ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নজরুলের ব্যতিক্রমী সৌন্দর্যচেতনা

জুনান নাশিত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১০
নজরুলের ব্যতিক্রমী সৌন্দর্যচেতনা

সর্বগ্রাসী প্রতিভা দিয়ে সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় হীরকদ্যুতি ছড়াচ্ছিলেন যখন রবীন্দ্রনাথ, সে সময়ে নজরুল এলেন ভিন্নপথের আলোর দিশারী হয়ে। তিনি এলেন এবং জয় করলেন।

রবীন্দ্রনাথের প্রবল প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে তৈরি করলেন নিজস্ব পথ, উন্মুক্ত করলেন গতিময় আলোর ফটক। অতি অল্পসময়ে জনপ্রিয়তার চূড়ায় অবস্থান নিলেন। জয় করলেন জনহৃদয়। ইংরেজ প্রভুর অধীনে থাকা পরাধীন ভারতবর্ষের যেখানেই যেভাবে ন্যায়ের ও সত্যের অবমাননা প্রত্য করেছেন, সেখানেই তিনি তার কাব্যহাতিয়ার নিয়ে গর্জে উঠেছেন। সব ধরনের অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। শব্দমালায় গ্রথিত করেছেন বিপ্লবের মহান রণভেরী। আর তাই জনমানসে অধিষ্ঠিত হলেন বিদ্রোহী কবিরূপে।

এই বিদ্রোহ-বিপ্লব তার কবিতার মূল সুর। কিন্তু তার বিদ্রোহের তেজোদীপ্ততা যতো সহজে পাঠকহৃদয়ে ঝড় তুলতে পেরেছে, প্রকৃতি-প্রেম-বিরহ নিয়ে ভাবলাবণ্যের মাধ্যমে তিনি কাব্যজগতে বিস্ময়ামুখী যে সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করেছেন, তা ততো সহজে পাঠকের হৃদয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করতে পারেনি। নজরুল আর বিদ্রোহ যেনো এক সমার্থক শব্দ। তার নামটি শোনামাত্রই বিদ্রোহের যে স্বরূপতা  আমরা প্রত্য করি তেমনটি করি না তার ব্যতিক্রমধারার মাধুর্যময় সৌন্দর্যদর্শন নিয়ে। পাঠকের এ সীমাবদ্ধতার পেছনে স্বাভাবিক-স্বভাবজ কিছু সমস্যা অবশ্যই রয়েছে।

সৌন্দর্যশাস্ত্রের প্রাচীন সংস্কৃত নাম বীক্ষাশাস্ত্র। বীক্ষণ মানে বিশেষরূপে দেখা। সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা যে জীবন ও জগতসংসারকে দেখি সে থেকে এ দেখায় ভিন্নতা আছে। বিশ্বপ্রকৃতি এবং মনুষ্যসমাজে এমন কিছু ঘটনা, এমনকিছুর অস্তিত্ব রয়েছে যার অন্তস্থলে আমাদের অনেকের প্রবেশই দুঃসাধ্য। মাত্র কিছুজনের মধ্যেই রয়েছে সেই বিশেষ দৃষ্টি যারা দৃশ্যমানতাকে তাদের কল্পলোকের সুধা আর ব্যাপ্তি দিয়ে নতুন কিছু সৃজন করতে সম হন। ভারতীয় ধারণায় মহাদেবের যে তৃতীয় নয়ন কল্পনা করা হয়েছে, শিল্পী কিংবা কবির রয়েছে সেই তৃতীয় নয়ন। ফলে সাধারণ লোক যা পারে না সৌন্দর্যসচেতন শিল্পীমনের মানুষমাত্রই সংসারের প্রাত্যহিকতা থেকে তৈরি করেন এক বিশেষ সৌন্দর্য। আর এ সৌন্দর্যকে উপলব্ধির জন্যে প্রয়োজন ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান। তবে শুধু ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান দ্বারাই উপলব্ধির বিশেষায়িত রূপ আমাদের চুর উন্মীলন ঘটায় না। ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে ‘বোধি’ নামক এক বিশেষ মানবিক গুণের। এ প্রসঙ্গে দার্শনিক ক্রোচের অভিপ্রায়ের কথাটি স্মরণীয়। তিনি শিল্পের যথার্থ অনুধাবনে ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞানের সঙ্গে বোধির সংমিশ্রণ ঘটানোর প্রয়াসী ছিলেন। আর শিল্প-সাহিত্য-কাব্যে এ বিষয়টির যথার্থ প্রতিফলন ঘটে  তার প্রকাশধর্মিতাকে কেন্দ্র করে।

কবি নজরুল সমকালের দাবি পূরণে উচ্চরবে বিপ্লবের ওংকারধ্বনি কবিতার পাঁজরে চিত্রিত করলেও ফাঁকে ফাঁকে  যে সুধাপূর্ণ মাধুর্য ঢেলে দিয়েছেন তা আজও অনেক পাঠককুলকে ভাবিত করে। সময়ের সীমা অতিক্রম করে তার শব্দের তুলিতে রাঙানো সাহিত্যসুন্দর এখনও যেমন পাঠকের নির্বিরোধ হৃদয়কে উৎকর্ণ করে, তেমনি ভবিষ্যতের পাঠককুলকেও কাছে টানবে নিঃসন্দেহে। কারণ নজরুলের ঔদার্য, তেজ ও মোহের মধ্যেই রয়েছে তার দাহন দীপ্তির অতুলনীয় সৌন্দর্য। তাই তিনি বলতে পেরেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য’।

‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কবি রাতারাতি বিখ্যাত হলেও কিছু নিন্দুক-সমালোচক এটিকে কবির পাগলামি হিসেবে বর্ণনা  করেছেন। একে তার উন্মাদগ্রস্ততার লণও বলেছেন কেউ কেউ। তবে সব কিছু ছাপিয়ে নজরুল ও তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি যেনো আজও সমার্থক। এই বিদ্রোহী কবিতাটি বীররস-প্রধান হলেও এখানে রয়েছে প্রেম ও বিরহরসের অপূর্ব সংমিশ্রণ। কবি তার পরবর্তী প্রচুর রচনাতেও এরকম একাধিক রসের সংম্রিশণে ছিলেন পারদর্শী। এ প্রোপটে ভারতীয় প-িতগণের সৌন্দর্যতত্ত্বে রসতত্ত্ব সম্পর্কিত ধারণার কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁরা বলেন, ‘রসই সৌন্দর্যের জীবন। বস্তুর সৌন্দর্য রসাত্মকতার উপর র্নিভর করে। বস্তু হইতে রস লইয়া যাও, বস্তুর সৌন্দর্য অন্তর্হিত হইবে। যে বস্তু যে পরিমাণে রসোদ্দীপনম, সেই বস্তু সেই পরিমাণে সুন্দর। ’ (অয়কুমার গুহ: সৌন্দর্যততত্ত্ব)।

সে দিক থেকে বলা যায় কবির বিদ্রোহী কবিতায় বহুমিশ্র রসের যে সঞ্চালন তাতে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব সৌন্দর্যআধার। কবিতাটি পাঠে উদ্দীপনার পাশাপাশি পাঠক সহজেই করুণ কাতর দোলায়ও আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তাদের হৃদয় দুঃখের, জ্বালার, বঞ্চনার, ক্ষোভের পাশাপাশি প্রেম বিরহের আর্তিতেও  হয়ে ওঠে সকরুণ:

আমি     বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি     ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
    আমি    উন্মন মন উদাসীর,
আমি    বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ
আমি হুতাশীর।
আমি     অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত-    চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ
কুমারীর!
আমি     গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক’রে দেখা অনুখন,
আমি     চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন চুড়ির কন্-কন্।

কবির কাব্যচর্চার একেবারে শেষের দিকে আধ্যাত্মিক ও যোগীজীবন তাকে আকৃষ্ট করেছে তখন বীররস, আদিরস প্রভৃতি ভক্তিরসে রুপান্তরিত হয়েছে। কবি শ্যামা মায়ের চরণাশ্রিত জবাকে সম্বোধন করে সাশ্র“নয়নে গেয়েছেন, ‘জবা তোর সাধনা আমায় শেখা, মোর জীবন হোক সফল। ’ কিংবা ইসলামী গানে গেয়েছেন:
আমার মনের মসজিদে দেয়
আজান হাজার মোয়াজ্জিন,
প্রাণের লওহে কোরাণ লেখা
রুহ পড়ে তা রাত্রিদিন।

আগেই বলেছি সৌন্দর্য অনেকখানি তার প্রকাশধর্মিতার ওপর নির্ভরশীল। ঋষিগণ বলেছেন, ‘জ্যের্তিময় আবরণ দ্বারা সত্যস্বরূপের মুখ আবৃত রহিয়াছে, হে জগতপোষক তাহা উন্মোচন কর। তোমার যে মধুর রূপ তাহা আমি সন্দর্শন করি। ’ (নন্দনতত্ত্বের সূত্র: অরুণ ভট্টাচার্য)। সুন্দরের সন্দর্শনে উন্মোচন অনিবার্য ব্যাপার। এই উন্মোচনের উপায় কৌশলে যিনি সফল তিনিই হতে পারেন আরিক অর্থে কবি কিংবা শিল্পী। যিনি পারেন না তার পে শিল্পী হয়ে ওঠা স্বপ্নের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। উন্মোচনের পথপরিক্রমায় দুটি বিষয় এসে সামনে দাঁড়ায়। সাহিত্যকেন্দ্রিক পরিভাষায় যাকে কাসিক ও রোমন্টিক নামে অভিহিত করা হয়। কাসিসিজম ও রোমান্টিসিজমের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য নিরূপণের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা থাকলেও কালে কালে উভয়ের মধ্যে নিগূঢ় সম্পর্ক স্থাপনেরও চেষ্টা চলেছে। কাসিসিজম ও রোমান্টিসিজমকে সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা কঠিন বিষয়। তবে উভয়ের ভাবলণে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে তা থেকে এদের চিহ্নিত করা যায়। কাসিসিজম বোঝায় বর্হিমুখিনতা, আর রোমান্টিসিজম অর্ন্তমুখিনতা। একটি বস্তুনিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেয়, অপরটি আত্মনিষ্ঠতা। প্রথমটি অনুভূতির ব্যাপারে নিস্পৃহ আর অপরটি এ ব্যাপারে আরোপ করেছে গভীর গুরুত্ব। `Classic art portrays the finite, Romantic art the infinite.’ কাসিক্যালরা ভাবনার অতিন্দ্রিয় জগতে বিচরণ না করে জগৎ ও জীবনকে বস্তুময়রূপে প্রকাশে আগ্রহী। অন্যদিকে রোমান্টিকরা জগৎ ও জীবনকে প্রকাশ করবার জন্যে ব্যঞ্জনা  ও আভাসের আশ্রয় নেন। অসীমের প্রতি সীমাহীন বিস্ময়বোধ রোমান্টিক ভাবনার মূলে কাজ করে। আর কাসিকধর্মিতায় থাকে বস্তুকে যে রূপে দেখা হয় সে রূপেই প্রকাশের আর্তি।

তবে প্রকৃতপে রোমান্টিসিজম ও কাসিসিজমে কোনো বিরোধ নেই। দার্শানক ক্রোচে উভয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলছেন,A great poet is both classic and romantic.’
কবি নজরুলের ক্ষেত্রেও কথাটি অনিবার্য সত্য। তিনি একাধারে কাসিক ও রোমান্টিক। তার কাব্যযাত্রায় দুটি ধারাই সমান্তরালগামী। তার যত বিপ্লব, বিদ্রোহ, প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি ও নারী চেতনা সবকিছুর মূলেই রয়েছে প্রবল রোমান্টিকতাবোধ। নজরুলের কবিতায় বিপ্লবের উত্তুঙ্গ প্রকাশ যতোখানি প্রেম, বিরহ ও অভিমানের গাঢ়তাও কোনো অংশে কম নয়। প্রেম মানবজীবনের মৌলিক ও অনিবার্য উপস্থিতি। প্রেম মানুষকে যেমন পূর্ণতার আলোকে সমুজ্জ্বল করে, তেমনি এর কারণেই মানুষ রিক্ততার অতলান্তে নিপ্তি হয়। প্রেমে আছে মিলনের মহামহিম আনন্দ। আবার উল্টোপিঠেই করুণ কষ্টের মর্মজ্বালা। নজরুল রোমান্টিকপ্রবণ বলেই তার কাব্যে প্রেমের আনন্দিত প্রকাশের চেয়ে বিরহবিলাসই প্রবল। তার কবিতা, গানে বিষন্ন বেদনার প্রকাশ লণীয়। বিশেষ করে  ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’ ও ‘বাঁধনহারা’ এ তিনটি রচনাতেই তিনি অপরিমেয় অভিমানী ও দুঃখবিলাসী। কারণ প্রেমের দীপশিখাটিকে প্রোজ্জ্বল করে রাখে বিরহ। সম্ভাবনার দূর মরীচিকায় আকাক্সক্ষার সলতেটাকে উস্কে রাখে দুঃখ। দার্শনিক শ্লেগেল বলেছেন, There is no bond of love without a separation, no enjoyment without the grief of losing it.’
তাই চিরঅভিমানী নজরুল চাঁদকে পাওয়ার প্রত্যাশায় ব্যাকুল সমুদ্রের দুঃখের সঙ্গে নিজের কষ্টকে মিলিয়ে উচ্চারণ করেন,
বাসনা-তরঙ্গে তব পড়ে ছায়া তব প্রেয়সীর,
ছায়া সে তরঙ্গে ভাঙে, হানে মায়া, ঊর্ধ্বে প্রিয়া স্থির!
ঘুচিলনা অনন্ত আড়াল,
তুমি কাঁদ আমি কাঁদি কাঁদে সাথে কাল!
কাঁদে গ্রীষ্ম কাঁদে বর্ষা বসন্ত ও শীত,
নিশিদিন শুনি বন্ধু ঐ এক ক্রন্দনের গীত,
নিখিল বিরহী কাঁদে সিন্ধু তব সাথে,
তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি কাঁদে প্রিয়া রাতে!
সেই অশ্রু-সেই নোনা জল
তব চঞ্চল হে বিরহী বন্ধু মোর-করে টলমল!
এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া
তুমি কাঁদ আমি কাঁদি কাঁদে মোর প্রিয়া।

নজরুলের কবিতায় যৌবনের জয়ডংকায় শব্দপ্রাণ অত্যন্ত সজীব। সেখানে ধ্বংসের উন্মাতাল দিক যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে আত্মসমর্পিত প্রেমিক হৃদয়ের সৃজন বেদনা:
হে মোর রানি! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার        বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
আমার        সমর-জয়ী অমর তরবারী
        দিনে দিনে কান্তি আনে, হয়ে ওঠে ভারী,
এখন-        এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি
নজরুল দুঃখ কষ্ট প্রেম বিরহ যাতনায় উদ্বেল হয়ে তার রচনায় যে সুন্দরকে সৃষ্টি করেছেন তাকে আরও মধুর ও লাবণ্যময় করেছে  তার প্রকৃতি বন্দনা। সব কবিই প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেন।   কিন্তু সমগ্র জীবনকে প্রকৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশের দুঃসাহস হয়তো ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো দু-চারজন কবিই দেখাতে পারেন। নজরুল সে অর্থে প্রকৃতির কনি নন। তবু  প্রকৃতিবন্দনার মধ্য দিয়েই তিনি প্রেমের উদ্দীপনা ও বিরহমালাকে গ্রথিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন।

 নজরুল প্রেম প্রকৃতি বিরহ বিদ্রোহে যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন তা সম্পূর্ণতই  অšতর্মুখী মননে দিনে দিনে চালিয়ে যাওয়া তার সৌন্দর্যসাধনার ফসল। তিনি কবিতায় অমরত্ব অপো সত্য ও সৌন্দর্য সন্ধানে অধিক ব্যাপৃত ছিলেন। তবে তিনি প্রচলিত পদ্ধতিতে সৌন্দর্য অন্বেষায় রত ছিলেন না। নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা এ ব্যাপারে তাকে চালিত করেছে ভিন্নপথে। ধ্র“বকুমার মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে হয়, ‘তিনি মূলত সামাজিক বৈষম্যের মধ্যে অসুন্দরকে প্রত্য করেন; সামাজিক বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার বিদূরিত হওয়ার মধ্যে কবিপ্রাণ যে সৌন্দর্যের জগত প্রত্য করেন তার সঙ্গে প্রচলিত সৌন্দর্যবোধের পার্থক্য ল্য করা যায়। মানবতার সর্বাঙ্গীন ও সর্বসংস্কার মুক্ত প্রকাশই নজরুলের সৌন্দর্যবোধের মূল কথা। ...সত্যপ্রিয়তা ও মানবতাবোধ তাঁর সৌন্দর্যদর্শনের দুটি দিক। ...বাংলা কবিতায় প্রচলিত সৌন্দর্যাবলীর চিত্র ললিত মধুর; নজরুল সেখানে পৌরুষের দীপ্ত স্বাতন্ত্র্যে সৌন্দর্যাভিসারের ক্ষেত্রে এক নতুন পরিম-ল রচনা করেন। ’ (নজরুল ইসলাম, কবি মানস ও কবিতা: ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়, পৃ. ১১৭)

ফরাসী দার্শনিক বার্গসঁ বলেছেন, দু প্রকারে আমাদের সত্যোপলব্ধি হয়ে থাকে-- জ্ঞান ও অনুভূতির সাহায্যে। জ্ঞানের দ্বারা যে সত্যোপলব্ধি তা মানুষের মনে বিস্ময় সৃষ্টি করে কিন্তু মানব মনকে তৃপ্ত করে না। সে তৃপ্তির জন্যে প্রয়োজন অন্যরকম সৌন্দর্যময় উপলব্ধির। সে উপলব্ধির উৎসধারা হলো শিল্প, সাহিত্য কিংবা সঙ্গীত। এখানে জ্ঞানের সঙ্গে হৃদয়ের উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতার বিচিত্র প্রকাশ ঘটে। যদি তা না হয় তবে সে সাহিত্য সমকালীনতাকে ছাড়িয়ে অসীমের পানে দৃষ্টি ফেলতে পারে না। নজরুলও যদি জ্ঞানের প্রত্য অভিজ্ঞতাকে হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ না করতেন তবে হয়তো কবেই হারিয়ে যেতেন। তিনি বাস্তবের রূঢ় সত্যকে চিরন্তন সুন্দরের সঙ্গে মেশাতে পেরেছেন বলেই তার কাব্য গান হয়ে উঠেছে সর্বাঙ্গসুন্দর।

 

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৪৩০, আগস্ট ২৬, ২০১০

সম্পাদনা : ফেরদৌস মাহমুদ, শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।