ঢাকা: নতুন অনুমোদন পাওয়া নয়টি ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করলে ব্যাংকিং খাতে কেমন অবস্থার সৃষ্টি হবে, ব্যাংকঋণে সুদের উচ্চ হার, পূবালী ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি ব্যাংকিং খাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার।
তিনি ৩৫ বছর ধরে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করছেন।
সম্প্রতি রাজধানীর দিলকুশা বা/এ-তে পূবালী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হাফিজ মজুমদারের সাক্ষাৎকারটি নেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট তাহজিব হাসান।
বাংলানিউজ: সরকার নয়টি নতুন ব্যাংকের অনুমতি দিয়েছে। এগুলোর কার্যক্রম শুরু হলে ব্যাংকিং খাতে কেমন অবস্থার সৃষ্টি হবে?
হাফিজ মজুমদার: আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, এর ফলে ব্যাংকিং খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। এ মুহূর্তে ব্যাংকিং সেক্টর ভালো করছে। নতুন নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন এই সেক্টরকে অনেক বেশি প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দেবে। অধিক প্রতিযোগিতার মানেই হচ্ছে, সুদের হার বেড়ে যাওয়া। অর্থাৎ উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করা হবে। উচ্চ হারে ব্যাংকঋণ দেওয়া হবে। নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল না। নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক আপত্তি করেছিল। আমি রাজনীতি করি। আর নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক কারণও ছিল।
বাংলানিউজ: অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত নতুন ব্যাংক অনুমোদনের ব্যাপারে আগেই বলেছিলেন, রাজনৈতিক চাপ রয়েছে। নতুন ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। নতুন ব্যাংকগুলো কি গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতে পারবে?
হাফিজ মজুমদার: এখানে কিছু বিষয় আছে। নতুন ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে আসতে হবে। সেই টাকার উৎসও অবহিত করতে হবে। যা আমাদের করতে হয়নি। তারা কেমন করবে সেটা আগে থেকে বলা যাচ্ছে না। বাজারে এলেই বোঝা যাবে।
ব্যাংকিং বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো সেক্টর। ব্যাংকগুলো ভালো পারফর্ম করছে। ইউরোপের ব্যাংকগুলো একটার পর একটা ধসে পড়ছে। আমাদের কোনো ব্যাংক ধসে পড়লে সেটাকে সহযোগিতা করার ক্ষমতা সরকারের নেই। ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংক সঙ্কটের মধ্যে আছে। তাদের সহযোগিতা করার জন্য বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমাদের সহযোগিতা করার কে আছে? নতুন ব্যাংক বাজারে এলে সমস্যার সৃষ্টি হবে। বর্তমানে যেসব ব্যাংক ভালো করছে তারাও সমস্যার মধ্যে পড়বে।
বাংলানিউজ: এই ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কি?
হাফিজ মজুমদার: সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কাজ করা। কারণ সরকারে যারা রয়েছেন তারা বিভিন্ন সেক্টর থেকে এসেছেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের বাইরেও রাজনীতিকদের অনেক কিছু করতে হবে। তবে এর একটা সীমারেখা থাকা উচিত। নতুন ব্যাংকগুলোকে যেসব নিয়মের মধ্য দিয়ে আসতে বলা হয়েছে সেগুলো কঠোরভাবে মানতে হবে। আমাদের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী যে কাঠামো করেছে, এতে ব্যাংকিং সেক্টর অনেক ভালোভাবে কাজ করছে। যথাযথভাবে আইন-কানুন মেনে চললে কোনো ব্যাংক কলাপস করবে না। আমাদের ব্যাংকগুলো পশ্চিমা ব্যাংকগুলোর মতো জটিল নয়।
ব্যাংকিং ব্যবসায় পশ্চিমারা আমাদের মতো প্রাচীন পদ্ধতি অনুসরণ করে না। যেমন, তারা কোনো ব্রিজকে সিকিউরিটি ধরে ফাইনান্স করে দেয়। যা আমরা করি না। বিশ্বব্যাংক ঋণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এজন্য বিশ্বের অনেক বড়ো ব্যাংক ধসে পড়েছে। আমাদের ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি অনেক কম। আগের চেয়ে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণও অনেক শক্তিশালী।
![Hafiz Hafiz](../../../images/PhotoGallery/2012June/hafiz-0320120715115801.jpg)
বাংলানিউজ: ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের সুদ বেশি আবার ব্যাংক থেকে যে ঋণ দেওয়া হয় এর সুদও বেশি। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, ব্যাংকঋণে সুদের হার বিনিয়োগবান্ধব নয়। এই সম্পর্কে কিছু বলুন।
হাফিজ মজুমদার: এটা ঠিক, ব্যাংক ঋণের বর্তমান সুদের হার বিনিয়োগবান্ধব নয়। চলতি বছরের প্রথম দিকে সুদের হার অনেক বেড়ে গেছে। আমানতের উপর সুদের হার বেড়ে গেলেই ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে যায়। এ জন্য আমরা সবাই চিন্তিত। অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় আমাদের আমানত সংগ্রহের খরচ কম। কারণ পূবালী ব্যাংকের অনেক শাখা রয়েছে। এই জন্য আমরা কম খরচে আমানত পাই। তাই আমাদের আমানতের মোট খরচ কম। সেই জন্য কম সুদে লোন দিতে পারি।
কোনো গ্রাহককে চড়া সুদে ঋণ দিলে খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। ঋণগ্রহীতার পক্ষেও চড়া সুদ পরিশোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। কেউ ঋণ খেলাপি হলে ঋণগ্রহীতার চেয়ে ব্যাংককে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের মতো উন্নয়শীল দেশে ব্যাংক ঋণে সুদের হার কত হলে সেটা বিনিয়োগবান্ধব হবে?
হাফিজ মজুমদার: আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কের (সিঙ্গেল ডিজিট) হওয়া উচিত। ব্যাংক ঋণের সুদের হার যতো বেশি হবে বিনিয়োগ ততো কম হবে। আমি একা চাইলেও এই ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমাতে পারবো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তাগিদ ছিল এবং আমরাও চেয়েছিলাম ব্যাংক লোনের ক্ষেত্রে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে আসতে। তবে নানা কারণেই আমরা তা পারিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের যে আইন কানুন আছে তাতে বলা আছে, সঞ্চিত আমানতের ৮২ ভাগের বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। তবে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত মেনে নেওয়া হবে। অনেক ব্যাংকের এই হার ৮৫ ভাগের বেশি চলে যায়। এর জন্য ব্যাংকিং সেক্টর ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। এর কড়া নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
বাংলানিউজ: যদি বাংলাদেশ ব্যাংক একটা নির্দেশনা দেয় যে, নির্দিষ্ট হারের বেশি কেউ ব্যাংক ঋণের উপর সুদ দিতে পারবে না, এই রকম কোনো নিয়ম হলে সেটা কি যৌক্তিক হবে?
হাফিজ মজুমদার: এ রকম নির্দেশনা মুক্তবাজার অর্থনীতি সমর্থন করে না। এটি তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আমরা যদি এটা নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে দিই, তাহলে তা অর্থনীতির জন্য তা সুফল বয়ে আনবে না। এটাকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া উচিত।
দেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে যাচ্ছে। বেসরকারি খাতের আয় বাড়ছে, বড় হচ্ছে। তাই টাকার চাহিদাও বাড়ছে। চাহিদা অনুযায়ী টাকার যোগান কম।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশ ব্যাংক কি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলে?
হাফিজ মজুমদার: মানুষের ভুল হয়। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলবো, তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট ভালো। এই নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকিং খাতকে যথেষ্ট নিরাপদ রেখেছে। এটা আমাদের জন্য ভালো দিক। আমরা অন্যের টাকা নিয়ে ব্যবসা করি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে আমরা খুশি।
দেশের ব্যাংকিং সেবার মান দিন দিন বাড়ছে। মানুষ বহু রকম সুবিধা চায়। তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যাংকিং করতে চায়। ব্যাংকগুলো সময়ের সঙ্গে সেই চাহিদা পূরণও করে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতে অনেক সমস্যা হতো। এখন মুহূর্তের মধ্যেই দেশে পাঠানো যাচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং হচ্ছে। মানুষের ব্যাংকে আসার প্রয়োজন হয় না। বাসায় বসে ব্যাংকিং সেবা পেতে পারে। আগে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসত। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা উন্নতি করায় হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসা কমে গেছে।
বাংলানিউজ: দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলুন।
হাফিজ মজুমদার: দেশের প্রত্যেকটি ব্যাংক অনেক বেশি মুনাফা করছে। আমার মনে হয়, ব্যাংকগুলো একটু বেশিই মুনাফা করছে। পূবালী ব্যাংক গত অর্থবছর প্রায় ৬০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। চলতি অর্থবছরে আমরা টার্গেট নিয়েছি ৯০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফার। এই রকম অধিক মুনাফা শুধু পূবালী ব্যাংক নয়, সবক`টি ব্যাংকই করছে।
বাংলানিউজ: আপনার ব্যাংক কেমন করছে?
হাফিজ মজুমদার: আমরা পর্যাপ্ত আমানত পাচ্ছি। ব্যাংকঋণ দিচ্ছি। তাই বেশি মুনাফা হচ্ছে। গত বছর পূবালী ব্যাংকের আমানত ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা, এ বছর আমানতের লক্ষমাত্রা ১৮ হাজার কোটি টাকা। এটা শুধু পূবালী ব্যাংক নয়, সব ব্যাংকই একই রকম ভালো করছে।
অনেকে তারল্য সঙ্কটের (নগদ মুদ্রার সংকট) কথা বলে। যারা এসব কথা বলে, তারা সেটি মনে মনে তৈরি করে। যেভাবে তারল্য সঙ্কটের কথা বলা হয়, দেশে সেভাবে তারল্য সঙ্কট নেই।
বাংলানিউজ: পূবালী ব্যাংকের আধুনিকায়নে কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
![Pubali Pubali](../../../images/PhotoGallery/2012June/pubali20120715112759.jpg)
হাফিজ মজুমদার: সব কয়টি শাখাকে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে তিন শতাধিক শাখাকে কম্পিউটারাইজড করা হয়েছে। বাকিগুলোকে ডিসেম্বরের মধ্যেই কম্পিউটরাইজড করা হবে। অর্থাৎ অনলাইনে নিয়ে আসা হবে। এ জন্য আমরা নিজস্ব সফটওয়্যার তৈরি করেছি। দেশের মধ্যে একমাত্র পূবালী ব্যাংকই নিজস্ব সফটওয়্যার দিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। যেখানে অন্য ব্যাংকগুলো কেনা সফটওয়্যার ব্যবহার করে। আমাদের সফটওয়্যারের নির্ভুল ও দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য সব সময় পরীক্ষা করা হয়। কারণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে সফটওয়্যার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে কোনো ত্রুটি থাকলে বিরাট অংকের ক্ষতি হতে পারে।
বাংলানিউজ: পূবালী ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বলুন?
হাফিজ মজুমদার: আহ্সানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালকে পূবালী ব্যাংক এখন পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা, সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশনকে ছয় কোটি টাকা দিয়েছে। এছাড়া দেশে যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় সব ক্ষেত্রেই সহযোগিতা এবং আরও ছোট বড় অনেক ক্ষেত্রে সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করে থাকে।
বাংলানিউজ: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন।
হাফিজ মজুমদার: পূবালী ব্যাংকে ব্যাংকিং জগতের একটা আস্থার জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। সবাই জানে পূবালী ব্যাংক অ্যাগ্রেসিভ ব্যাংকিং করে না, কনজারভেটিভ ব্যাংকিং করে। আমরা কখনো ধার দেওয়া এবং নেওয়ার অনুপাত অতিক্রম করি না।
বাংলানিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ।
হাফিজ মজুমদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘন্টা, জুলাই ১৪, ২০১২
টিএইচ/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর[email protected]