ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

তেলাপোকা | হুমায়ূন-আল-শফিক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৬
তেলাপোকা | হুমায়ূন-আল-শফিক

আমি ঠিক করলাম, বুড়িগঙ্গা নদীই আমার বসবাসের জন্য একমাত্র যোগ্য। কারণ, নিজের জন্য অন্যকোনো আবাস এখন কল্পনা করতে পারছি না।

প্রচণ্ড বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গেছি। পথে কাদার আস্তরণে কতোবার যে নিজেকে সঁপে দিতে হয়েছে বলা মুশকিল। ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। এই পৃথিবীতে আমার আর এক দণ্ডও থাকতে ইচ্ছে করছে না। ওপারে গিয়ে কী হবে জানার জন্য উদ্বিগ্ন নই। হয়তো বীভৎস জীবন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এইসব ভাবতে ভাবতে আমি জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হলাম।

যখন ভাবলাম, আহা কী করছি! তখন দেখি আমি পিচঢালা ব্রিজেই দাঁড়িয়ে। কেউ আমার ঘাড় চেপে ধরে আছে।

এটার কি কোনো দরকার আছে? লোকটি গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো।
 আমি খুবই বিস্মিত হয়ে পেছন ঘুরে তাকাই। মনে মনে খানিকটা খুশিই হয়েছিলাম। দেখতে পেলাম, আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন একজন ছোটখাট মধ্যবয়সী লোক। তাকে দেখে যে কেউ বিদেশি বলে ভুল করবে নিশ্চিত। তার শরীরে মলিন কাপড়। মুখে একগুচ্ছ দাড়ি আর গাম্ভীর্য।
-    তুমি কি করতে যাচ্ছিলে ধারণা আছে? কোনো এক মহাপুরুষের মতো কথাটা বলে আমার চোখের দিকে তাকালেন তিনি। তোমার কী সমস্যা, আমাকে বলো- আমি সমাধান করার চেষ্টা করবো।
আমি চুপ করে শুনছি, কিছু বলতে পারছি না। তিনি আমাকে তার সঙ্গে যেতে বললেন। আমিও কোনোকিছু না ভেবে তার পিছু নিলাম।  

একটা সরু পথে ধরে হেঁটে চলেছি। রাস্তাটির আশেপাশে থকথকে কাদা, আমার জুতার তলায় লেগে যাচ্ছিলো। ইটের রাস্তা। জায়গায় জায়গায় ইট উঠে গেছে। আলগা ইটে পা পড়লেই কাদামাখা পানি এসে আমার দামী প্যান্টটা ময়লা করে দিয়ে হাসছে, যেনো উপহাস করছে। আশেপাশের দালানগুলো পুরানো। তাদের দেয়ালে শ্যাওলা পরে সবুজ হয়ে আছে। দেয়ালের জায়গায় জায়গায় খাওয়া-খাওয়া, যেনো বাচ্চারা খামছে উঠিয়ে ফেলেছে কারও চামড়া।

এমন সংকীর্ণ পথ ধরে চলতে চলতে একসময় আমরা দু’জন একটা মাঝারি আকৃতির প্রাচীরের সামনে এসে থামলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চলো এটা আমার বাড়ি। জানি ভালো লাগবে না। কিন্তু তোমার জন্য এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা করতে পারবো না।
আমি বললাম- সমস্যা নেই। জীবনে এমন অভিজ্ঞতার দরকার আছে। চলুন চলুন। ভেতরে যাই। আমি চাচ্ছি ভিতরে ঢুকে আগে কিছু খেতে।
 
ভাঙাচোরা দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে আমার টি-শার্টের একটা অংশ ছিঁড়ে গেলো। কিন্তু আমলে নিলাম না, এগিয়ে চললাম। ছোট বাড়ি। এ বাড়িতেও শ্যাওলার অভাব নেই। অসচেতনভাবে চলতে গেলে হোঁচট খাওয়া অস্বাভাবিক নয়। দেয়ালের অবস্থা একেবারে করুণ। ভাঙন লেগে গেছে দেয়ালের প্রত্যেকটা অংশে। ভূমিকম্পের মাত্রা যদি এক-দুইও হয় তাতেই এই দেয়ালগুলো ভেঙে পড়বে নিশ্চিত।

খানিকটা হেঁটেই ঘরে প্রবেশ করলাম। একটা সুন্দর গন্ধে ভরে উঠলো চারদিক। একটু আগে কেউ হয়তো কোনো ব্র্যান্ডের এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করেছে এই ঘরে। আমার মনটা ভরে গেলো। এই সুগন্ধি এমনই পাগল করা যে আমি একটু আগে কী করতে যাচ্ছিলাম বা কী হয়েছিলো ভুলেই গেলাম। লোকটা আমাকে একটি কাঠের চেয়ারে বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন।
 
আমি রুমটাকে পর্যবেক্ষণ করে যা দেখতে পেলাম, প্রথমত- এই ঘরটা খুব ছোট। বড়জোর পাঁচজন বসতে পারবে। ডানে জানালার পাশে টেবিলক্লথ ছাড়া একটি টেবিল। তবে কালো রঙ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। চকচক করছে পূর্নিমার আলোতে। টেবিল থেকে দূরে দু’টি চেয়ার। একটি ঠিক আমার সামনাসামনি ও অন্যটিতে নিজে বসে আছি। ঘরের প্রতি কোণায় কেন যেনো লাল রঙ মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম কোণা থেকে দু’টি তেলাপোকা হড়হড় করে বের হয়েই আমার দিকে আসতে থাকলো। তখন লোকটা এসে হাজির হলেন। তিনি তেলাপোকাদের দেখে বলে উঠলেন- যা যাহ্। শয়তানগুলো ভাগ বলছি। নইলে কিন্তু খবর আছে। তার কথা শুনে যেনো তেলাপোকাগুলো ভয় পেলো। সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে পড়লো।  

এরপর লোকটা আমার মুখোমুখি হয়ে বললেন, তোমার নাম কী? আমি ডাক নামটি বললাম।
তিনি একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে এসেছেন। বৃষ্টিতে হালকা শীত শীত করছে। আমার শরীরও শীতে আড়ষ্ট। তিনি আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বললেন, দেখো তুমি এখন ছোটমানুষ, যা করতে গিয়েছিলে তা কিন্তু জঘন্যরকম খারাপ কাজ। তবে বীরের কাজ।
 
তার ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে আমার শরীর কেঁপে উঠলো। তিনি খুব দ্রুত নিঃশ্বাস নিয়ে কথা বলছেন।
সুন্দর উচ্চারণ ভঙ্গিতে বললেন - শোনো, ফাতাউর। তোমার সমস্যাটা বলো এবার। তারপর দেখি কিছু করতে পারি কিনা।

আমি ধীর সুরে শুরু করলাম, আমার বাবা একজন বিরাট ব্যবসী। আমাদের পূর্বপুরুষদের আভিজাত্য থাকা সত্ত্বেও বাবা শুধু অর্থের লোভে একের পর এক খারাপ কাজ করে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে বাধা দেই কিন্তু তিনি আমাকে গ্রাহ্য করেন না। আমি ছোট থাকতেই আমার মা মারা যান। তাই মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত এক শিশু আমি। ভেবেছিলাম বাবা যেহেতু আবার বিয়ে করেননি, তা নিশ্চয় আমাকে সৎ মায়ের কাছে যাতে হেস্তনেস্ত হতে না হয় সে কারণে। অনতিবিলম্বে আমি আবিষ্কার করলাম, এইসব তার লোকদেখানো ভালোবাসা।

তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নারীর সঙ্গে দেখতে পেয়ে আমার সন্দেহ জাগলো। বাবাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি উত্তর দিলেন, ব্যবসার কাজে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হয়। কিন্তু কিছুদিন পর যখন এক কাকার সাহায্যে জানতে পারলাম বাবার কুকীর্তির কথা। সবচেয়ে যে বিষয়টা আমাকে ব্যথিত করলো..। বলে থেমে গেলাম।
-    থামলে কেন, বলো।
-    মা যখন বাবার কুকীর্তির সব কথা জানতে পারেন তখন বাবাই মাকে খুন করেন। কিন্তু আমি কী করবো? নিজের বাবাকে তো আর খুন করা যায় না। তাই নিজেকেই শেষ করতে ছুটে আসি বুড়িগঙ্গায়। এমন অবস্থায় আমার কি-ই বা করার ছিলো বলুন।
-    হ্যাঁ, আমি তোমার হতাশার কারণ বুঝতে পারছি। জানো তো, কাজে ডুবে থাকলে তোমাকে আজ এখানে বসে থাকতে হতো না।
-    তাহলে এখন কী করবো আমি?
-    সমাধান একটাই, তুমি আমার সঙ্গে কাজে লেগে পড়ো। দেখবে সব হতাশা কেটে যাবে।
-    কী কাজ?
-    আমি যা করি।
-    কী কাজ করেন?
-    আমার শখ হলো আত্মাদের ধরে ধরে তেলাপোকায় পরিণত করা।

কথাটা শুনেই একটা ঝাঁকি খেলাম। কী বলছেন ভদ্রলোক। পাগল নাকি?

বললেন- তোমাকে শিখিয়ে দেওয়া হবে কীভাবে আত্মা ধরা যায়।
-    আমি কি পারবো? এবার রেহাই পাওয়ার জন্য বললাম।
-    আরে, পারবে পারবে। তোমাকে দিয়ে হবে। আজ রাতটা বিশ্রাম করো। কাল রাত থেকে শুরু হবে তোমার কাজ।
এসব কথা শুনে আমার বমি বমি ভাব হলো। এর চেয়ে বরং মরণই ভালো ছিলো। আত্মা নিয়ে কারবার করতে হবে একথা ভূতে শুনলেও হাসবে। আবার ঝপঝপ করে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো।
-    শোনো, আজ এমনিতেই বৃষ্টির দিন আত্মারা বের হবে না। কিছু কি খেয়েছো?
প্রচণ্ড ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও বললাম- আমার ক্ষিধে নেই। আসলে এইসব পাগলাটে কথা শোনার পর ক্ষুধাও মরে ভূত হয়ে গেছে।
তিনি তার রুমে চলে গেলেন। আমাকে একটা কাঁথা আর বালিশ এনে দিয়ে বললেন, তুমি এখানেই শুয়ে পড়ো। কাল দেখা হবে। আমি সুবোধ ছেলেটির মতো চুপচাপ শুয়ে পড়লাম।

ভাঙা দেয়ালের ফাঁক দিয়ে রুপালি আলো আমার শরীরে এসে খোঁচাতে আরম্ভ করলো। বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত না উঠে থাকতে পারলাম না। কিন্তু উঠতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। চেষ্টা করেও উঠতে পারছি না। নিজের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে সফল না হয়ে চিত হয়েই শুয়ে চিন্তাকে তাড়াতে চাইছি। কী হচ্ছে আমার সঙ্গে!
 
একটু পর দৈত্যকার একজোড়া পা আমার দিকে আসতে দেখলাম। পায়ের নখগুলো বিশাল বিশাল কোদালের মতো। স্বপ্ন? না স্বপ্ন না।

লোকটার মুখ ঠিক মতো ঠাহর করতে পারছি না। অস্পষ্ট। তবুও কেমন যেনো চেনা চেনা লাগছে। মৃত্যর কাছাকাছি পৌঁছেও বেঁচে ফিরে এসে কি আবার সেই মৃত্যুপুরীতে ঢুকে পড়লাম?

আগের মতোই শুয়ে আছি। একটু ঘুরে শোয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। সামনের দিকে যতোদূর দেখতে পাচ্ছি তেলাপোকার সাত-আটটি পা। ঠিক আমার বুকের উপর।
দৈত্যটির হাত এবার আমার দিকে আসছে। বিশাল লোমশ হাত। আঙ্গুলগুলোও কেমন যেনো ফ্যাকাসে। গতকাল যেমন লোকটির ফ্যাকাসে আঙ্গুল ছিলো।

আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই সে তার দুই আঙুল দিয়ে আমাকে তুলে বললো, হ্যালো ছোটবন্ধু রাতে ভালো ঘুম হয়েছে তো! আমি কথা বলার জন্য মুখ খুললাম কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। আমাকে সে বোতলবন্দি করে রেখে চলে গেলো। দৈত্যটা যাওয়ার আগে বলে গেলো- তোমাকে ভালোমতো প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে আত্মাদের তেলাপোকায় পরিণত করতে পারো।

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৬
এসএমএন/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।