সাতক্ষীরা থেকে ফিরে: যতদূর চোখ যায় ততদূর দেখা যায় ধূ-ধূ মাঠ। সবুজের ছোঁয়া নেই।
এই বিশাল আকাশ আর সূর্যের নিচে গড়ে উঠছে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মানুষের ঘরবসতি।
জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সর্বনাশা আইলার প্রায় তিন বছর পরেও এই করুণ দশা সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরাসহ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোর।
এসব গ্রামে ঘরবসতি গড়ে উঠলেও গ্রামবাসীর জীবনে আজও ফিরে আসেনি স্বাচ্ছন্দের বেঁচে থাকান। পুরো জনপদে এখনো চলছে জীবন ফেরানোর চেষ্টা।
উপকূলীয় এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আইলার তিন বছর পর এখানকার মানুষেরা ঘর তুলে বাস করতে পারলেও সব ঘরে দুবেলা খাবার নিশ্চিত হয়নি এখনো।
আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলোর সংস্কার কাজ এখনো চলছে। দীর্ঘদিন লোনা পানি ওঠানামা করায় জমিগুলো ফসল ফলানোর অনুপযোগী। আর এ কারণে বন ও সাগরের উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বেশীরভাগ পরিবার। এদের জীবনের নাম শুধূই বেঁচে থাকা। কোন বিলাসীতা নেই, শুধু দুবেলা খেয়ে পরে থাকার জন্য এরা কখনো লড়াই করছে বনের বাঘের সঙ্গে। কখনো নদীর কুমিরের সঙ্গে।
এখনো পানির সংকট তীব্র
আইলা আক্রান্ত এলাকায় এখনো চলছে তীব্র পানির সংকট। কয়েকটি এনজিওর সহায়তায় বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা হলেও তা পাওয়া সহজ নয়। অনেক দূর-দুরান্ত থেকে এসে পানি সংগ্রহ করতে হয়। তাছাড়া পুকুরগুলোতে এখনো লোনা পানি থাকায় তাদের কষ্টের অন্ত নেই।
গাবুরা গ্রামের আমিরুন্নেসা বলেন, ‘আইলার পর থেকে এখনো কোন দিন একটু মিষ্টি পানিতে গোসল করতি পারিনি। রান্না খাওয়াটা কোন রকমে এনজিও’র দেয়া পানিতে চালাই। কিন্তু মাপা পানিতি কি আর জীবন চলে?’
আমিরুন্নেসা বলেন, ‘আইলায় মেরে ফেললিও ভালো হতো, গত তিন বছর ধরে যে কষ্ট করে জীবন চালাচ্ছি তা কাউরে বোঝানো যাবেনা। ’
সারক্ষণ লোনা পানি ব্যবহারের কারণে চর্মরোগসহ বিভিন্ন অসুখও বেড়েছে বলে জানায় এলাকাবাসী। সোরা গ্রামের আমিনা বেগম বলেন, “আল্লাহ আরো কি কষ্ট করার জন্য বাঁচায় রেখেছে জানিনে। তবে দোয়া করি আল্লাহ, হয় তুমি আমারে তুলে নেও, না হলি এ আজাব থেকে মুক্তি দেও। ”
ভেটখালি গ্রামের রুহুল আমিন বলেন, এই কাটফাটা রোদে কাজ শেষে বাড়ি যেয়ে মাঝে মাঝেই খাবার পানি পাইনে। কয়েকদিন ভাত খাবার মাঝেখান্ইে পানি শেষ হয়ে গেছে। ,
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সবাই বলে ত্রাণ পেয়ে নাকি এ এলাকার মানুষ বড় লোক হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা কি ত্রাণ পাইছি ঘরে এসে দেখে যান। দু এক বেলা খাবার দিলি মানুষ যদি বড় লোক হত, তালি এ এলাকার সবাই আইলার পর থেকে বড়লোক।
“ত্রাণ যা আমাগো জন্যি পাঠানো হত, আমরা তা পালি তো বড় লোক হব। সবই যায় দলের লোকের হাতে। আমাগো খালি পেট খালিই থাকে,” অভিযোগ রুহুল আমিনের।
চকবারা গ্রামের আব্দুল হালিম বলেন, “আগে আমার খ্যাতে (ক্ষেতে) তরকারি হত। মাঠে ধান হত। আয় করতি ছেলেগো বনে যাতি হতনা। কিন্তু এখন আর কোন উপায় না দেখে আসার তিন ছেলেই বনে যায়। বনই আমাগো প্যাট চালায়। ”
বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার পর পাওবো বাঁধের উপর আশ্রয় নেওয়া অনেকে নিজেদের ভিটায় ফিরলেও এ ফেরা সবার জন্য নিশ্চিত হয়নি। এখনো শ’ খানেক পরিবার এসব বাঁধের উপর বাস করছে। ডুমুরিয়া গ্রামের মরিয়ম জানান, তাদের ভিটা মাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় আর কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই। তাই এ বাঁধের উপরই থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। নদীর জেগে ওঠা চরেও অনেককে বাস করতে দেখা যায়।
গৃহপালিত পশুশূণ্য এলাকা
আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো আজও গৃহপালিত পশুশূন্য বলা যায়। যে কটি আছে তাও অনাহারে আর রোগে ক্লিষ্ট।
এলাকাবাসী জানায়, এ এলাকায় গবাদিপশু নেই বললেই চলে। মাঠে ফসলাদি না হওয়ায় এসব এলাকায় ঘাসও জন্মে না। এ অবস্থায় এসব পালন সম্ভব নয়। তাছাড়া পোষার চেষ্টা করলেও নানা রকম অসুখে ভুগে সেগুলো কিছু দিন পর মারা যায়।
সোরা গ্রামের লায়লা বেগম জানান, তার এক গোয়াল গরু ছাগলের মধ্যে আইলার পর একটিও খুঁজে পাননি। বহু কষ্ট করে কিছুদিন আগে একটি ভেড়া কিনেছিলেন। কিন্তু ঘাস লাতা পাতার অভাবে খেতে দিতে পারতেন না। এর মাঝে একদিন নদীর পাড় থেকে আনা লোনা ঘাস খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ভেড়াটি।
পাতাখালি গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আগে এসব এলাকার সবাই গরু ছাগল, ভেড়া এসব পুষত, কিন্তু এখন নিজিরাই খাতি পায় না, এসব পুষবি কি করে। ’
সোরা গ্রামের হালিমা খাতুন বলেন, ‘হাস মুরগি পোষারই ক্ষমতা নেই আমাগো। সেখানে আবার ছাগল গরু পুষব কি করে। ’
চলছে জীবন ফেরানোর চেষ্টা
নানা সমস্যা আর অপ্রাপ্তির মাঝেও ক্ষতিগ্রস্তরা ধূধূ প্রান্তরে জীবন ফেরানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত। পড়ে থাকা জমিগুলোতে ধান না জন্মাক মাছ চাষের চেষ্টায় আছেন অনেকে। পাইপের সাহায্যে নদী থেকে পানি উঠিয়ে লোনা পানির মাছ করার ব্যবস্থা করছেন অনেকেই। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে লবনাক্ততা কমবে এমন আশা করে ফসল চাষেরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন কেউ কেউ।
গাবুরা গ্রামের ইব্রাহিম শেখ বলেন, ‘বর্ষাকালের আগে পুকুরের লোনা পানি সব বের করে দেবো। এরপর সেই পানি জমিয়ে চাষের চেষ্টা করে দেখব। যদি আল্লায় কিছু দেয়। ’
আইলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল হক বলেন, “এখানে মানুষের জীবন চলা খুবই কঠিন। তারপরও এখানকার সংগ্রামী মানুষেরা রাতদিন পরিশ্রম করে জীবন সাজানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। ”
সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা এখনো চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আগের থেকে পরিস্থিতি অনেক স্বাভাবিক হয়েছে। বাধসহ রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে। মানুষ ঘরে ফিরে এসেছে। ”
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. দৌলতুজ্জামান খান বাংলানিউজকে বলেন, “আইলার পর থেকে গত দুই বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারি বেসরকারি সাহায্য দিয়ে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে। বিশুদ্ধ খাবার পানি, বাসস্থানসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা পাচ্ছে এলাকাবাসী। সরকার সময়মতই করণীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ”
কিন্তু শুধু সরকার দিলেই হবে না। নিজেদের উন্নয়নে এলাকাবাসীকে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে, বলেন দৌলতুজ্জামান।
বাংলাদেশ সময় ২২০৮ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১২
জেপি/ সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ