ঢাকা : বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে রেলের আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আমলে নেয়নি রেলওয়ে কর্র্তৃপক্ষ। সরকারি নিয়ম-নীতি লংঘন করে প্রায় ১৬ কোটি টাকার অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও রেল কর্তৃপক্ষ এখনও নিশ্চুপ রয়েছে।
এদিকে ওই সময়ের অনিয়মের পক্ষে কমিটির কাছে সাফাই দিয়েছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক। যদিও তার বক্তব্য আমলে নেয়নি সংসদীয় কমিটি।
গত জুলাই মাসে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ রেলওয়ের মেইন লাইন সেকশনগুলোর পুর্নবাসন (পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল) প্রকল্পের ওপর মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের বিশেষ অডিট রিপোর্টে নিয়ে আলোচনা করে।
অডিটের সময়কাল হচ্ছে ২০০১-২০০২ থেকে ২০০৬-২০০৭ অর্থবছর। ওই অডিট রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ওই সময় রেলের যন্ত্রপাতি কেনায় ১৫ কোটি ৩৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৪৬ টাকার অনিয়ম হয়েছে।
সংসদীয় কমিটি মনে করছে, রেলের উন্নয়ন নয়, বরং টাকা লুটপাটের জন্যই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিলো। ওই অডিট রিপোর্ট যাচাই করে কমিটি দোষী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় ও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। এর মধ্যে কমিটি একাধিক বৈঠক করলেও মন্ত্রণালয় কি ব্যবস্থা নিয়েছে তা এখনো জানানো হয়নি।
এ বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগ ও রেলপথমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটি শাখা সূত্রে জানা গেছে, কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় কি ব্যবস্থা নিয়েছে, তা এখনও জানানো হয়নি।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া স্মারক, সংশ্লিষ্ট পিপির নির্দেশনাবলী ও একনেকের সুপারিশ উপেক্ষা করে সরকারের অর্থ আত্মাসাত করা হয়েছে। বিধি লংঘন করে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। প্রয়োজন না থাকলেও কেনা হয়েছে ব্যয়বহুল মেশিন।
ওই অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, ক্ষমতা বর্হিভূতভাবে পিপির মূল্য হারের চেয়ে বেশি মূল্যহারে স্টোন ব্যালাস্ট ও স্লিপার সরবরাহকারীদের চূড়ান্ত বিল পরিশোধ করায় সরকারের ১২ কোটি ১০ লাখ ৬৯ হাজার ৫৩৬ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
বিধি বর্হিভূতভাবে দরপত্র দিয়ে অহেতুক দু’টি আলট্রাসনিক রেলফ্রো ডিটেক্টর মেশিন কেনার ফলে সরকারের ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা লংঘন করে অস্বাভাবিক অধিক মূল্যে ইলাস্টিক রেলক্লিপ (ইআরসি) সংগ্রহ করায় সরকারের ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষমতা বর্হিভূতভাবে পিপির সংস্থানের চেয়ে ৪৩৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ অধিক ব্যয়ে জগলড ফিসপ্লেট সংগ্রহ করায় সরকারের ২৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।
একইভাবে পিপি মূল্য হারের ৮৯ দশমিক ১৭ শতাংশ অধিক মূল্যে ডগস্পাইক সংগ্রহ করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে ২৬ লাখ ৪২ হাজার ৯শ’ টাকা। এছাড়া অধিক মূল্যে দরপত্র গ্রহণ করে স্টোন ব্যালাস্ট সংগ্রহ করায় ৩৩ লাখ ৮১ হাজার টাকা এবং গাড়ির জ্বালানি ও মেরামত বাবদ ১৯ লাখ ২৬ হাজার ২শ’ টাকা অনিয়মিত খরচ হয়েছে।
ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, অডিট রিপোর্টের বিভিন্ন আপত্তি নিয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) আবু তাহের কেনাকাটার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তবে তা মেনে নেয়নি কমিটির সদস্যরা।
অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, অধিক মূল্যহারে স্টোন ব্যালাস্ট ও স্লিপার সরবরাহকারীদের চূড়ান্ত বিল পরিশোধ করায় সরকারের ১২ কোটি ১০ লাখ ৬৯ হাজার ৫৩৬ টাকা ক্ষতি প্রসঙ্গে রেলের মহাপরিচালক আবু তাহের ওই বৈঠকে বলেন, “অনুমোদিত মূল পিপিতে প্রতি ঘনফুট ব্যালাস্টের মূল্য ছিলো ৩৫ টাকা। কিন্তু পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ১৬টি চুক্তিপত্রের বিপরীতে ৩৯ টাকা থেকে প্রায় ৯০ টাকা সর্র্বনিম্ন দর মূল্যায়িত করে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হলেও এতে ব্যয় সার্বিভাবে মূল অনুমোদিত পিপির অর্থকে অতিক্রম হয়নি। সরকারের কোন আর্থিক ক্ষতি হয়নি। ”
বৈঠকের কার্যবিররণী থেকে জানা গেছে, ডিজির বক্তব্য অগ্রাহ্য করে কমিটির সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ বলেন, “নিরীক্ষা বিভাগের আপত্তি ও ব্যাখ্যা সঠিক। বার বার ক্ষমতা বর্হিভূতভাবে অনুমোদিত পিপির মূল্যহারের অধিক মূল্যে দরপত্র অনুমোদন করে প্রকল্পে বিপুল আর্থিক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। তাই আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার লক্ষ্যে অর্থ আদায় ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। ”
অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিধি বর্হিভূতভাবে দরপত্র আহবান করে অহেতুক দু’টি রেলফ্লো ডিটেক্টর মেশিন কেনা হয়েছে। ফলে সরকারের ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।
অডিট রিপোর্টে দেখা গেছে, সরকারি নির্দেশনা লংঘন করে অস্বাভাবিক বেশি মূল্যে ইলাস্টিক রেলক্লিপ (ইআরসি) সংগ্রহ করায় সরকারের ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা অপচয় হয়েছে- অডিট রিপোর্টে দেওয়া এ তথ্য জেনেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় সংসদীয় কমিটি।
পিপি সংস্থানের চেয়ে ৪৩৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ অধিক ব্যয়ে জগলড ফিসপ্লেট সংগ্রহ করা নিয়ে দেওয়া অডিট আপত্তিটি নিষ্পত্তির আবেদন জানান রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের।
এর পক্ষে সাফাই গেয়ে তিনি সংসদীয় কমিটিকে বলেন, “জগলড ফিসপ্লেট একটি অপ্রচলিত লৌহজাত পণ্য। আগে এর এককমূল্য কম থাকলেও ২০০১ সালের পর থেকে টাকার অবমূল্যায়ন ও পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় পণ্যটির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। প্রকল্পের কাজে ইচ্ছাকৃত কোন অনিয়ম করা হয়নি। ”
তবে মহাপরিচালকের এ বক্তব্য গ্রহণ করেনি সংসদীয় কমিটি।
কমিটির সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, “সংসদীয় কমিটি এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কমিটি রেলওয়েকে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করলেও কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা এখনো কমিটিকে জানানো হয়নি। ”
তিনি আরও বলেন, “প্রয়োজনে নতুন করে বিধিবিধান তৈরি করে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ”
বাংলাদেশ সময় : ১৬২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১২
এসএইচ/ সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর