ঢাকা: ‘কিশোরী-তরুণীদের উত্ত্যক্ত করার ক্ষেত্রে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা। এক সময় স্কুল-কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে অথবা চলার পথে অশ্লীল ভাষা ও গান পরিবেশন এবং অঙ্গভঙ্গি করাই ছিল ইভটিজিংয়ের প্রধান ধরন।
মাহমুদা একটি সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেন।
তিনি বলেন, ‘মোবাইল ফোনে অসহনীয় ভাষায় মেসেজে কথায় কথায় প্রেমের অফার দেওয়া এখনকার সময়ে একটি মেয়ের জন্য একটি সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তি আরও জ্বালা বাড়িয়েছে। ’
সস্তায় পাওয়া ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল সেটের কল্যাণে বখাটেদের বখাটেপনায় যোগ হয়েছে নতুন পদ্ধতি। অনুমতির তোয়াক্কা না করেই মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর অশ্লীল এসএমএস পাঠানোর প্রতিযোগিতা তো আছেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ণ ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞানের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী আয়েশা আফরিনের রাখঢাকহীন অভিযোগÑ ‘কোনো মোবাইল অপারেটর কোম্পানির কাছে অভিযোগ করে কেউ উপকার পেয়েছে এমন খবর এখনও শুনিনি। আমি নিজেও প্রতিকার চেয়ে পাইনি। হয়তো এতে তাদের গ্রাহক কমে যেতে পারে এটাই কারণ। ’
‘বরং এ ইভটিজিং এখন মোবাইল ফোন কোম্পানির জন্য বাড়তি আয়ের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করলেন আয়েশা। ‘অভিযোগ করলেই বলে, আমদের জন্যই নাকি তারা কল ব্লক সার্ভিস চালু করেছেন। ...সমাজের প্রতি কতো দায়িত্বশীল! ...পাবলিকের পয়সাও নিলো, কাস্টমারও ছুটলো না। ’ ক্ষোভমিশ্রিত উক্তি আয়েশার।
তার কথার সমর্থন এলো পাশে বসা মনা, তিথি, পূর্বা, অদিতিসহ আরও কয়েক ছাত্রীর ভাষা আর ভঙ্গিতে।
ক্ষোভ তার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিও। তার মতে, ‘এরা আরও বড় উত্ত্যক্তকারী’।
বললেন, ‘গত আগস্টে রমনা থানায় ফোন করে কয়েকবার অশ্লীল এসএমএস (ক্ষুদেবার্তা) পাওয়ার কথা জানাই। তারা আমাকে এসএমএসটি দেখানোর জন্য থানায় যেতে বলে। থানায় গিয়ে এক এসআইকে এসএমএসটি দেখানোর পর সে এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন সে খুব মজা পেয়েছে। তার সেই তাকানোর কথা মনে পড়লে এখনও ঘৃণা জেগে ওঠে। ভাবি, কোন দেশে জন্মালাম!’
হয়রানির ভয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তার নাম বলতে চাইলেন না আয়েশা।
এখনকার যোগাযোগের অন্যতম সহজ ও দ্রুত মাধ্যম ইমেইল। অথচ মেয়েদের ইমেইল অ্যাড্রেস নিয়ে এক শ্রেণীর বখাটে কতো কিছুই না করছে। আলতু ফালতু মেসেজ ছাড়াও অশ্লীল ছবি পাঠিয়ে হরদম উত্ত্যক্ত করে যাচ্ছে মেয়েদের। এমনকি সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক বলে পরিচিত ফেইসবুকও এখন নিরাপদ নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের ৩য় বর্ষের আরেক ছাত্রী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন ‘এই প্রযুক্তির যুগে টিজিংয়ের মাত্রা অসহনীয় জায়গায় পৌছেছে। ফেইসবুকে বারবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো, ওয়ালে বাজে কমেন্ট করা, বিভিন্ন ছবিতে ট্যাগ করা ইভ টিজিংয়ের অংশ। ’
তবে এসব নতুন মাত্রার কারণে হারিয়ে যায়নি পুরনোগুলো। বাস, ট্রেনসহ বিভিন্ন পরিবহন, টাকার গায়ে, পাবলিক টয়লেট, বাড়ির দেয়ালসহ পাবলিক প্লেসগুলোতে মেয়েদের নাম ও ফোন নম্বর প্রচার করার রেওয়াজ এখনও পালন করে আসছে উত্ত্যক্তকারীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের ৩য় বর্ষের আরেক ছাত্রী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি থাকি শামসুন্নাহার হলে। কিছুদিন আগেও সন্ধ্যায় কাজ সেরে হলে ফিরতে পারতাম। এখন এটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। একা তো দূরে, দুইটা মেয়েও এক সঙ্গে চলাফেরা করতে পারে না। ’
ক্যাম্পাসে কারা টিজ করে জানতে চাইলে তারা সোজাসাপ্টা এক থার জবাব ছিল ‘যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা। ’
কিছুক্ষণ থেমে যোগ করলেন, ‘নিজে তো কিছু বলতে পারি না। নালিশ দেওয়ারও লোক পাই না। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বলেন আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই বলেন, ওই ছেলেদের কিছু বলার ক্ষমতা কারও নেই। ’
পেশাগত কারণে প্রতিদিন মিরপুর থেকে কারওয়ানবাজারে আসতে হয় নিধাকে।
নিধা বাংলানিউজকে বললেন, ‘বাসে দাঁড়িয়ে থাকতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষগুলো সভ্য না। অযথা হয়তো কনুই দিয়ে গুঁতো দেবে, নয়তো গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়াবে। কিছু বললেই শুনতে হয় গা-জ্বলা জবাব এতোই যদি আত্মসম্মানে লাগে, প্রাইভেট কার কিনে নিলেই তো পারেন। ’
নিধা আরও বলেন, ‘বাসের হেল্পাররাও কম যায় না। সেবা দেওয়া না উত্ত্যক্ত করা কোনটার জন্য তারা এ পেশায় এসেছে বোঝাই দায়। অহেতুক গায়ে হাত দেবে, ওঠা-নামার সময় পিঠে হাত দেবে। ’
শান্তিনগরের মুনিয়ার যতো রাগ মোটরসাইকেল আর গাড়িচালকদের ওপর।
বললেন, ‘মেয়েদের শরীর ঘেঁষে মোটরসাইকেল চালানো, হর্ন বাজানো আর আলো ফেলার ঘটনা তো হরহামেশাই দেখি। গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে, জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিয়ে শিষ দেওয়া বা বাজে মন্তব্য করাটাও অব্যাজত রয়েছে। ’
এমন হাজারো অভিযোগ চারদিকে। এনালগ ইভটিজিংয়ের পাশাপাশি ডিজিটাল ইভটিজিংয়েরও জোয়ার বইছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের কারণে বন্ধ করা যাচ্ছে না এ অসভ্য অপকর্মটি। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের আইন ও আইন প্রয়োগের দুর্বলতাও অনেকটা দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরবর্তী পর্বে পড়ুন: ইভটিজিংরোধে দরকার কঠোর আইন
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, ৩০ অক্টোবর, ২০১০