ঢাকা: মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে থার্ড পার্টি হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় বাধা। তাদের কারণে দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানি পড়তে পারে বিরাট হুমকির মুখে।
সোমবার দুপুরে মতিঝিল ফেডারেশন ভবনে বায়রা সভাপতি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এবং চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজুকে এক একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। সঙ্গে ছিলেন চিফ ফটো করেসপন্ডেন্ট জীবন আমীর।
সাক্ষাৎকারে তিনি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, শ্রমবাজারের সংকট, সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে বলেছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা। সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য।
বায়রা সভাপতি শাহ জালাল মজুমদার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চলে যেতে পারে অন্য কোনো দেশের হাতে। তাই সরকারের উচিত থার্ড পার্টির কথা না শুনে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া।
তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নেওয়ার পর রপ্তানির জট খুলে যায়। মালয়েশিয়া সরকার দুই লাখ ৬৭ হাজার অবৈধ শ্রমিককে বৈধ করেছে। এখন মালয়েশিয়ায় তেমন কোনো অবৈধ শ্রমিক নেই। আমরা ইচ্ছে করলেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ভালো একটি অবস্থান তৈরি করতে পারি।
তাই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, অপার সম্ভাবনার এ শ্রমবাজার নিয়ে চলছে গভীর ষড়যন্ত্র। একটি স্বার্থান্বেষী মহল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে লোক পাঠিয়ে পকেট ভারি করতে চাইছে। এটি কোনো ভাবেই দেশের মঙ্গল বয়ে আনবে না। তাই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যেন কোনো সংকট সৃষ্টি না হয়, সে লক্ষ্যে সরকারের সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করছি। ”
কী ষড়যন্ত্র চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রতিবেশী দেশগুলো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ধরতে চায়। তাই তারা চায় না বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি করুক। কিন্তু, সরকার যে প্রক্রিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশের হাতছাড়া হতে বাধ্য। ”
তিনি বলেন, “সরকার গত চার বছরে ২০ লাখ লোক বিদেশে পাঠিয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে কোনো ভাবেই সরকারের পক্ষে ১০ লাখ লোক মালয়েশিয়ায় পাঠানো সম্ভব নয়। তাই কাজটি বায়রাকে দেওয়ার জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছি। সরকার কাজটি আমাদের দিলে আগামী এক বছরের মধ্যেই আমরা ১০ লাখ লোক মালয়েশিয়ায় পাঠাতে পারবো। ”
বায়রা সভাপতি বলেন, “আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান যদি গমনেচ্ছু ব্যক্তির যাবতীয় খরচ দেয়, অনেক কম টাকায় আমরা পাঠাতে পারবো। খরচ না দিলে জনপ্রতি আমরা নেবো এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। আর সব ব্যয় বহন করলে আমরা ২০ হাজার টাকায় পাঠাতে পারবো। কিন্তু, এখন তো শোনা যাচ্ছে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান যাবতীয় ব্যয় বহন করবে। তারপরও তো সরকার জনপ্রতি খরচ ধরেছে ৪০ হাজার টাকা। ”মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির দায়িত্ব বায়রাকে না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সরকার এবং বায়রার মাঝে আছে একটি থার্ড পার্টি। এই থার্ড পার্টিই মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে চক্রান্ত করছে। অত্যন্ত সুকৌশলে তারা এ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা চায় না রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি করুক। ”
তিনি বলেন, “ওই থার্ড পার্টি সরকারি ব্যবস্থাপনায় মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির পরামর্শ দিচ্ছে। তাদের পরামর্শেই সরকার নিজস্ব উদ্যোগে লোক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় মালয়েশিয়ায় লোক পাঠালে ওই চক্র দালালদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে পারবে। এ কারণেই তারা পরামর্শ দিয়েছে বায়রার মাধ্যমে লোক না পাঠানোর। ”
বায়রা সভাপতি বলেন, “মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার ১০ হাজার লোক পাঠানোর জন্য ডিমান্ড অর্ডার পেয়েছে। এখন ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে করা হচ্ছে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের নিবন্ধন। এরই মধ্যে এই তালিকা করা নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তাই সরকার যেভাবে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে, তা সঠিক নয়। এ প্রক্রিয়ায় কোনো ভাবেই নির্ধারিত সময়ে লোক পাঠাতে পারবে না। ”
তিনি বলেন, “রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতারণা, দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ এনে সরকার নিজেই লোক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এতে দুর্নীতির পথ হয়েছে আরও পাকাপোক্ত। সরকার বায়রার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনলেও মালয়েশিয়ার সরকার কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনেনি। তাই সরকারের এই অভিযোগ সত্য নয়। ”
এটি ঢালাও অভিযোগ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি অনেক মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে। ভিটামাটি এবং শেষ সম্বল বিক্রি করে তো পথে বসেছে অনেকেই- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “দালালদের যারা টাকা দিয়েছেন, তারাই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ”
তিনি বলেন, “যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রতারণা ও দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে, বাতিল করা হয়েছে এমন ৫২টি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইলেন্স। তাই সরকার একটি নীতিমালা করে দিতে পারে। সেই নীতিমালা কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি না মানলে তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা করতে পারে কঠোর শাস্তির। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বায়রার পক্ষ থেকেও নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। আমরা চাই মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর বিষয়টির একটি সমধান হোক। ”
বায়রা সভাপতি বলেন, “বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি লোক কাজ করছে। এদের মধ্যে শতকরা দশমিক ৫ ভাগ পাঠিয়েছে সরকারের বোয়েসেল। বাকি নিরানব্বই দশমিক পাঁচ ভাগই পাঠিয়েছে রায়রা। তাই প্রবাসীরা বাংলাদেশে যে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে তা পুরোপুরি বায়রার অবদান। ”
তিনি বলেন, “প্রবাসীরা ২০১২ সালে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ১৪ দশমিক ১২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। এই টাকা ব্যবহার হচ্ছে দেশের উন্নয়নে। তাই বায়রার অবদান খাটো করে দেখার উপায় নেই। “
শাহ জালাল মজুমদার বলেন, “সরকার আমাদের সহযোগিতা করলে জনশক্তি রপ্তানি খাত থেকে আমরা আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমরা আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে আরও এক কোটি লোক বিদেশ পাঠাতে পারি। এতে বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আয় বর্তমানের দ্বিগুণ হবে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সহযোগিতা এবং একটি উদার বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি। ”
তিনি বলেন, “সরকার যদি বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ করতে চায়, তবে বিদেশে আরও বেশি করে লোক পাঠাতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। তাই সরকার আমাদের সুযোগ দিলে আমরা দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে পারবো আরও বেশি। ”
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে বায়রার দাবি সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমরা বায়রার মাধ্যমে লোক পাঠাতে চাই। কিন্তু, সরকার আমাদের সুযোগ না দিলে এ খাতটি ধ্বংস হয়ে যাবে। ”
তিনি বলেন, “দেশে এখন বারোশ’ রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে। সবাই মিলে কাজ করলে আমরা এ বছরেই মালয়েশিয়ায় ১০ লাখ লোক পাঠাতে পারবো। কিন্তু, সরকার যে প্রক্রিয়ায় লোক পাঠাতে চাচ্ছে, সেভাবে সম্ভব নয়। ”
বায়রা সভাপতি বলেন, “মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন পেশার লোকের চাহিদা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে সেখানে বৃক্ষরোপণের জন্য চেয়েছে ১০ হাজার লোক। তাই সুযোগটি আমাদের কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু, সরকার এটি একা করতে চাইলে বোকামি করবে। কারণ, সরকারের সেই অবকাঠামো নেই। সরকার একা করতে চাইলে নির্ধারিত সময়ে লোক পাঠাতে পারবে না। তাই কাজটি অন্য দেশে চলে যেতে পারে। সরকার শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে অনেক ভালো কাজ করেছে। কিন্তু, এই ভালোকাজের ধারা অব্যাহত রাখতে চাইলে এটি বায়রাকে দিয়ে দেওয়া উচিত। ”
শাহ জালাল মজুমদার বলেন, “একজন লোক পাঠালে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ১০ হাজার টাকাও লাভ থাকে না। তাই সরকার টাকার অঙ্কও নির্ধারণ করে দিতে পারে। তারপরও আমরা কাজটি করতে চাই। কারণ, এখানে আমাদের দেশের স্বার্থ রয়েছে। দেশের স্বার্থেই আমরা কাজটি করবো। ”
তিনি বলেন, “বায়রা বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করে গ্রামীণ বৈষম্য দূর করেছে। আমরা দরিদ্র মানুষকে সেই সুযোগ করে দিয়েছি। অনেক দরিদ্র লোক বিদেশে গিয়ে ফিরিয়েছে তাদের ভাগ্যের চাকা। তাদের বাড়িতে এখন বিল্ডিং উঠেছে। তাদের পারিবার-পরিজন ভালো জীবনযাপন করে। গ্রামের বাড়িতে তারা জমি কিনছে। এটাই আমাদের আনন্দ। ”
তিনি বলেন, “সরকারের নির্ধারণ করা টাকায় আমাদের লাভ কম হলেও আমরা কাজটি করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছি। তাই কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি সরকার নির্ধারিত টাকার বেশি নিলে সরকার তাদের লাইসেন্স বাতিল করে দেবে। ”
সমুদ্র পথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার সম্পর্কে তিনি বলেন, “সরকার যদি এটি বন্ধ করতে না পারে, তবে জনশক্তি রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই সরকারের উচিত মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়া সহজ করে দেওয়া। কিন্তু, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না। ”
বায়রা সভাপতি বলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই মানব পাচারের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও জড়িত থাকে। তাই আগে সরকারকে এদিকে নজর দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে হবে। সচেতন করে তুলতে হবে দেশের স্বার্থের বিষয়টি সম্পর্কে। ”
নতুন শ্রমবাজার সম্পর্কে বায়রা সভাপতি শাহ জালাল মজুমদার বলেন, “বেশ কিছু দেশে নতুন শ্রমবাজারের সম্ভাবনা রয়েছে। মালয়েশিয়া ছাড়াও থাইল্যান্ড, হংকং, জাপান, ইরাক, কুয়েত, সৌদিআরব, কাতার এবং চীনে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ আছে। কিন্ত, এজন্য প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ। সরকার চাইলে আমরা সহযোগিতা করতে পারি। ”
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৩
এআর/সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর
মতামত জানাতে ই-মেইল করুন: [email protected] অথবা [email protected]