ঢাকা: মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার (ইভটিজিং) বিরুদ্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই বলেই বারবার বেপরোয়া হয়ে উঠতে সাহস পাচ্ছে বখাটেরা। প্রতিনিয়ত তাই বিপাদপন্ন হচ্ছে কিশোরী-তরুণীরা।
তাদের মতে, ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বহিনীর দুর্বল অবস্থানের কারণে সম্প্রতি এর সঙ্গে অতিমাত্রায় বেড়েছে বখাটেদের হামলায় পরিবারের সদস্য বা শুভাকাঙ্ক্ষী মৃত্যুর ঘটনা।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিনের বাংলানিউজকে বললেন, ‘এ বিষয়ে আইন আছে ঠিকই। কিন্তু আইনের প্রয়োগ কতোটুকু হয় তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ’
যোগ করলেন, ‘...আর আইনের কোনও প্রয়োগ নেই বলেই বখাটেরা বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। যদি দেখা যেতো, কোনও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে তবেই হয়তো অন্যরা সাবধান হতো। ’
ইভটিজিং অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাই এর জন্য দায়ী। সম্প্রতি আমাদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয় হয়েছে। পাঠ্যসূচিতে ইভটিজিংয়ের কুফল নিয়ে অন্তত একটি অধ্যায় থাকা উচিত ছিল। কিশোর বয়সে ছেলেদের এ বিষয়ে জানানো গেলে তরুণ বয়সে হয়তো তাদের অপরাধের মাত্রা অনেকখানি কমে যেতো। ’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মানবাধিকারকর্মী বাংলানিউজকে বলেন, ‘ইভটিজিং প্রতিরোধে আইন কিছুই করতে পারছে না। মেয়েদের আত্মহত্যার পেছনে আইনের এ ব্যর্থতাই বেশি দায়ী। সহ্য করতে না পেরে মেয়েরা আত্মহত্যা করছে। অথচ অসমর্থনযোগ্য এ আত্মহত্যার ঘটনাগুলোও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সত্যিকারের তৎপর করতে পারে না। এ কারণেই সমাজের এ ব্যধিটি মহামারী আকার ধারণ করেছে। ’
ইভটিজিং বন্ধে করণীয় প্রসঙ্গে সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি বাংলানিউজকে বলেন, ‘খুবই কঠোর ও কঠিন আইন করা দরকার। এ আইন কার্যকর করতে হবে খুব দ্রুততম সময়ে, বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর আইন নেই বলেই আয়া থেকে আইনজীবী সবাইকে ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়।
এখনও শুধু কান ধরে উঠবস করানোই বখাটেদের শাস্তি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই শাস্তি দিয়ে কোনভাবেই তাদের ঠেকানো যাবে না। ’
ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি বলেন, ‘বখাটেদের উৎসাহিত করতে আমি নাটক, বিজ্ঞাপন ও সিনেমা নির্মাতাদেরও দোষ দেবো। আমরা এসব গণমাধ্যমে স্কুল-কলেজের সামনে বখাটেদের দাঁড়িয়ে থাকা দেখি। এছাড়া মোটরসাইকেল নিয়ে দল বেঁধে গান গাইতে গাইতে রিকশারোহী নায়িকাকে বিরক্ত করার দৃশ্যও দেখি অহরহ। বেশির ভাগ সময় নায়করাই থাকে ইভটিজার, কখনও কখনও ভিলেনও। তরুণরা এসব দেখে উৎসাহ পায়। ’
আইনপ্রণেতারা খুব শিগগিরই এ বিষয়ে একটি আইন পাস করবেন বলে আশা করে তিনি বলেন, ‘নতুবা আমরা আমাদের বোন কিংবা মেয়েদের বখাটেদের হাত থেকে বাঁচাতে পারবো না। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং তথ্য কমিশনের সদস্য ড. সাদেকা হালিম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ইভটিজিং প্রতিরোধে শুধু আইন করে কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা। ’
তিনি আরও বলেন, ‘বখাটেরা কেন এমন করছে তাও আমাদের জানতে হবে। ’
তিনি মনে করেন, বেকারত্ব, দারিদ্র্যসহ আরও কিছু আর্থ-সামাজিক সমস্যাই বখাটে সৃষ্টির মূল কারণ। চাকরি না পাওয়া, খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় চায়ের দোকানে বা রাস্তার মোড়ে আড্ডা দেওয়া ছাড়া তাদের কিছু করার থাকে না। স্বাভাবিকভাবেই তাদের অলস মস্তিষ্কে ভালো কিছু আসে না। তখন মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাকেই তারা বিনোদন হিসেবে নেয়।
সাদেকা হালিম আরও বলেন, ‘এখন বিশ্বায়নের যুগে ইন্টারনেট এবং সাইবার ক্যাফের সহজলভ্যতাও টিজিংয়ের অন্যতম কারণ। এরা নিষিদ্ধ জিনিসকে সাদরে গ্রহণ করছে। নারীকে নারী ভাবছে, পণ্য ভাবছে, মানুষ ভাবছে না। নানা কারণে আমাদের তরুণদের চরম অবক্ষয় হয়েছে। ’
তিনি বলেন, ‘সচেতনতার পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এলাকার জনপ্রতিনিধি এবং গন্যমান্য ব্যক্তিদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মী বলে তার জন্য কোনও ধরনের সুপারিশ করা চলবে না। ’
উত্ত্যক্তকারীদের জন্য এমন সাজা দরকার যেন একজনের সাজা দেখে অন্যরা দশবার ভাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একজন উত্ত্যক্তকারী হয়তো জেলে গেল। কিন্তু সে তো কিছুদিন পরই বের হয়ে আসছে। জেল খাটলেই যে সংশোধন হয়ে যাবে তা ভাবা একদম ঠিক না। লঘু সাজায় এখন আর কাজ হবে না। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, ০১ নভেম্বর, ২০১০