ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৬
সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’

কবিতা এবং কথাসাহিত্যে খ্যাতি অর্জন করলেও নাটকে বিশেষ করে কাব্যনাটকে সৈয়দ শামসুল হকের (জন্ম: কুড়িগ্রাম, ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫; মৃত্যু: ঢাকা, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) আগ্রহ ও সাফল্য ঈর্ষণীয়। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলা কাব্যনাটকের শৈল্পিক রূপায়নে তিনি অবিকল্প নির্মাতা।

লোকঐতিহ্য, ইতিহাস, সমকালীন রাজনীতি এবং জাতিগত অপার সম্ভাবনার বিরাট ব্যাপক ক্যানভাসে তিনি সাজিয়েছেন তাঁর নাটকের মঞ্চ ও যাবতীয় প্রাসঙ্গিক-আনুষঙ্গিক সাজ-সজ্জা। সাধারণ মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অসাধারণত্ব আর মানবিক গুণাবলী ও সৃজনশীলতার অন্বেষা এবং প্রকাশের দিকে সৈয়দ হকের ঝোঁক পরিলক্ষিত হয় সর্বদা। তিনি যেন শক্তি ও সাহসের সমাচার লিপিবদ্ধকরণের শিল্পী; জেগে ওঠার গল্প বানানোর দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগর। এই নির্মাতার ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (রচনাকাল ও স্থান: ১ মে-১৩ জুন, ১৯৭৫, হ্যাম্পস্টেড, লন্ডন) মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক সমকালীন বাস্তবতা এবং ব্রাত্যজনের অমিত তেজের সরল সত্যের অকৃত্রিম ও শৈল্পিক প্রকাশ।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকটির পর্যালোচনায় প্রবেশের পূর্বে সৈয়দ হকের নাটকের প্রতি হৃদয়ের টান এবং বর্তমান নাটক রচনার পরিপ্রেক্ষিত, ঘটনাপ্রবাহ ও কার্যকারণ সম্বন্ধে কিছুটা পাঠ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছি।   হক লিখছেন: “ভাষা মাধ্যমে নাটক আমার সবশেষের সংসার; অথচ, এখন পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, নাটকের জন্য আমি তৈরি হয়ে উঠছিলাম সেই ছোটবেলায় বালকের বিস্ময় নিয়ে লেখা ভোরের শেফালী ফুল আর দেয়ালে ঝোলানো বিবর্ণ তাজমহল বিষয়ে দু’টি পদ্য রচনারও বহু আগে- আগে এমনকি আমার এই আমিকে অনুভব করে উঠবার। একেক মানুষ বয়সের একেক কালে তার আমির সাক্ষাৎ পায়; আমার বেলায় তা একটি অসুখের (টাইফয়েড) পর, যখন সকলেই বলছিল ‘এ যাত্রা এ শিশু টিকে গেলে হয়’; এবং টিকে যখন গেলাম, এক স্বর্ণলতার মতো আলোর ঝুরি নামা ভোরে বলে উঠলাম ‘আমি বেঁচে আছি তাহলে’- ঐ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমি নাটকের দোলা অনুভব করে উঠি আমার শোণিতে, এখন সনাক্ত করতে পারি। ” [ভূমিকা, কাব্যনাট্য সংগ্রহ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯১]

সৈয়দ হক শৈশবে যাত্রাপাগল মানুষ বাবার সাথে শীতের রাতে ভ্রাম্যমাণ যাত্রাদলের পালা দেখেছেন, কুড়িগ্রামের শৌখিন যুবকদের বাৎসরিক নাট্যাভিনয় উপভোগ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার কালে অকালে পিতাকে হারিয়ে জীবিকার জন্য বিদেশি বেতার-নাটকের অনুবাদ করেছেন; অতঃপর মৌলিক নাটক লিখে সামান্য সাহস সঞ্চয় করে নাটকের উদার উঠানে প্রবেশ করেছেন। কবিতার ভাবজগতে বিচরণ করতে করতে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলা নাটকের বিকাশের এক বিশেষ সময়-পরিসরে তিনি নাটকে ভাবনার স্থিতি স্থাপন করলেন। টিএস এলিয়টের কাব্যনাট্যচিন্তা দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছেন খানিকটা। আর সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের মাটির গন্ধে ও বাতাসের প্রবাহে লেগে-থাকা নাট্যআবহ ও সঙ্গীতের তোড়ে ভেসেছেন তিনি মানসিকভাবে; শ্রমজীবী মানুষের জীবনাচার, রাজনৈতিক স্লোগান, ময়মনসিংহ গীতিকা প্রভৃতি বিষয় ও বাস্তবতা সৈয়দ হককে নাটকের ভাষা-কাঠামো এবং পরিবেশনশৈলীর উপাদান যুগিয়েছে। নাটক-নির্মাণে তাঁর যে হৃদয়ের আবেগ প্রবলভাবে জড়িত ছিল তার প্রমাণ মিলে বহুভাবে; বর্তমান নাটক রচনার পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে লেখকের একটি ব্যাখ্যায় আমরা তাঁর আত্মপ্রতিফলন দেখি। তিনি লিখছেন: “সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, বিদেশ থেকে ছুটিতে দেশে ফিরে, ঢাকার প্রবল নাট্যতরঙ্গে ভেসে যাই এবং ফিরে গিয়ে রচনা করি ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’- এক সংকীর্ণ ঘরে, টেবিলের অভাবে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে হাঁটুর ওপর খাতা রেখে, অফিস যাতায়াতের পথে পাতাল রেলে মনে মনে; এই রচনাটি শেষ করে উঠবার পরে মনে হয়, দীর্ঘদিন থেকে এরই জন্যে তো আমি প্রস্তুত ছিলাম। ” এই নাটকে নাট্যনির্মাতা সৈয়দ হক মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মানুষের অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের লড়াইয়ে যোগ দেবার প্রবল-অপ্রতিরোধ্য বাসনা ও প্রেরণা এবং তার সমূহ ইতি-নেতির পারিপার্শ্বিকতাকে তুলে ধরেছেন কবিতার সামর্থ্য ও শক্তিকে যথাযথভাবে বিবেচনায় রেখে। সংলাপ ও পরিবেশ নির্মাণ এবং প্রকাশের ভঙ্গি কেবল অভিনবই নয়; বিপ্লবীও বটে! নাটকের কাঠামো এবং ভাষা প্রয়োগে তিনি এখানে সাহসী উদ্যোক্তা।

গ্রামপ্রধান ও নদীবিধৌত এই বাংলাদেশে অজপাড়াগাঁয়ের মানুষের প্রবণতা চিত্রণে এবং তাদের সমবেত কর্মের প্রবাহকে ধরতে তিনি রূপক-চিত্রকল্পের আশ্রয় ও সহায়তা নিয়েছেন। এই কাব্যনাটকটির শুরুতে গ্রামবাসীর সমবেত কণ্ঠের এক উচ্চারণ এরকম: ‘মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান/...মানুষ আসতে আছে বাচ্চাকাচ্চা-বৌ-বিধবা বইন/...কই যাই কি করি যে তার ঠিক নাই/...বাচ্চার খিদার মুখে শুকনা দুধ দিয়া/...খাড়া আছি খালি একজোড়া চক্ষু নিয়া। ’ অভাবের তাড়নায় ক্লিন্ন, বিপদে দিশেহারা কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উন্নতশির সাধারণ মানুষের অবস্থা ও অবস্থান বুঝানোর প্রয়োজনে নির্মিত এইসব কথামালা সত্যিই অভিনব। যে মানুষগুলো অল্প পেলেই খুশি; ভাত-মাছের জন্য যাদের সামান্য প্রত্যাশা; একটু নিরাপদ ঘুমের জন্য যাদের আকুতি; যে মানুষগুলোর কোনো উচ্চাশা কিংবা ন্যুনতম লোভ নেই মনে- তাদের কপালে যদি নেমে আসে যুদ্ধ নামের বিভীষিকা, তাহলে কী যে বিপন্নতা তৈরি হয় চারিদিকে, সে কথা বলে শেষ করার মতো নয়। নাট্যকার বোধকরি ওইরকম এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নীরবে সরব চোখের ভাষার অর্থ-তাৎপর্য ও অভিলক্ষ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছেন।

এই কাব্যনাট্যে সারিবদ্ধভাবে পাত্রপাত্রী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে মাতবর, পীর সাহেব, মাতবরের মেয়ে, পাইক, গ্রামবাসী, তরুণদল এবং মুক্তিযোদ্ধাগণ। তারা সকলে নিজের নিজের সামাজিক অবস্থান থেকে বক্তব্য ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশে সরল, কুণ্ঠাহীন এবং অমিত সাহসী। চরিত্রগুলোর কথালাপ, বাকবিতণ্ড এবং বুঝ-অবুঝের ব্যাপারাদি নিয়ে কাহিনীর গতি অগ্রসর হয়েছে। বিষয়ের এবং কার্যকারণের অনিবার্যতা প্রকাশে লেখক অত্যন্ত কৌশল ও সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। গ্রামবাসী তাদের অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের জন্য তাদের মাতবরের কাছে উপস্থিত হয় দলে-বলে। গল্পটির সূচনা এখান থেকে। অতঃপর ধাপে ধাপে কিন্তু চমক সৃষ্টি করে বিদ্যুতের গতিতে এগিয়েছে শাখা-প্রশাখাসমেত গোটা কাহিনীবৃক্ষ। মুক্তিবাহিনীর ডাকে প্রেরণা লাভ করে সতের গ্রামের [কাহিনীতে বিবৃত] যুবা-বৃদ্ধ। ক্রমাগত যুদ্ধজয়ের আশার খবর শোনে তারা, পাকবাহিনীর পরাজয় এবং এক এক এলাকার মুক্ত হবার খবরও পায়। এতদিন তারা মাতবরের কথায় দেশবিরোধী (তখন তো দেশ ছিল পাকিস্তান) কাজে যোগ দেয়নি; কিন্তু আর তো থেমে থাকা চলে না- মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাতে চায় তারা। গ্রামবাসীর কথা: ‘আপনের হুকুম মতো এই সারা সতেরো গেরামে/ কোনোদিন কোনো ব্যাটা মুক্তিবাহিনীর নামে/ আসলেই খেদায়া দিছি যেমন ভিটায়/ খা-খা কাক ডাকলে দুপুর বেলায়/ লাঠি হাতে বৌ-ঝি খেদায়। ’ কিন্তু সময়ের প্রবাহে ও সংগ্রামের প্রয়োজনে এই উদ্বিগ্ন ও আশাবাদী গ্রামবাসীর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্টের শোষণের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ কায়েমের জন্য যুদ্ধের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন এবং সহযোগিতার বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে লেখকের বিবরণ ও শিল্পকৌশল অত্যন্ত সময়োপযোগী। বাঁচবার তাগিদে, চারিদিকের প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে অধিকার আদায়ের স্বাভাবিক ও সামান্য দাবিতে সর্বসাধারণের সোচ্চার হবার ব্যাপারাদির ওপর ভর করে এই কাহিনীর মূল ক্যানভাস নির্মিত হয়েছে। মাতবর এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা গ্রামবাসীকে বুঝানোর কিংবা ধমকে সামাল দেবার চেষ্টা করেছে। মাতবর আগত গ্রামবাসীর প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেশরক্ষায় আহ্বান জানায়: ‘কও দেখি, বিপদ কোথায় নাই?/ কোন কামে নাই?/ আর সকল কামের চেয়ে বড় কাম হইল দেশ রক্ষা করা। ’ গ্রামবাসী সাময়িক সংশয়েও হয়তো পড়ে খানিকটা- দেশরক্ষা, না-কি বিপ¬ব ও বিরোধীতা! অতঃপর তারা নিজে নিজ বিবেক আর বুদ্ধিকে সম্বল করে সঙ্কল্পে অটল থাকে। তারা শ্রেণীবিভেদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণের বিপক্ষে মানসিক অবস্থান নেয়; যুক্তির ওপর দাঁড় করায় নিজেদের অবস্থা ও অবস্থানের বিচারের ভার। সৈয়দ হক জানাচ্ছেন জেগে ওঠা মানুষের অনুভবের কথা: ‘বুঝি না আল্লার/ কুদরত কারে কয়, কারে কয় বিচার আচার। / যাদের জীবন হইল জন্তুর লাহান/ তারে কিছু দ্যাও নাই, দিয়াছো, অধিকার/ তারেই দিয়েছো তুমি দুনিয়ার ঈমান মাপার। ’

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানপন্থিদের বিশ্বাসে ও আস্থায় একসময় ফাটল ধরে; ভাঙনের শব্দ কানে আসে তাদের। চোখের সামনে দেখতে পায় মুক্তিকামী মানুষের জয়বারতার ইশারা। চারিদিকে স্বাধীনতার হাতছানি। নাট্যনির্মাতা ও কবি সৈয়দ শামসুল হক ওই শব্দের আওয়াজ তাঁর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় গ্রন্থে ধারণ করেছের শিল্পীর অনুভবের উদারতায়। পাত্রপাত্রীর সত্য-উপলব্ধির মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ করেছেন। নাটকে বিবৃত সমাজের অধিপতি ও সুবিধাভোগী-পাকিস্তানপন্থী মাতবর যেন শুনতে পায় ওই ভাঙনের আওয়াজ। মাতবরের চেতনার এই বিলোড়নকে নাট্যকার কথামালায় রূপ দিয়েছেন এভাবে: ‘একি! দূরে য্যান শব্দ শুনি যমুনার। / হঠাৎ ভাঙতে আছে খ্যাতের কিনার;/ স্রোতের আঙুল দিয়া খালি হাঁচড়ায়/ ভিটার তলের মাটি যমুনা সরায়। / সাবধান, সাবধান। নাকি ভুল শুনতে আছি?/ কি হয়? কোথায়?/ ও কিসের শব্দ শোনা যায়?/ চুপ করো, চুপ করো শুনতে দাও, শুনি। ...আওয়াজ কি পাই খালি আমি একলাই?’ সৈয়দ হক নাটকের এই মাতবরের উপলব্ধির ভেতর দিয়ে আধিপত্যবাদের পতনের শব্দ পাঠকের কানে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। জমে-ওঠা অন্যায়ের পাহাড়, অপরাধীর শক্তির তেজ কিভাবে ধ্বসে পড়ে, ক্ষয়ে যায়- তার সঠিক হিসাব ধীরে ধীরে আমাদের চেতনায় প্রবেশ করানোর এক শৈল্পিক প্রয়াসে নিয়োজিত থাকেন নাট্যকার। ঘটনার আড়ালের ঘটনা কিংবা ভেতরের রূপ বদলের প্রকৃত চেহারা ও সত্যটুকু আমরা যেন চিনতে ভুল না করি সে দিকে লেখকের নজর অত্যন্ত কড়া পাহারায় স্থির।

আমরা জানি, সমাজের চলমানতার একটা নিরেট বাস্তবতা আছে; আর যাপিত জীবনের সত্যাসত্যকে কখনও অস্বীকার করা চলে না। সৈয়দ হক এই নাটকে গ্রামবাসীর জবানীতে ওই বাস্তবতা ও সত্যকে হাজির করেছেন তাঁর পাঠকের সামনে: ‘খ্যাতে যে কিষাণ হাল দিয়া শস্য করে/ - শস্য না দুঃখের দানা ওঠে তার ঘরে। / গহীন গাঙে যে মাঝি জালে মাছ ধরে/ - মাছ না নিজের জান বড় জালে পড়ে/ ফলবৃক্ষ যে জননী বাচ্চা কোলে করে/ -বাচ্চা না মাটির দিয়া নিভা যায় ঘরে/ যে জোলা রঙিন সুতা দিয়া নকশা ধরে/ -নকশা না নিজের ভাইগ্য ভিজাচক্ষে পড়ে। ’ -এই কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে প্রবহমান যাদের জীবন, নানান বঞ্চনা আর অপমানে যাদের মন ও মর্যাদা নুয়ে পড়েছে, তারা যেন কালের স্বাক্ষী হয়ে প্রতিবাদের জন্য তৈরি করছে নিজেদের। কাব্যের সৌন্দর্যের অধিক যে বাস্তবতা তাকে ঘিরে তারা নির্মাণ করতে চায় নবজীবনের নতুন পথের সূচনাচিহ্ন। পীর-মাতবররা মিলে যে ইসলামি প্রতাজন্ত্র পাকিস্তানের শাসন পূর্ব-পাকিস্তানে বহাল রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তারা আশাও করেছিল যে কামান-বন্দুকের কাছে কৃষক-শ্রমিকের আন্দোলন হেলাফেলা মাত্র, তাদের বিশ্বাসে এক সময় ভাঙন ধরে। কল্পনা আর বাস্তব যে এক নয়, বড় প্রাণী হাতির মিছিলে ক্ষুদ্র প্রাণী আবাবিল পাখির লাখো ঢিলের বন্যার মতো লাখ লাখ মানুষের প্রতিবাদের ঝড় যে পাকিস্তানের সেনাদেরকে পর্যুদস্ত করতে পারে, তা সেদিন তারা অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই পাকিস্তানের তাবেদাররা নিজেদের ব্যক্তিত্ব-সম্মান-সম্ভ্রম সব হারিয়ে শেষতক জীবনের খেই হারিয়ে ফেলেছে। মুক্তিবাহিনীর জোয়ারে ভেসে গেছে তাদের সকল স্বপ্নতরী। রাজনীতি অঙ্গনের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই বিপুল জনতা যে রাজনৈতিক বিপ্লবে সাফল্য অর্জন করেছে, তা সারা দুনিয়ায় উদাহরণ হয়ে আছে আজও। আমরা স্বীকার করি আর না-ই করি, সকল মানুষের রয়েছে কল্পনা করার ও সৃষ্টি করার কিছু না কিছু শক্তি ও ক্ষমতা। আর তারই ওপর ভর করে নির্মিত হয়েছে আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার স্বপ্নসৌধ। - নাট্যকার এই জনশক্তির ব্যাপারটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তুলে ধরেছেন পুরো কাব্যনাট্যটির ক্যানভাসে। একথা তো ঠিক যে, খাকি পোশাকের পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে শহর-গ্রাম-জনপদ, সবজির বাগান, গরু ও গোলা ধ্বংস করে যে বিজয়ের বারতা ঘোষণা করতে চেয়েছিল, তা পারেনি জনতার সমবেত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ফলে।

আর, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের দোসর হিসেবে যারা কাজ করেছে, তাদের অনেককেও দিতে হয়েছে চরম মূল্য। অন্যের স্ত্রী-কন্যাকে তারা যেমন তুলে দিয়েছিল পাকসেনাদের হাতে, তাদের কন্যা-স্ত্রীর সম্ভ্রমও ছিনিয়ে নিয়েছে ওই পাকবাহিনি- যুদ্ধকালীন এই চরম বাস্তবতাকে আঁকতে ভুল করেননি সৈয়দ হক তাঁর বর্তমান নাটকে। কাহিনিতে দেখা যায়, মুক্তিবাহিনির বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের ছোবলে মাতবরের কন্যার সম্ভ্রম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাতবর রক্ষা করতে পারেনি তার নিজের ঘরের মর্যাদা। রাজনীতির ফাঁকা বুলি আর জনকল্যাণের জন্য পাকিস্তান বহাল রাখার তাবেদারিও তার পরিবারের সম্মানকে টিকিয়ে রাখতে বিন্দুমাত্র সহায়তা করেনি। মাতবরের কন্যা তার সুখ-সম্ভ্রম লুটের ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছে, সেই পাঠ নেওয়া যেতে পারে: ‘আমার কী আছে? গ্যাছে সুখ/ য্যান কেউ নিয়া গ্যাছে গাভীনের বাঁটে যতটুক/ দুধ আছে নিষ্ঠুর দোহন দিয়া। ’ অবশেষে স্বাধীনতা-প্রত্যাশি গ্রামবাসী সমবেত জনতার সামনে বিষপানে আত্মহত্মা করে মাতবরের কন্যা। মৃত্যুর আগে সে বাবার অপকর্মের বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে। জনতার কাতারে সামিল হয়ে সভ্যতার অগ্রগতির সত্যকে নিজের চেতনায় ধারণ করেছে। আর সবশেষে জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে ইচ্ছামৃত্যুর পথ!

সৈয়দ হক অসংখ্য উপমা-প্রতীক আর চিত্রকল্পের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তাঁর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নামক নাটকে। এইসব তুলনা-প্রতিতুলনা ও সাংকেতিক বিবরণে এবং কল্পচিত্রের আভাসে তাঁর সমাজমনস্কতা যেমন প্রতিভাত হয়, অন্যদিকে ব্যক্তির অভিজ্ঞতার সাথে সমষ্টির চিন্তা ও অর্জনের মিলিত প্রকাশও পাঠককে আকৃষ্ট করে। এখানে অন্তত তিনটি উদাহরণ টানা যেতে পারে: এক. ‘অন্যে করে ঠুকঠাক, কামারের একখান বাড়ি। ’; দুই. ‘চৈতের ঘুড্ডির মতো পাথারের মাথার উপরে/ যদিও এখনো সুতা হাতের ভিতরে,/ নাই, নাই, আর কিছু নাই। ’; তিন. ‘কুল নষ্ট মেয়েছেলে কুত্তাচাটা থালার সমান। ’

কাহিনীর শেষাংশে মঞ্চবর্ণনার ইঙ্গিতাশ্রয়ী একটি বাক্যে নাট্যকার লিখেছেন: ‘সবশেষে পতাকার ওপর আলো থাকে। ’ কাব্যনাট্যটিতে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামিল হওয়ার প্রেরণার পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মীয় শিক্ষার জড়তা আর অসহায়তার কথা বিবৃত হয়েছে। স্থান পেয়েছে অধিকার আর অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করার আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার প্রেরণার কথা। ঈশ্বরের অবস্থিতি সম্বন্ধে জনতার মনে সংশয়ের দোলার সত্যাসত্যের বিবরণেও নাট্যকার সমান সাহসী বলে মনে হয়েছে। সাধারণ মানুষের বিপদে দয়াময় ও রক্ষাকারী স্রষ্টার অনুপস্থিতি বিষয়ে জিজ্ঞাসাও হাজির করেছেন তিনি পাত্রপাত্রীদের সরল উপলব্ধি ও সংলাপের ভেতর দিয়ে। পাপের, অপরাধের আর অন্যায়ের অনিবার্য অবসানে ছবি আঁকতে গিয়ে ঐতিহ্যের শক্তির সহায়তা নিয়েছেন লেখক। সব কিছুকে ছাড়িয়ে মুক্তিবাহিনির বিজয়ের সম্ভাব্যতা ও সত্যতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি শিল্পীর কৌশলি তুলির আঁচড়ে। ধান্দাবাজ সমাজপতি কাঁচা-ঈমানে ভরকরা চাটুকার ও দালাল মাতবর যেন শুনতে পেয়েছে সমাগত বিজয়ী মুক্তিসেনানির পায়ের আওয়াজ! তার কানে ভেসে আসা আওয়াজটাই এখানে মুখ্য। সত্যিকার অর্থে, জাতির পতাকার শুভ সূচনা আর বেঁচেথাকা মানুষগুলোর স্বপ্ন-প্রত্যাশার ক্যানভাসে এই গল্পটি নির্মিত হয় এক ঘোরলাগা বিবরণের জোয়ারের ভেতর দিয়ে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।