাইতে মূল্যবান উপায়।

সবরকমের থিয়েটারই আমাদের প্রয়োজন।
শুধুমাত্র একটি প্রকৃতির থিয়েটার রয়েছে যা সুনিশ্চিতভাবেই কারও প্রয়োজন নেই। আমি বলতে চাচ্ছি- রাজনৈতিক নোংরামির থিয়েটারের কথা, রাজনৈতিক ‘মাউসট্র্যাপ’র থিয়েটার, রাজনৈতিক নেতাদের থিয়েটার, রাজনীতির ব্যর্থতার থিয়েটারের কথা। আমাদের নিশ্চিতভাবেই প্রয়োজন নেই সেই থিয়েটারের যা আমাদের দৈনন্দিন সন্ত্রাসকে প্রতিনিধিত্ব করে, সেটা ব্যক্তি বা সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী যার দ্বারাই হোক না কেন। আমাদের যা প্রয়োজন নেই তা হলো রাজপথ কিংবা চৌরঙ্গীতে লাশ ও রক্তের লীলা। রাজধানী শহরে কিংবা নিভৃত পল্লীতে, ধর্মীয় উগ্রতা কিংবা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবন ঘিরে কোনো কপটতা, মিথ্যাচার . . .।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।