কুমিল্লা থেকে : রসমালাইয়ের জন্য কুমিল্লার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু কোনটি কুমিল্লার আসল রসমালাই তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ক্রেতারা।
শহর ও আশেপাশের এলাকা ঘিরে গড়ে ওঠা ‘ভুয়া মাতৃভাণ্ডারে’র রসমালাই কিনে প্রতারিত হওয়া এখন নিত্যদিনের বিষয়। ভুয়া এসব দোকানের রসমালাই খেয়ে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী এ খাবারের প্রতি বিরূপ ধারণাও তৈরি হচ্ছে অনেকের।
কুমিল্লা শহরের প্রবেশ মুখে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে আলেখারচর, পদুয়ার বাজার, বিশ্বরোডসহ রাস্তার দু’পাশে এসব ভুয়া মাতৃভাণ্ডার ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে। মাতৃভাণ্ডারের নাম অবৈধভাবে ব্যবহারকারী এসব প্রতিষ্ঠান তাদের নামের আগে কিংবা পরে ছোট্ট একটি শব্দ ব্যবহার করে নিজেদের বৈধ করে নিয়েছে সুকৌশলে। ফলে প্রকৃত ‘মাতৃভাণ্ডার’ ভেবে সহজেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ‘আদি মাতৃভাণ্ডার, নিউ মাতৃভাণ্ডার, কুমিল্লা মাতৃভাণ্ডার, আদর্শ মাতৃভাণ্ডার, ময়নামতি মাতৃভাণ্ডার, প্রসিদ্ধ মাতৃভাণ্ডার, খাঁটি মাতৃভাণ্ডার, মাতৃভাণ্ডার প্রা. লি., মাতৃভাণ্ডার সুইটস, মাতৃভাণ্ডার কোম্পানি লি. ইত্যাদি অসংখ্য নামে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। প্রকৃত ‘মাতৃভাণ্ডারের’ কোন শাখা কিংবা অনুমোদিত বিক্রেতা না হওয়া সত্বেও তারা ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামটি ব্যবহার করে যাচ্ছে অনায়াসে। এ নিয়ে শহরবাসীরও রয়েছে প্রচুর অভিযোগ।
কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে রসমালাই বিক্রির প্রাচীন প্রতিষ্ঠান মাতৃভাণ্ডার অবস্থিত। মূলত ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামে রসমালাইয়ের প্রকৃত এ প্রতিষ্ঠানটির আগে-পরে কোন শব্দ যুক্ত নেই। তবুও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মাতৃভাণ্ডার নামটিকে পুঁজি করে নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ভুয়া মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই খেয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেককে পেটের পীড়াসহ মারাত্মক অনেক সমস্যায় পড়তেও দেখা গেছে।
নামধারী রসমালাই বিক্রির এসব প্রতিষ্ঠানে নিম্নমানের রসমালাই বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ অনেকেরই। রসমালাইয়ে প্রকৃত স্বাদ পাওয়া তো দুরের কথা, এসব রসমালাই খেয়ে উল্টো রসমালাইয়ের প্রতিই ভুল ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিষ্টির এক কারিগর বাংলানিউজকে জানান, “স্বাদ অনেকটা কমে যাওয়া স্বাভাবিক। এক টিন দুধ জাল দিয়ে যদি ৩০ থেকে ৩২ কেজি রসমালাই বানানো হয়। তাতে প্রকৃত রসমালাইয়ের স্বাদ কখনোই পাওয়া যাবে না। ”
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকৃত মাতৃভাণ্ডারে এক টিন দুধ জাল দিয়ে ১৪কেজি রসমালাই তৈরি করা হয়। পক্ষান্তরে ভুয়া বিক্রেতারা বেশি লাভের জন্য এক টিন দুধের সঙ্গে পানি ও ময়দা মিশিয়ে দ্বিগুণ রসমালাই তৈরি করেন। এছাড়াও তারা গরুর দুধের সঙ্গে পাউডার দুধ মেশান বলেও জানা যায়। ফলে রসমালাইয়ের স্বাদ পাওয়া তো থাক দূরের কথা, অনেক সময় এগুলো খেয়ে পেটের নানাবিধ সমস্যায় ভুগতে হয়।
এসব দোকানে আসল ‘মাতৃভাণ্ডার’ থেকে অনেক কমে রসমালাই পাওয়া যায় বলে জানা যায়। মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই এখন প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২শ ২০ টাকা করে। কিন্তু একই সময়ে ভুয়া এসব শোরুমে ১কেজি রসমালাই পাওয়া যায় ১শ ৫০ টাকা শুরু করে ২শ টাকার মধ্যেই।
এতো কমে কিভাবে রসমালাই বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে ভুয়া এক রসমালাই বিক্রেতা বাংলানিউজকে বলেন, “আমরা ক্রেতাদের সুবিধার্থে দাম কমিয়ে রাখছি। তবে পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ নেই। ”
মেসবাহ উদ্দিন নামে এক ক্রেতা বাংলানিউজকে অভিযোগ করে বলেন, “প্রথমদিন বলে বুঝতে পারিনি, এগুলো যে নকল মাতৃভাণ্ডার। তাই রসমালাই কিনে চরমভাবে ঠকতে হয়েছে। ৫ কেজি রসমালাইয়ের সবটুকুই ফেলে দিতে হয়েছে। ” এমন অভিযোগ করেছেন একাধিক ক্রেতা।
মাতৃভাণ্ডারের নকল এসব শোরুমের কোথাও কোথাও আবার লেখা আছে ‘আমাদের কোথাও কোন শাখা নেই। ’ কাউকে আবার নিজেদেরকে ‘আসল’ প্রমাণের জন্য নামের শুরুতে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত’ কিংবা ‘রেজিস্টার ট্রেড মার্ক’ অথবা ‘আমরাই আসল’ ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তবে প্রকৃত ‘মাতৃভাণ্ডারে’ এসব কিছুই ব্যবহার করা হয়নি।
মাতৃভাণ্ডার নাম ব্যবহার করে ‘কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডার’ নামে এক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সুমন বাংলানিউজকে জানান, “এটা কোনভাবেই ভুয়া হতে পারে না। জেলা প্রশাসন থেকে এ নামে দোকানের লাইসেন্স করে নেওয়া হয়েছে। ”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভুয়া এসব দোকানের রসমালাই তৈরি হয় শহরের কালিয়াজুরি, দারোগাবাড়ি, নিশ্চিন্তপুর, দুর্গাপুর, আলেখারচরের বিভিন্ন জায়গায়। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে মানহীন এসব রসমালাই কুমিল্লার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় নিজস্ব পরিবহনে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বলেও জানা যায়।
প্রকৃত ‘মাতৃভাণ্ডারে’র ব্যবস্থাপক অনুপম দাশ বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের নাম ব্যবহার করে অনেকেই ক্রেতাদের ধোকা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা নিম্নমানের রসমালাই বিক্রি করে মাতৃভাণ্ডারের সুনামও নষ্ট করছেন। তবে আমাদের কোথাও কোন শাখা নেই। সচেতনরা ঘুরে ফিরে আমাদের কাছ থেকেই রসমালাই নিয়ে যাচ্ছেন। ”
তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন মাতৃভাণ্ডারে প্রায় লাখ টাকার রসমালাই বিক্রি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও মাতৃভাণ্ডারে রসমালাই কিনতে ছুটে আসছেন ক্রেতারা। তবে কোন কোন দোকানী মাতৃভাণ্ডার থেকেও রসমালাই কিনে নিয়ে বিক্রি করছেন বলেও জানান তিনি।
‘মাতৃভাণ্ডরে’ দুধ সরবরাহকারী ফয়সাল বাংলানিউজকে জানান, “৫/৬ জন দুধ ব্যবসায়ী প্রতিদিন মাতৃভাণ্ডারে দুধ সরবরাহ করেন। প্রত্যেকেই ১০ থেকে ১৫ মণ করে দুধ দিয়ে থাকেন। সব মিলিয়ে প্রতিদিন ‘মাতৃভাণ্ডারে’ প্রায় ১শ কেজি দুধের রসমালাই তৈরি করা হয়। তবে শুক্রবারে এর চাহিদা আরো বেড়ে যায়। ”
তবে মাতৃভাণ্ডার নামধারী ভুয়া এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ অনেকেরই। এ অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা পুলিশ সুপার মোখলেছুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, “আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেন নি। অভিযোগ না এলে আমরা কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো?”
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৫ ঘন্টা, আগস্ট ২৬, ২০১২
এমএ/ এডিএ/সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর