রোববার (২৪ মে) কাজী নজরুল ইসলামের ঢাকায় আগমনের ৪৮তম বার্ষিকী। পরিবার নিয়ে আমৃত্যু এখানেই ছিলেন তিনি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র আটদিন পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কাজী নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রাথমিক আমন্ত্রণ জানানো হয় ভারত সরকারকে। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসার সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এরপর পাঁচদিন পর স্বামীর পক্ষে জোহরা তাজউদ্দীন এ আমন্ত্রণপত্র কবির কাছে পৌঁছে দেন। জবাবে কবি পরিবারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়, শিগগিরই তিনি বাংলাদেশ সফরে আসবেন।
এর মাত্র দেড় মাস পরেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে যান ভারতে। অবস্থান করেন ১৯৭২ সালের ৬ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় পৌঁছেই বঙ্গবন্ধু কবির সুস্থতা কামনা করে তাকে দুইটি ফুলের তোড়া পাঠান। এরপরের দিন কবির দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ সস্ত্রীক রাজভবনে শেখ মুজিবুরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধু তার সরকারের পক্ষে নজরুলের পুত্রদের কাছে কবিকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দুই ভাই ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। এ সফরে তারা অসুস্থ কবিকে কীভাবে বাংলাদেশে আনা যায়, তা নিয়ে তারা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। কাজী নজরুলকে বাংলাদেশে আনতে কালক্ষেপণ করতে চাননি বঙ্গবন্ধু। ফলে কবিকে বাংলাদেশের আসার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের মধ্যে মার্চ ও এপ্রিল মাসজুড়ে চিঠি চালাচালি হয়। কবিকে ঢাকায় আনার জন্য কাজী সব্যসাচী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও আলোচনা করেন। সব কূটনৈতিক তৎপরতা শেষে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন কাজী নজরুল ইসলাম।
১৯৭২ সালের ২৫ মে মাসের কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, সেদিন সকালে কবির পুত্রবধূ তাকে গোসল করান। পরে সিল্কের নতুন পাঞ্জাবি ও ধুতি পরান। কবিকে খাইয়ে সোজা নিয়ে আসেন কলকাতা বিমানঘাঁটিতে। বিমানঘাঁটির নতুন আন্তর্জাতিক টার্মিনালে কবিকে বিদায় সংবর্ধনা জানাতে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধি, রাজ্য সরকারের লিয়াজোঁ অফিসার ও কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বিমানে কবির কোনো অসুবিধা না হলেও কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত কবি সম্পূর্ণ নীরব থাকেন।
ঢাকার চিত্র তখন উৎসবের মুখর। সকাল থেকেই কবিকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে ভিড় জমাতে শুরু করেন তার অনুরাগীরা। বিমানবন্দর ভবনের ছাদ ও রানওয়ের একাংশ সকাল ১০টার মধ্যে অসংখ্যক মানুষে ভরে যায়। যারা এসেছিলেন তাদের প্রায় সবার হাতেই ছিলো ফুলের মালা।
সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমান ঢাকা বিমানবন্দরের মাটি ছুঁয়ে যায়। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি কোরবান আলী কবিকে সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা জানান।
বিমানটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষমান জনতা গণবিদারী স্লোগানে স্বাগত জানান চির বিদ্রোহীকে। নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে বিমানের চারপাশে ঘিরে ধরে জনতা। ফলে কবিকে বিমানের ভেতর থেকে বাইরে আনাটা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। নিরাপত্তা পুলিশ ২০ মিনিট চেষ্টা করেও জনতাকে দূরে সরাতে পারেনি।
পরে কবিপুত্র কাজী সব্যসাচী জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, কবি অত্যন্ত অসুস্থ। আপনাদের খুশি করার জন্য তবুও আমরা তাকে বাংলাদেশে এনেছি। এরপর বিমানের দরজা থেকে নামানো হয় কবিকে। পরে তাকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। চোখের দেখা দেখতে না পাওয়া জনতা ভালোবাসার অর্ঘ্য হিসেবে অ্যাম্বুলেন্সের ওপর ফুল ছুঁড়তে থাকেন। সেখান তাকে সরাসরি ধানমন্ডিতে তার জন্যে নির্দিষ্ট বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানেও বিমানবন্দরের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। কবিকে এক নজর দেখতে বাড়ির সামনের আঙিনা, এক ফালি সবুজ লন, টানা বারান্দা সবখানেই ভিড় জমান অনুরাগীরা।
কবিকে ধানমন্ডির বাসভবনে নিয়ে আসার ঘণ্টাখানেক পরেই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাকে দেখতে আসেন। কবি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনি কবির শয্যার পাশে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে তিনি চলে যান।
যাওয়ার সময় বলেন, কবির ঢাকায় আগমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা চিরদিন স্মরণ করা হবে।
দুপুরে পর বিকেলে বঙ্গবন্ধু স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। বঙ্গবন্ধু সস্ত্রীক কবির কক্ষে ঢুকে তাকে শুয়ে থাকতে দেখেন। পরম শ্রদ্ধায় কবির মাথায় বঙ্গবন্ধু হাত রাখতেই তিনি চোখ মেলে তাকান মুজিবুরের দিকে।
আবেগতাড়িত কণ্ঠে তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি এসেছি। আমি মুজিব এসেছি। আমি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। ’
পর দিন দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কবির সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবৃত্তি করেন, তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এর পরে কবি ঘোলাটে চোখে কবি শুধু একবার তাকান শেখ মুজিবুরের দিকে।
ধানমন্ডির এই বাড়িতে কবি ছিলেন বছর তিনেক। প্রতিদিন তাকে সেখানে তাকে দেখতে ভিড় জমাতেন অসংখ্য মানুষ। দর্শনার্থীদের ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়তো প্রতিদিনই। সেখানেই অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৭৫ সালের ২৩ জুলাই কবিকে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (এখন যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে) ভর্তি করা হয়। সেখানকার ১১৭ নম্বর কেবিনে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। বছরখানেক পরেই সেখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মারা যান। এরপর তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে দাফন করা হয়। সেখানেই এখন কবির সমাধিসৌধ রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০২০
ডিএন/এএটি