বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্তিম বন্ধু ও মানবতাবাদী মার্কিন কবি ও গীতিকার অ্যালেন গিন্সবার্গ- পুরো নাম আরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গ। যার নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত তার বিখ্যাত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা বা গানটির কথা মনে পড়ে যায় এবং কবিতাটি পড়লে বর্বর পাকিস্তানিদের নির্মম নৃশংস গণহত্যার চিত্র যেনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
বাংলাদেশের বন্ধু কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯২৬ সালের ০৩ জুন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে জন্ম নেন। ০৫ এপ্রিল বাংলাদেশের পরম বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী অ্যালেন গিন্সবার্গের মৃত্যুদিবস। ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে তিনি পরলোক গমন করেন কিন্তু রেখে যান একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানিদের বর্বরতার চিহ্নের সময়ের নিরব সাক্ষী তার অমর কাব্য ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। তার মৃত্যুদিবসে মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা মানবতার মূর্ত প্রতীক অ্যালেন গিন্সবার্গকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করছি।
এই বিখ্যাত কবিতাটি বাংলায় ভাষান্তর করেন খান মোহাম্মদ ফারাবী, যেটি পড়লে চেখে পানি আটকিয়ে রাখা যায় না। দুই বাংলার জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী মৌসুমি ভৌমিক অত্যন্ত আগ্রহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই বাংলা কবিতার ভাবানুবাদ করেন এবং সুরারোপ করে গানাকারে নিয়ে আসেন। মৌসুমি ভৌমিকের কণ্ঠে মর্মস্পর্শী এই গানটি শুনলে হৃদয় ছুঁয়ে মন ভারাক্রান্ত হয়ে চোখ ভিজে আসে।
সম্প্রতি এস.এম সুমন ডন- মৌসুমি ভৌমিকের গাওয়া এ গানটিতে একাত্তরের দুর্লভ ভিডিওচিত্র সম্পাদনা করে ইউটিউবে বাংলা লিরিকসহ আপলোড করেছেন।
সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড- অ্যালেন গিন্সবার্গ
‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে
শত শত শত মানুষের দল
যশোর রোডের দু’ধারে বসত
বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল
কাদামাটি মাখা মানুষের দল
গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে
আকাশে বসত মরা ঈশ্বর
নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে
যুদ্ধে ছিন্ন ঘরবাড়ি দেশ
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান
এই কালো রাত কবে হবে শেষ
শত শত মুখ হায় একাত্তর
যশোর রোড যে কত কথা বলে
এত মরা মুখ আধ মরা পায়ে
পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে
সময় চলেছে রাজপথ ধরে
যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর
গরুগাড়ি কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে
লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়
ঘরহীন ভাসে শত শত লোক
লক্ষ জননী পাগলের প্রায়
রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু
পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে
এইটুকু শিশু এতবড় চোখ
দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর
এতো এতো শুধু মানুষের মুখ
যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন
ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ
কার কাছে বলি ভাত রুটি কথা
কাকে বলি কর কর কর ত্রাণ
কাকে বলি ওগো মৃত্যু থামাও
মরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রাণ
কাঁদো কাঁদো তুমি মানুষের দল
তোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকা
জননীর কোলে আধপেটা শিশু
এ কেমন বাঁচা, বেঁচে মরে থাকা
ছোট ছোট তুমি মানুষের দল
তোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়া
গুলিতে ছিন্ন দেহ-মন-মাটি
ঘর ছেড়েছো তো মাটি মিছে মায়া
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর
ঘর ভেঙ্গে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে
যশোর রোডের দু’ধারে মানুষ
এত এত লোক শুধু কেন মরে
শত শত চোখ আকাশটা দেখে
শত শত শত শিশু মরে গেল
যশোর রোডের যুদ্ধক্ষেত্রে
ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো
কাদামাটি মাখা মানুষের দল
গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে
আকাশে বসত মরা ঈশ্বর
নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে
যুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ি-দেশ
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান
এই কালো রাত কবে হবে শেষ
শত শত মুখ হায় একাত্তর
যশোর রোড যে কত কথা বলে
এত মরা মুখ আধ মরা পায়ে
পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে
এত মরা মুখ আধ মরা পায়ে
পূর্ব বাংলা কলকাতা চলে। ’
যেখানে অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার-মানবতা পদদলিত সেখানেই প্রতিবাদী কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের কলম ঝলসে ওঠে। একাত্তরে বাংলাদেশে বর্বর পাকিস্তানিদের নির্বিচারে গণহত্যা ও ভারতে আশ্রয় নেওয়া কোটি শরণার্থীদের দুর্দশার খবর কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের কানেও পৌঁছে যায়। তিনি শরণার্থীদের জন্য সংগ্রহ করা কিছু আর্থিক সাহায্য নিয়ে নিজের চোখে দেখার জন্য ছুটে আসেন এবং ওপার বাংলার সাহিত্যিক-কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে সীমান্তের শরণার্থীদের দুর্দশা দেখার জন্য শরণার্থী ক্যাম্পে চলে আসেন।
‘যশোর রোড’ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবাংলা রাজ্যের মধ্যে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী রোড। বাংলাদেশ থেকে কোটি শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্য স্থানে বিশেষ করে যশোর রোডে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্যাপক বৃষ্টি ও বন্যায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে যায়, তারপরও গিন্সবার্গ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছে সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সীমাহীন দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন। বর্বর পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ার জন্য আমরা হাতে তুলে নিয়েছিলাম অস্ত্র আর কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ নিয়েছিলেন কলম। মানুষের এই অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, হাহাকার দেখে গিন্সবার্গ ভীষণ মর্মাহত হন। নিজের চোখে দেখা দুঃস্বপ্নের মতো তার এই স্মৃতি বিশ্ববাসী ও মাকির্নীদের দৃষ্টিআকর্ষণের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেই পাকিস্তানিদের চরম ধিক্কার জানিয়ে লিখলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। তার উদ্দেশ্য ছিলো, বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত আচরণ বা ঘটনার আড়ালে যারা ইন্ধন দিয়ে যারা তাদেরকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে- তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়া। ১৫২ লাইনের দীর্ঘ কবিতাটি পরবর্তীতে ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত হলে, সারাবিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া নৃশংস এ গণহত্যার খবর পড়ে বিশ্বমানবতা গণহত্যাকারী পাকিস্তানকে ধিক্কার জানাতে থাকে।
অ্যালেন গিন্সবার্গ তীব্র উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে তার বন্ধু প্রখ্যাত গায়ক জন লেননকে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি পড়ে শোনান। কবিতা পাঠ শেষে গিন্সবার্গ লক্ষ্য করলেন, জন লেননের চোখে পানি, তখনই তিনি বুঝতে পারলেন তার এই কবিতাটি লেখা সার্থক হয়েছে। অশ্রসিক্ত নয়নে জন লেনন তখনই গিন্সবার্গকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাকে গানে রূপ দেওয়ার জন্য।
‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জ চার্চে একটি কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করা হলে বেশ প্রশংসিত হয়। গিন্সবার্গ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সঙ্গীতশিল্পী বব ডিলান ও অন্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় কনসার্ট আয়োজন করে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বব ডিলানের উদ্যোগে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’র গান হয়ে ওঠার প্রয়াস চলে এবং কণ্ঠ ছিলে গিন্সবার্গের ও গিটারে ছিলেন বব ডিলান নিজেই।
অবশেষে জন লেননের পরামর্শ মেনে গিন্সবার্গ গানটি রেকর্ড আকারে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন।
অ্যালেন গিন্সবার্গ তার বিখ্যাত কবিতা ‘হাউল’ রচনা করে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি এই কবিতাটি লিখেছিলেন তার বিট প্রজন্মের বন্ধুদের বরণ করে নিয়ে। এই কবিতা তাকে এবং তার বন্ধুদেরকে অনেক খ্যাতি এনে দিয়েছিলো। ১৯৬০ সালে গিন্সবার্গ ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। লেখক-কবি-সাহিত্যিক গিন্সবার্গের বই ‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ ১৯৭৪ সালে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড এবং তিনি ১৯৭৯ সালে ‘ন্যাশনাল আর্টস ক্লাব’ থেকে স্বর্ণ পদক লাভ করেন। তিনি রবার্ট ফ্রস্ট মেডেল পান ১৯৮৬ সালে। ১৯৯৫ সালে তার বই ‘কসমোপলিটান গ্রিটিংস: পয়েমস ১৯৮৬-১৯৯২’ পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলো।
গিন্সবার্গ ১৯৮৬ সাল থেকে আমৃত্যু ব্রুকলিন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসাবে কাব্য পড়াতেন। তিনি খুবই সাধারণ জীবনযাপনে বিশ্বাসী ছিলেন এবং অহিংস বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার লেখক-কবি-সাহিত্যিক গিন্সবার্গের কাছে পুরো বাঙালি জাতি ঋণী। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী যখন বাংলাদেশে গণহত্যা, নারীধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের উল্লাসে মেতে উঠেছিলো, তখন গিন্সবার্গ বাংলার স্বাধীনতাকামী, নিপীড়িত, শোষিত, লাঞ্ছিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে যতোজন বিদেশি বন্ধু বাংলাদেশিদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই মহানুভব কবি। বাংলাদেশ সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কবি অ্যালেন গিনসবার্গকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দিয়ে সম্মানিত করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ বাংলাদশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি স্বাধীনতার এতো বছর পরও কি বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে অর্ন্তভুক্ত হতে পারে না? এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা (২নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর)
বাংলাদেশ সময়: ১০৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৬
এসএস