মূল: অগাস্ট কুবিজেক
অনুবাদ: আদনান সৈয়দ
[লেখক অগাস্ট কুবিজেক ছিলেন কুখ্যাত নাজি বাহিনীর জনক অ্যাডলফ হিটলারের ছেলেবেলার বন্ধু। তার জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ’ থেকে জানা যায়, হিটলার তার প্রথম যৌবনে গান গাইতেন, ধ্রুপদী সঙ্গীতের সমঝদার ছিলেন, ছিলেন একজন প্রেমিক ও ছবি আঁকায় তার ছিলো আজন্ম ঝোঁক।
পর্ব ৭
তৃতীয় অধ্যায়
অতিরঞ্জন করে কথা বলা ছিল তার (অ্যাডলফ হিটলার) স্বভাব। অনেকটা বানিয়ে বানিয়ে সে নিজের কথাটা তুলে ধরতে চাইতো। সে যখন তার কোনো প্রিয় বিষয় নিয়ে কথা বলতো যেমন, দানিয়ুব নদীর উপর যে ব্রিজটি রয়েছে সেটি অথবা তার পছন্দের জাদুঘর, রেলওয়ে স্টেশন- সবকিছুই সে তখন তার নিজের শহর লিজে কীভাবে পুনর্নিমাণ করবে তার একটা পরিকল্পনা আমাকে শোনাতো। তখন আমি তাকে শুধু এ কথাটিই বলতাম, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে তা কি সম্ভব? আমি এ বিষয়ে তার কাছ থেকে কোনো উত্তর পেতাম না বরং সে তার হাত উঠিয়ে আমাকে চুপ থাকতে বলতো। পরবর্তীতে আমি এ বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি এবং সত্যি বলতে, ষোল-সতের বছর বয়সী এক যুবক এরকম বিশাল কাজে হাত দিয়ে এতো বড় কিছু একটা করে ফেলবে, এই ভাবনাটাই আমার মস্তিষ্ক থেকে ধীরে ধীরে ঝেড়ে ফেলে দেই। যদি আমি তার সব কথাই গুরুত্বের সঙ্গে নেই তবে তা নিপাট পাগলামো অথবা চূড়ান্ত বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না। তবে তার চোখ দেখে বোঝা যেতো সে যেনো তার দৃঢ় লক্ষ্যের দিকেই এগিয়ে চলেছে।
অ্যাডলফ তার আদব-কায়দা আর সুন্দর ব্যবহার দিয়ে সুন্দর এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছিলো। সমাজের সবরকম রীতিনীতি সে অনুধাবন করতে পেরেছিলো তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থেকেই। সে তার শুল্ক কর্মকর্তা বাবার কথা সবসময় বলতে ভালোবাসতো যিনি কিনা সেইসময় একজন সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন অথবা এই পদমর্যাদার কেউ ছিলেন। তার বাবার বিষয়ে কথা বলার সময় সে বুঝতেও পেতো না, তার উচ্চারিত প্রতিটা শব্দে কতো প্রচণ্ডরকমভাবে সিভিল সার্ভিসওয়ালাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ পেতো। আমাকে লেখা তার প্রতিটা চিঠিতে সে সবসময়ই আমার বাড়ির সবাইকে শুভেচ্ছা জানাতো এবং আমার বাবা-মায়ের প্রতি তার পরম শ্রদ্ধা প্রকাশ করে সে তার চিঠিটি শেষ করতো।
আমরা যখন ভিয়েনায় একত্রে বেশকিছুদিন ছিলাম তখন আবিষ্কার করেছিলাম, অ্যাডলফ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার ট্রাউজার মেটরেসের নিচে রেখে দিতো যেনো সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে তা সুন্দর ভাঁজ হয়ে থাকে। অ্যাডলফ পরিপাটি করে চলতে ভালোবাসতো। যদিও সে জানতো, দেখতে সে মোটেও তেমন আকর্ষণীয় নয়, তারপরও সে নিজেকে যতোটুকু সুশ্রী করা দরকার ততোটুকু সে করতো। সে তার অসাধারণ অভিনয় গুণকে তার বাগ প্রতিভার সঙ্গে মিশিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে ভালোবাসতো। আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, হিটলারের এতো গুণ থাকার পরও সে ভিয়েনায় কেন খুব একটা সফল হতে পারেনি! অবশ্য এ কথাও সত্য, হিটলার প্রাতিষ্ঠানিক সফলতাকে কখনও আমল দিতো না। ভিয়েনার মানুষজন যারা হিটলারকে কাছ থেকে চিনতেন, তারা কোনোভাবেই হিটলারকে ঠিকভাবে বুঝতে পারতেন না। তারা শুধু ভাবতেন, ছেলেটা দেখতে এতো ছিমছাম, এতো সুন্দর করে বক্তৃতা করে, এতো বুদ্ধিমান- সে কেনো নিজের প্রতিষ্ঠা নিয়ে এতো উদাসীন থাকে। তাদের ধারণা ছিলো, হিটলার সম্ভবত খুব দাম্ভিক অথবা হয়তো সে তার জ্ঞান-গরিমা নিয়ে খুব অহংকারী হয়ে থাকবে। আশেপাশের মানুষকে সে যেনো কোনো পাত্তাই দিতে চায় না।
চারুকলার জন্য হিটলারের জীবন ছিলো নিবেদিত। ভিয়েনায় টাকার অভাব ছিলো তার স্বাভাবিক ঘটনা। অল্প যে কটা টাকা সে জামাতে পারতো, সেটি দিয়ে খাবার না কিনে সে থিয়েটারের নাটক দেখার টিকেট কিনতো। সে অন্যদের মতো বৈষয়িক জীবন নিয়ে মোটেও ভাবতো না। সে সিগারেট ফুকতো না, মদও খেতো না। ভিয়েনায় থাকাকালীন শুধুমাত্র জীবন ধারণের জন্য হিটলার দিনের পর দিন দুধ আর পাউরুটির উপর নির্ভর করতো।
শারীরিক সৌন্দর্য কিংবা খেলাধুলা করার প্রতি তার অবজ্ঞা ছিলো আজন্ম। পরবর্তীতে তা যেনো হিটলারের কাছে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আমি কোথায় যেনো পড়েছিলাম, সে কতো সাহসিকতার সঙ্গেই না একবার দানিয়ুব নদী সাঁতার কেটে অতিক্রম করেছিলো। আমাদের দু’জনের একত্রে সাঁতার কাটার স্মৃতি আমার খুব একটা মনে নেই তবে এইটুকু বলতে পারবো, মাঝে মধ্যেই আমরা শখের সাঁতার কাটতে যেতাম। তবে তার মূল আকর্ষণ ছিলো বাইসাইকেল ক্লাবের দিকে। বাইসাইকেল ক্লাব শীতকালে আইস স্কেটিংয়ের আয়োজন করতো। হিটলার এই বাইসাইকেল ক্লাবের প্রতি আকষর্ণের অন্যতম আরেকটি কারণ ছিলো, যে মেয়েটিকে সে ভালোবাসতো, সে বাইসাইকেল ক্লাবে আইস স্কেটিংয়ের চর্চা করতো।
শারীরিক ব্যায়ামের জন্যে হাঁটাই ছিলো অ্যাডলফের একমাত্র ব্যায়াম। সে সবসময় হাঁটতে পছন্দ করতো। সে সবজায়গায় হাঁটতো এমনকি আমি যেখানে কাজ করি সেখানেও সে হেঁটে চলে আসতো। আমি যে বাড়িতে থাকি সেখানেও সে সর্বত্র হাঁটাহাটি করতো। বিরামহীনভাবে সে হাঁটতে ভালোবাসতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোনোরকম বিশ্রাম ছাড়াই সে হাঁটতো। লিজ শহরটি সর্বত্র হেঁটে আমরা চষে বেড়িয়েছি। প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো অসাধারণ তবে অবশ্যই তার নিজের মতো করে। তবে প্রকৃতি নিয়ে পড়াশোনায় তার কোনো উৎসাহ ছিলো না। আমি খুব কম সময়ই এ বিষয় নিয়ে তাকে পড়াশোনা করতে দেখেছি। স্কুলজীবনে সে উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে একবার বেশ মেতে উঠেছিলো এবং নিজেই একটি ভেষজ বাগান দিয়েছিলো। তবে সে আগ্রহটা ছিলো শুধু স্কুলের কারণেই, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়। তবে বৃহৎ অর্থে প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো। সে প্রকৃতিকে উচ্চারণ করতো বাইরের এক বিস্তৃত জগৎ বলে। যখন এটি সে উচ্চারণ করতো, তার ঠোট দেখে মনে হতো সে বুঝি প্রকৃতির পরিবর্তে ‘ঘর’ উচ্চারণ করছে। তবে তার কাছে ঘরের মাহাত্ম ছিলো প্রকৃতির মতোই। আমাদের বন্ধুত্বের প্রথম বছরই আমি আবিষ্কার করেছিলাম, সে ছিলো নিশাচর প্রকৃতির। রাতের বেলা একা একা ঘুরতে সে পছন্দ করতো অথবা কোনো অজানা-অচেনা জায়গায় সময় কাটাতে ভালোবাসতো।
এই বাউণ্ডেলেপনা স্বভাব তার জীবনে বড় একটা ছাপ ফেলেছিলো। শহরে বেড়ে ওঠা এই মানুষটা সম্পূর্ণরূপে এক ভিন্ন মানুষে পরিণত হয়ে যায়। তার চরিত্রের ভিন্ন কিছু স্বত্ত্বা তখন যেনো পরিপূর্ণভাবে জেগে উঠে। সে যখন মুলভিয়েরতেল শহরের নীরব বিচের কাঠের রাস্তা অথবা গভীর রাতে ফ্রেইনবার্গ শহরের সরু পথ দিয়ে একা একা হাঁটতো, তখন আশেপাশে কোথাও কোনো ভ্রুক্ষেপ করতো না। অনেক দিন ধরে আমি তার এই অদ্ভুত বিষয়টি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। যখন রাস্তায় সূর্যের তেজ প্রখর হতো এবং বিশুদ্ধ প্রাণময় বাতাস গোটা শহরে প্রকৃতির ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিদো তখন সে যেনো প্রকৃতির টানে উন্মাদ হয়ে উঠতো, পাগলের মতো সে রাস্তা থেকে মাঠে নেমে পড়তো। কিন্তু পরক্ষণেই সে আমাকে বলতো, তার পক্ষে এই গ্রামের মতো জায়গায় বেশিসময় থাকা কঠিন। তার জন্য গ্রামে বসবাস করা ছিলো খুব কঠিন। প্রকৃতির প্রতি তার সব ভালোবাসা ততোক্ষণ পর্যন্তই অটুট থাকতো যতোক্ষণ না সে আবার শহরে চলে আসতে পারতো। তার চরিত্রের এই দ্বৈতনীতি আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৬
এসএনএস
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-১)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-২)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৩)
**দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৪)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৫)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৬)