ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী অনন্যা (ছদ্মনাম)। ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠার পর থেকে প্রতিদিন একাই স্কুলে যায়।
অনন্যার মতো কেউ কেউ বখাটেদের বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেলেও দেশের অধিকাংশ কিশোরী বা তরুণী এ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে বেছে নিয়েছে আত্মহত্যার পথ। অথচ কয়েক বছর আগেও আমাদের দেশের অনেকেই ইভ টিজিং সম্পর্কে খুব কমই জানতেন। কিন্তু দিন দিন এর প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিরোধে তৎপর হয়ে উঠেছে সরকার ও সামাজিক সংগঠনগুলো। এটি বর্তমান সময়ে একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। ইভ টিজিংকে কেন্দ্র করে এখন দেশের তরুণীদের মাঝে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। শুধু শহরেই নয়, গ্রামের অনেক অভিভাবকই এখন মেয়েকে একা স্কুলে যেতে বা ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। কারণ পথে-ঘাটে, স্কুল-কলেজে অর্থাৎ ঘর থেকে বের হওয়ার পরই শুরু হয় ইভ টিজিংয়ের বিড়ম্বনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্রী সিমির আত্মহত্যা থেকে শুরু করে এর প্রবণতা চলছেই।
ইভ টিজিং কী?
কিশোরী বা তরুণীদের প্রতি অশালীন মন্তব্য করা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করা আমাদের সমাজে ইভ টিজিং নামে পরিচিত। সাধারণত পথে-ঘাটে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে এক শ্রেণীর বখাটে ছেলে মেয়েদের লক্ষ করে বিভিন্ন রকম অশালীন মন্তব্য করে। কখনো কখনো এটি কেবল মানসিক নয়, শারীরিক নির্যাতনেও রূপ নেয়। গ্রামের তুলনায় শহর অঞ্চলে এর প্রভাব বেশি।
কারা করছে?
ইভ টিজিংকারীদের মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বখাটের সংখ্যাই বেশি। তবে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরাও এখন ইভ টিজিংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। তারা বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয় বা কলেজের সামনে অবস্থান করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসার পথে এবং ছুটির পর বাসায় যাওয়ার পথে তরুণীদের উত্যক্ত করে। শুধু উত্যক্ত করাই শেষ কথা নয়, কখনো তারা শরীরে পর্যন্ত হাত তোলে। এটি কখনো কখনো এমন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় যে, কোনো কোনো মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। রাজধানীর মনিপুর এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, ছুটির আগে ও পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসংলগ্ন বিভিন্ন ছোট ছোট দোকানে জমে উঠে বখাটেদের আড্ডা। ওসব দোকানিরাও বখাটে বলে তিনি দাবি করেন। একই সঙ্গে তিনি স্কুল, কলেজের পাশের ছোট ছোট দোকানগুলো উচ্ছেদের দাবি জানান।
যেভাবে চলছে?
অশালীন উক্তির মধ্যেই এখন আর ইভ টিজিং সীমাবদ্ধ নয়। অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, পর্নোগ্রাফি প্রদর্শন, চিঠি, ই-মেইল, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল, নোটিশ বোর্ড, টেলিফোন, এসএমএস, পোস্টার, নোটিশ, দেয়াল লিখনের মাধ্যমে এখন চলছে ইভটিজিং। এর মাধ্যমে অনেকে মেয়েদের প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে। আর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে মেয়েরা শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হচ্ছে।
চলছে প্রতিরোধ
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে ইভ টিজিং বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। সন্ত্রাসীদের উৎপাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকজন মেয়ে আত্মহত্যা করার পর সব শ্রেণীর মানুষের কাছে এখন ইভ টিজিং খুব পরিচিত একটি শব্দ। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ইভ টিজিং প্রতিরোধে এখন চলছে জোর আলোচনা। গ্রহণ করা হচ্ছে নানা উদ্যোগ। এর প্রতিরোধে বখাটেদের আটক করতে কাজ শুরু করেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুলিশের উদ্যোগে চলছে ইভ টিজিং প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের করণীয় বিষয়ে সচেতনতা।
বাড়ছে দুর্ঘটনা
বখাটে যুবক মুরাদের উৎপাতে এ বছরের ১৯ জানুয়ারি আত্মহত্যা করে শ্যামলীর আইডিয়াল টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্রী নাফফিয়া আপন পিংকী। পিংকীর আত্মহত্যার কদিন পরেই বখাটেদের উৎপাতে আত্মহত্যা করে রামপুরার দণি বনশ্রী মডেল হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ইলোরা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় ব্যবসায়ী মামুন হাওলাদারকে পিটিয়ে হত্যা করে বখাটেরা। একটি পত্রিকার হিসাবে, গত ৩ বছরে ইভ টিজিং এর কারণে প্রাণ দিয়েছে ৩২ জন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে নয় জন, ২০০৯ সালে আট জন এবং ২০১০ সালে ১১ জন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছে ১১ কিশোরী এবং আত্মহত্যা করেছে ৩ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে শিকার হয়েছে ৭ জন ও আত্মহত্যা করেছে ১ জন। মার্চ মাসে এ সংখ্যা ১১ জন এবং মারা গেছে ৩ জন। এপ্রিলে আত্মহত্যা করেছে ৪ কিশোরী। এখানেই শেষ নয়। ২৬ অক্টোবর ফরিদপুরের মধুখালীতে মেয়ের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করে বখাটের হাতে নির্মমভাবে খুন হলেন চাঁপারানী ভৌমিক (৪৮) নামের এক মা। এর আগে ১২ অক্টোবর দুপুরে নাটোরে বখাটে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় খুন হন শিক্ষক মিজানুর রহমান।
সরকারি উদ্যোগ
ইভ টিজিং নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। সম্প্রতি পুলিশের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি ইভ টিজিং দমনে পুলিশকে আরও বেশি তৎপর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি নির্দেশনাও স্বরাষ্ট্রসচিব বরাবরে পাঠানো হয়। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ছাত্রীদের ওপর নিপীড়ন রোধ করতে আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সরকার। এছাড়া দেশের কিছু স্কুল ও কলেজের জন্য একজন করে পুলিশকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যার কাছে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিযোগ জানাতে পারবে। এদিকে ইভ টিজিং রোধে সব জেলা প্রশাসনকে তৎপর থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
করণীয়
ইভ টিজিং একদিনে বন্ধ হবে না। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সাথে সাথে জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। একটি মেয়ে যখন ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়, তখন তার পাশে পরিবারের সহায়ক ভূমিকা না থাকলেই অনেক সময় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি ইভ টিজিং এর শিকার তরুণীকেও যতটুকু সম্ভব বখাটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
আইন যা বলে
রাষ্ট্রীয় আইনে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ১০ ধারাতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৩ সালের সংশোধনীতে বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩-এ পূর্বোলেখিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ১০ ধারার পরিবর্তে নিম্নরূপ ১০ ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিস্থাপিত ১০ ধারা
যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশে তাহার শরীরের যে কোনো অঙ্গ বা কোনো বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করেন তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন তিন বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডে ও দন্ডনীয় হইবেন।
দন্ডবিধির ৫০৯ ধারা
*যে ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করিবার অভিপ্রায়ে এই উদ্দেশ্যে কোনো মন্তব্য করে, কোনো শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে বা কোনো বস্তু প্রদর্শন করে যে উক্ত নারী অনুরূপ মন্তব্য বা শব্দ শুনিতে পায় অথবা অনুরূপ অঙ্গভঙ্গি বা বস্তু দেখিতে পায়, কিংবা উক্ত নারীর নির্জনবাসে অনধিকার প্রবেশ করে, সেই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদন্ডে যাহার মেয়াদ এক বৎসর পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদন্ডে বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হইবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর ৭৬ ধারা
যদি কেহ কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বা সেখান হইতে দৃষ্টিগোচরে স্বেচ্ছায় এবং অশালীনভাবে নিজ দেহ এমনভাবে প্রদর্শন করে যাহা কোনো গৃহ বা দালানের ভিতর হইতে হউক বা না হউক, কোনো মহিলা দেখিতে পায়, অথবা স্বেচ্ছায় কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোনো মহিলাকে পীড়ন করে বা তাহার পথ রোধ করে, অথবা কোনো রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে অশালীন ভাষা ব্যবহার করিয়া অশীল আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করিয়া কোনো মহিলাকে অপমান বা বিরক্ত করে, তবে সেই ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদন্ড অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয়দন্ডে দন্ডনীয় হইবে।
বাংলাদেশ সময় ১৬৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১০